মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-গোলাম আযমের বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্ট চূড়ান্ত

মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ দলের পাঁচ নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে তদন্ত সংস্থা। এই প্রতিবেদন আজ মঙ্গলবার সকালে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের কাছে দাখিল করা হবে। অভিযুক্তদের মধ্যে চারজন কারাগারে রয়েছেন। গোলাম আযমকে যেকোনো মুহূর্তে গ্রেপ্তার করা হতে পারে বলে তদন্ত সংস্থা জানিয়েছে।
অন্য যাঁদের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়েছে তাঁরা হলেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ এবং সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা।


গতকাল সোমবার বিকেল সাড়ে ৩টায় বেইলি রোডে তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান জানান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজামীসহ গ্রেপ্তার করা জামায়াতের চার নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়েছে গোলাম আযমের বিরুদ্ধেও। তিনি জানান, ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনা না থাকলেও গোলাম আযমের বিরুদ্ধেও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে আজ। প্রতিবেদনে গোলাম আযমকে গ্রেপ্তারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
আবদুল হান্নান খান বলেন, 'যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। আমরা ইচ্ছা করলে আদালতের কাছে আরো সময় চাইতে পারতাম, কিন্তু দেশবাসীকে আমরা আর অপেক্ষায় রাখতে চাই না। তাই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়েছে।'
সংবাদ সম্মেলনে আরো বক্তব্য দেন তদন্ত সংস্থার সদস্য মো. সানাউল হক, মো. মতিউর রহমান ও মো. আবদুর রাজ্জাক খান।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ৩৬০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন : তদন্ত সংস্থার দেওয়া তথ্যমতে, গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ৩৬০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন ৪০ জন। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদনের পাশাপাশি ১০ হাজার পৃষ্ঠার নথি সংযুক্ত রয়েছে। এসবের মধ্যে আছে মুক্তিযুদ্ধকালের তথ্য ও চিত্রসংবলিত সিডি, ডিভিডি, নিউজ কাটিং, গণহত্যাসংক্রান্ত ভিডিও, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও আলবদর বাহিনীর অনাচারের প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য এবং তখনকার এনবিসি, সিবিএস, দৈনিক সংগ্রাম, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক পাকিস্তান ও পাকিস্তান অবজারভারের প্রতিবেদন।
তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান জানান, পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির ও পিস কমিটির নেতা গোলাম আযমের মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় সব ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জামায়াতের এই শীর্ষ নেতার ভূমিকা ছিল বলে তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে তিনি দেশ ও জাতির জন্য কিছু করতে পেরেছেন বলে মনে করেন।
দৈনিক সংগ্রামই তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী : ন্যুরেমবাগ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর রবার্ট এইচ জ্যাকসনের উদাহরণ টেনে আবদুল হান্নান বলেন, 'ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিদের রবার্ট বলেছিলেন, আসামিদের শত্রুদের দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে না। বরং তাদের মিত্রদের রেখে যাওয়া নথিপত্রই তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশেও একই অবস্থা। জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামই তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী। এ ছাড়া তাঁদের লেখা বিভিন্ন বইপত্রই তাঁদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছে। গোলাম আযম হচ্ছেন শীর্ষ নেতা, যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় শান্তি কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করেছেন।'
নিজামীর বিরুদ্ধে ৪১১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন : এ ছাড়া মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে ৪১১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন ৪০ জন। আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে ৩৬৬ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন ৪৫ জন। মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ৩২৭ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন ৩৭ জন। আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ৩৮৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে ২৫ জন।
তদন্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক খান সংবাদ সম্মেলনে জানান, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত করেছেন তিনি। এটা তাঁর চাকরি জীবনের সবচেয়ে বেশি পাওয়া।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এরই মধ্যে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা আরেক বিএনপি নেতা আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.