ব্যাংক পরিচালকের সংখ্যা ১৩, মেয়াদ সর্বোচ্চ ছয় বছর by মজুমদার বাবু

ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ব্যাংক কম্পানি আইন সংশোধনের খসড়ায় একটি ব্যাংকে পরিচালকের সংখ্যা সর্বোচ্চ ১৩ এবং তাঁদের মেয়াদকাল তিন বছর করে দুই মেয়াদে ছয় বছরে সীমিত করার প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এ প্রস্তাবে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে ব্যাংক পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)।বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া ব্যাংক কম্পানি আইন সংশোধনের খসড়ায় পরিচালকের সংখ্যা ও মেয়াদকাল-সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রস্তাবকে 'প্রত্যাখ্যান' করে বিএবি বলেছে, ব্যাংকের ভালো-মন্দের সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদের আকৃতির সংশ্লিষ্টতা নেই।


১৩ অক্টোবর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো বিএবির মতামতে এ মন্তব্য করা হয়েছে। ব্যাংক খাতে করপোরেট গভর্ন্যান্স প্রতিষ্ঠার জন্য আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় এ পরিবর্তনগুলো আনা দরকার বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো প্রস্তাব ব্যাংক খাতের একটি সংগঠনের সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা সংগত নয় বলেও মত দেন তাঁরা।
ব্যাংক কম্পানি আইনের খসড়া প্রস্তাবে ১৫ (৬) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক কম্পানির পরিচালকের সংখ্যা হবে ১৩। এ বিষয়ে বিএবি তাদের মতামতে বলেছে, 'প্রস্তাবিত সংশোধন দেশ ও অর্থনীতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। সুতরাং প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করা হলো।'
যুক্তি হিসেবে সংগঠনটি জানিয়েছে, ইনস্যুরেন্স আইনে স্পষ্ট বলা আছে বীমা কম্পানির বোর্ডে ২০ জন পর্যন্ত ডিরেক্টর থাকবে এবং মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে এ ধরনের বিধিনিষেধ নেই। সুতরাং ব্যাংক কম্পানি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের খসড়া প্রস্তাবটি হবে বৈষম্যমূলক এবং অনিষ্পন্ন। ব্যাংকের উন্নয়নের সঙ্গে বোর্ডের আকারের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা নেই। কোনো ব্যাংক ভালো বা খারাপ করলে বোর্ডের আকার পার্থক্য তৈরি করবে না। বোর্ডের আকার ও মেয়াদসংক্রান্ত ব্যাংক প্রবিধি ও নীতি বিভাগের একটি প্রজ্ঞাপনের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি আপিলের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বিএবি বলেছে, সব ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বোর্ডের আকারের একটা সামঞ্জস্য থাকা দরকার। শুধু ব্যাংকের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিত নয়। সার্বিকভাবে আর্থিক খাতের সুস্থ প্রবৃদ্ধির জন্য বিষয়টি জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংকের খসড়া প্রস্তাবের ১৫ ক ক ধারায় বলা হয়েছে, পর পর দুই মেয়াদে ছয় বছরের বেশি ব্যাংক কম্পানির পরিচালক থাকা যাবে না। এ প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেছে বিএবি। সংগঠনটির যুক্তি হলো_ইনস্যুরেন্স অ্যাক্টে বোর্ডের পরিচালকদের মেয়াদকাল সম্পর্কে কিছু বলা নেই। সুতরাং ব্যাংক আইনের খসড়াটি বৈষম্যমূলক। কারণ কোনো ব্যাংকের ভালো-খারাপের সঙ্গে বোর্ডের মেয়াদের কোনো সম্পর্ক নেই। যদি কোনো ব্যাংক খারাপ করে তাহলে পরিচালকদের অপসারণের ক্ষমতাও বাংলাদেশ ব্যাংকের রয়েছে। কিন্তু যদি কোনো বোর্ড সদস্যের বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো অভিযোগ না থাকে, সে ক্ষেত্রে তাঁদের মেয়াদকাল সীমিত করার যৌক্তিক কারণ নেই। জোর করে যোগ্য সদস্যদের পরিচালনা পর্ষদ থেকে বিদায় দিলে তাতে প্রতিষ্ঠানের উপকার হয় না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকে পরিচালকের সংখ্যা বেশি হলে ব্যাংকের ব্যয় বাড়ে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও জটিলতা সৃষ্টি হয়। সংখ্যা বেশি হলে ব্যাংকে পরিচালকদের হস্তক্ষেপও বেশি হবে। তাই তাঁদের সংখ্যা সীমিত রাখার বিষয়টি বিবেচনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাংকের পরিচালকসংখ্যা সীমিত এবং তাঁদের মেয়াদও নির্দিষ্ট। এমনকি ভারত ও পাকিস্তানেও ব্যাংক পরিচালকদের মেয়াদ নির্দিষ্ট। একমাত্র বাংলাদেশের ব্যাংক কম্পানি আইনই ব্যতিক্রম, যেখানে পরিচালকের সংখ্যা ও মেয়াদ নির্দিষ্ট করা নেই। তাই সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের আপিলের বিষয়ে তিনি বলেন, আপিল একটি সার্কুলারের বিষয়ে চলছে। এর সঙ্গে আইন সংশোধনের সম্পৃক্ততা নেই। যদি আইন পাস হয় তাহলে আইনই কার্যকর হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ব্যাংকের পরিচালক কতজন হবে সেটা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংক পরিচালকরা আলাপ-আলোচনা করে নিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে হয়তো ১৩ জনের স্থানে ১৫ জন হতে পারে। কিন্তু এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দেবে, এটা তো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দেখা যাচ্ছে ব্যাংকভেদে পরিচালকসংখ্যা হেরফের হচ্ছে। এটা সুনির্দিষ্ট হতে হবে। এ ছাড়া পরিচালক হওয়ার যোগ্যতা আছে এমন সবাইকেই ব্যাংক পরিচালনার সুযোগ দেওয়া উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, একজন আজীবন ব্যাংক পরিচালক কিংবা চেয়ারম্যান থাকবেন_এটা হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে যাঁদের পরিচালক হওয়ার যোগ্যতা আছে তাঁদের পরিচালক ও চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। নতুবা এটা ব্যক্তির ব্যাংক হিসেবে পরিচিত হবে এবং এ ক্ষেত্রে করপোরেট গভর্ন্যান্স বিঘি্নত হবে।
পরিচালকরা ব্যাংকের নির্দিষ্ট পরিমাণ শেয়ার ধারণ করেন। সুতরাং ব্যাংকের মুনাফার নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশ তাঁরা পেয়ে থাকেন। এর পরও আজীবন ব্যাংকের পরিচালক থাকার মধ্যে মাহাত্ম্য কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার সঙ্গে সামাজিক মর্যাদার একটি বিষয় থাকে। তা ছাড়া নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে না পারলেও অন্য ব্যাংক থেকে তাঁরা সহজেই নিজের পরিচয় ব্যবহার করে ঋণ সুবিধা পেয়ে থাকেন, যা অনেক বড় একটি স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়।
ড. সালেহউদ্দিন বলেন, ব্যাংক মূলত আমানতকারীদের অর্থেই ব্যবসা করে থাকে। সে বিবেচনায় আমানতকারীদের মধ্য থেকে আমার সময়ে একজন স্বতন্ত্র পরিচালক করার নির্দেশনা প্রদান করেছিলাম। আমানতকারীদের মধ্য থেকে পরিচালকসংখ্যা আরো বাড়িয়ে ব্যাংকে আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা করা উচিত বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ড. খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, একই লোক দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকের পরিচালক থাকলে সেখানে গণতন্ত্র থাকে না, এমনকি স্বার্থান্বেষী চক্র তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই কোনো ব্যাংকের সর্বোচ্চ পরিচালকসংখ্যা ১৩ এবং তাঁদের মেয়াদ দুই মেয়াদে ছয় বছরের বেশি না করার প্রস্তাব থাকতেই পারে।
ব্যাংক কম্পানি আইনকে ইনস্যুরেন্স আইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার যৌক্তিকতা সম্পর্কে তিনি বলেন, এ দুটোর তুলনা চলে না। ব্যাংক কম্পানি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার আইন অনুসরণ করে। তাদের সঙ্গেই তুলনা
হওয়া উচিত।

No comments

Powered by Blogger.