ক্যালিপসো সুরে আচ্ছন্ন মিরপুর by জগন্নাথ বিশ্বাস

হেমন্তের অপস্রিয়মাণ আলোর মতো মিরপুর টেস্ট থেকে মুছে গেল বাংলাদেশ। তৃতীয় দিন শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের লিড ৩৩১ রানের। ক্রিজে অপরাজিত সেঞ্চুরিয়ান ড্যারেন ব্রাভো। ড্রেসিংরুমে ব্যাটিংয়ের জন্য অপেক্ষমাণ শিবনারায়ণ চন্দরপলসহ সাত ক্যারিবীয় যোদ্ধা।তৃতীয় দিনের পরিস্থিতি ভিন্নরকম হওয়ারও কোনো আভাস ছিল না। তবে খেলাটা যে ক্রিকেট, তাই আশা-নিরাশায় দোদুল্যমান সুযোগ সবসময় থেকেই যায়। আভাসে-ইঙ্গিতে অনেক যদি-কিন্তুর সম্ভাবনা উড়তে থাকে। মনে হয় স্পিনাররা যদি আরেকটু টার্ন পেতেন... ফিল্ডাররা যদি ক্যাচ না ফেলতেন... তাহলে বোধহয়...।


চূড়ান্ত নিরাশা নিয়েই লিখতে হচ্ছে, তাহলেও কিছু হতো না। আগেই মিরপুর টেস্ট ক্যালিপসো সুরের মূর্ছনায় ঢাকা পড়ে গেছে। সেই দ্বিতীয় দিন থেকেই। ফিদেল অ্যাডওয়ার্ড যখন থেকে মনে করিয়েছেন আদি যুগের ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান পেস ব্যাটারিদের। যারা কিনিংস্টন ওভাল, পোর্ট অব স্পেন কিংবা ত্রিনিদাদে শর্ট অব গুড লেন্থ থেকে বল তুলে তুলে কী অবলীলায় ব্যাটসম্যানদের ফেরত পাঠাতেন সাজঘরে।
কিন্তু তৃতীয় দিন কী দেখল মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম? ক্রিকেটের দুই শ্যামল রাজকুমারের ব্যাটিং। একজন ড্যারেন ব্রাভো, অন্যজন কির্ক অ্যাডওয়ার্ড। তৃতীয় উইকেট জুটিতে যারা যোগ করেছেন ১৫১ রান। দিন শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোর যে ৩ উইকেটে ২০৭, সেটা ওই দুই তরুণ তুর্কির কল্যাণেই।
কিন্তু স্কোরলাইনের মধ্যে তো আর ব্যাটিং সৌন্দর্য থাকে না। তাই ব্রাভোর ব্যাটিংয়ের অলস ভঙ্গিটাও ১০০ রানের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। যারা দেখেছেন, কেবল তারাই জানেন লারার প্রতিচ্ছবি কেমন। উইকেট প্রান্তে তার দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটা হুবহু লারার মতো। রাজসিক, অলস এবং মায়াময়। কোমরে ভাঁজ করা বাঁহাত। ব্যাটের ওপর আলতো ভর দেওয়া ত্রিভঙ্গ মূর্তি। ড্যারেন ব্রাভোর ব্যাকফুট কাভার ড্রাইভটাও ক্রিকেটের উদাসী রাজকুমারকেই মনে করিয়ে দেয়। বোঝা যায় না, ব্রাভো নাকি লারা খেলছেন ২২ গজে। গতকাল মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামেও পার্থক্য বোঝা যায়নি। ত্রিনিদাদের রাজপুত্র অনতিদূর থেকে যেন প্রচ্ছায়ার মতো ভর করেছিলেন ব্রাভোর ওপর। তাই ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরির পর বাংলাদেশকে নিরাশ করে অপরাজিত তিনি। সেঞ্চুরির ভঙ্গিটাও কী অনবদ্য! শুরু করলেন চূড়ান্ত আক্রমণাত্মক ফিল্ডিংয়ের সামনে। সাকিবকে মাথার ওপর দিয়ে আছড়ে ফেললেন বাউন্ডারিতে। এরপর নাসির হোসেনের প্রথম বল পাঠালেন মিড অন দিয়ে সীমানায়। পরের বলে কাভার ড্রাইভ। তারপর মিড উইকেটের ওপর দিয়ে পুল শটে ওভার বাউন্ডারি। রানের স্রোত থামাতে ফিল্ডার সরিয়ে লং অন আর লং অফে নিতে বাধ্য হলেন মুশফিক। বাংলাদেশের আক্রমণাত্মক ফিল্ডিংয়ের ওখানেই যবনিকাপাত। আর কী অসাধারণ দক্ষতায় এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিলেন ব্রাভো এবং অ্যাডওয়ার্ড। স্পিনের বিরুদ্ধে দেখালেন পা আর সুইপ শটের ব্যাবহার। প্রথম ইনিংসের পর দ্বিতীয় ইনিংসেও সেঞ্চুরির সম্ভাবনা জাগিয়ে অ্যাডওয়ার্ড আউট হলেন ৮৬ রানে। সোহরাওয়ার্দী শুভর ফুল লেন্থ ডেলিভারিটা বুঝতে পারেননি। বুঝলে হয়তো ১০ বছর পর ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি করার কীর্তি গড়া হয়ে যেত। তৃতীয় দিনের শুরুতে বাংলাদেশের ইনিংস গুটিয়ে যেতে বেশি সময় লাগেনি। ঘণ্টাখানেকের কিছু বেশি সময় ব্যাট করে আগের দিনের ২০৪ রানের সঙ্গে আর মাত্র ২৭ রান যোগ করেন তিন ব্যাটসম্যান। ৪২ রানে স্যামুয়েলসের বলে ক্যাচ দেন নাসির। এরপর শাহাদত হোসেন ও শুভকে তুলে নিয়েছেন বিশু। ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাদের দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুতেই উইকেট হারায়। নাঈমের সরাসরি থ্রোতে রান আউট হন ব্রাথওয়েট। অযথা ঝুঁকি নিয়ে শট খেলতে গিয়ে সাকিবের বলে মিড অনে ধরা পড়েন কিয়েরন পাওয়েল। এর পরই শুরু হয় ব্রাভো-অ্যাডওয়ার্ডের যুগলবন্দি। ছন্দপতন ঘটিয়ে একজন থেমেছেন; কিন্তু ব্রাভো এগিয়ে চলছেন ত্রিনিদাদের রাজপুত্র চার্লস লারার মতো। যিনি জীবনের প্রথম সেঞ্চুরি করা ইনিংসে ২৭৭ করে থেমেছিলেন। ফিরিয়ে এনেছিলেন ক্যারিবিয়ান প্যাশন আর প্রাইডের অমিত গৌরব। লারার প্রচ্ছায়া হয়ে গৌরব ফেরানোর অপেক্ষায় কি ব্রাভোও? আজ মিলবে সেটার উত্তর।

No comments

Powered by Blogger.