একসঙ্গে বিদায় নিচ্ছেন তিন ডেপুটি গভর্নর-পুনর্নিয়োগের সুপারিশ উপেক্ষা : আর্থিক খাতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা by মজুমদার বাবু

বাংলাদেশ ব্যাংকের তিন ডেপুটি গভর্নরের পদ শূন্য হতে যাচ্ছে আগামী ৩১ ডিসেম্বর। এ তিনজনকে দুই বছর মেয়াদে পুনর্নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। কিন্তু গভর্নরের সুপারিশকে আমলে নেননি অর্থমন্ত্রী। তিনি নতুন তিন ডেপুটি গভর্নর মনোনয়নের জন্য সার্চ কমিটি গঠন করে এর কার্যক্রম শুরুর নির্দেশ দেন। তবে পুঁজিবাজারকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অস্থিরতার মধ্যে একসঙ্গে তিনজন অভিজ্ঞ ডেপুটি গভর্নরকে বিদায় দিলে আর্থিক খাতে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।


আর্থিক খাতের বিশ্লেষকদের অভিমত, তিনজন ডেপুটি গভর্নরকে একই সঙ্গে বিদায় না দিয়ে ধাপে ধাপে রিপ্লেসমেন্ট করা উচিত। এতে নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে আগের প্রেক্ষাপট ও ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। তাঁদের মতে, ব্যাংকিং খাতের আধুনিকায়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সুতরাং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি প্রণেতা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারক পর্যায়েও ধারাবাহিকতা থাকা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যেক ডেপুটি গভর্নরেরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রায় সব শাখায় কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। বর্তমান গভর্নর যদি ধাপে ধাপে তাঁদের রিপ্লেসমেন্টের সুপারিশ করে থাকেন, সেটা ভালো প্রস্তাব ছিল। কারণ এতে নীতি প্রণয়নে ধারাবাহিকতা বজায় থাকত।' তবে তাঁদের জায়গায় নতুন নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা আবশ্যক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সালেহ উদ্দিন আরো বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংকে আগে কাজ করার দক্ষতা রয়েছে এমন গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর কিংবা পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের সার্চ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করলে আরো ভালো হতো। সার্চ কমিটিকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিলে নিয়োগ ভালো হবে। এর ব্যতিক্রম হলে সত্যিই দুঃখজনক হবে।'
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ড. খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো সবাইকে একসঙ্গে না করে একজন একজন করে রিপ্লেসমেন্ট করা যেত। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি প্রণয়নে ধারাবাহিকতা বজায় থাকত। দেশের বিরাজমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকার আপাতত একজন কিংবা দুজনকে রেখে দিতে পারত। তবে আগে তিনজনকে একসঙ্গে নিয়োগ দেওয়ার কারণেই এখন এ জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান সরকার ব্যতিক্রম ভাবতেও পারত।'
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পিকেএসএফের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমানকে প্রধান করে সম্প্রতি সার্চ কমিটি গঠন করে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সেই সঙ্গে এ কমিটির কার্যক্রম শুরু করার জন্য চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে।
এদিকে দেশে বিরাজমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে তিন ডেপুটি গভর্নর নজরুল হুদা, জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী ও মুরশিদ কুলী খানকে আরো দুই বছরের জন্য পুনর্নিয়োগ দিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে লিখিতভাবে সুপারিশ করেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান। একসঙ্গে তিনজন অভিজ্ঞ ডেপুটি গভর্নর অবসরে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নীতি-নির্ধারণে শূন্যতা তৈরি হবে_এ আশঙ্কা থেকে তিনি এ পদগুলোতে ধাপে ধাপে নতুন নিয়োগের পরামর্শও দেন। অর্থমন্ত্রী গভর্নরের সুপারিশ আমলে না নিয়ে তিন ডেপুটি গভর্নরের পদ খালি করে ৩১ ডিসেম্বরের আগে ডেপুটি গভর্নর মনোনয়নের জন্য সার্চ কমিটি গঠন করেন এবং এর কার্যক্রম শুরু করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে নির্দেশ দেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদায়ী তিন ডেপুটি গভর্নর ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। এঁদের প্রত্যেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে উপপরিচালক পদে নিযুক্ত হয়ে পদোন্নতি পেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হন। এরপর তাঁরা সরকারের মনোনয়ন পেয়ে ডেপুটি গভর্নর নিযুক্ত হন। দীর্ঘ কর্মজীবনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর-১ নজরুল হুদা ব্যাংক কম্পানি আইন প্রণয়ন এবং সংশোধনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। মূলত তাঁর হাত ধরেই ব্যাংক-কম্পানি আইন আধুনিক রূপ পায় এবং ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পুনর্গঠনে তাঁর লেখা 'নোটিং' কেন্দ্রীয় ব্যাংকে 'বাইবেল' হিসেবে সুপরিচিত। ডেপুটি গভর্নর-২ জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশ্বমন্দার সময়েও তিনি দক্ষতার সঙ্গে দেশের রিজার্ভ বিনিয়োগ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুনাফার প্রবৃদ্ধি সমুন্নত রাখেন। ফরেন রিজার্ভ ম্যানেজমেন্ট এবং ফরেন এঙ্চেঞ্জ আইন সংশোধনেও বিশেষ ভূমিকা পালন করেন তিনি। ডেপুটি গভর্নর-৩ মুরশিদ কুলী খান বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারভিশন বিভাগের আধুনিকায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকে ভিজিল্যান্স বিভাগ, অন্যান্য ব্যাংকের ক্যামেলস রেটিং ও ডায়াগনসিস রিপোর্ট চালু করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকাই ছিল মুখ্য। বিশেষভাবে অরিয়েন্টাল ব্যাংক দেউলিয়া হলেও দৃঢ় হাতে তিনি তা সামাল দেন এবং আইসিবি গ্রুপের কাছে ব্যাংকটি বিক্রির ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। প্রবলেম ব্যাংককে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ রয়েছে তাঁর। তিনি ইউএস ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকসহ উন্নত বিশ্বের একাধিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.