ক্রিকেট আর রা-ওয়ানের দেশে এফ ওয়ান

রেস শুরু হবে বিকেল ৩টায়। তার ঘণ্টা তিনেক আগেই বুদ্ধ ইন্টারন্যাশনাল সার্কিটে চলে এসেছেন শচীন টেন্ডুলকার। ভারতের মাটিতে প্রথম ফর্মুলা ওয়ান বলে কথা, উত্তেজনা তো থাকবেই। টেন্ডুলকারকে দেখে ব্যস্ততা বেড়ে যায় ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের। এমন উৎসাহ দেখে এক স্প্যানিয়ার্ড সাংবাদিক বলেই বসেন, 'কে এই ভদ্রলোক? ভারতের খুব ধনী লোক মনে হয়!' ভারতীয় এক সাংবাদিক তখন বুঝিয়ে বললেন, 'ইনি শচীন টেন্ডুলকার, ভারতীয় ক্রিকেটের ভগবান।' স্প্যানিশ সেই সাংবাদিকের ঘোর কাটে না তাতেও।


কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেন না, ফুটবল, ফর্মুলা ওয়ানের মতো বিশ্বব্যাপী প্রচারণা না থাকলেও ক্রিকেটের একজন খেলোয়াড়ের এমন জনপ্রিয়তা থাকে কী করে!
হ্যাঁ, ক্রিকেটটা যেমন ইউরোপ, আমেরিকায় অপরিচিত-অজনপ্রিয় উপমহাদেশে সেই হাল ফর্মুলা ওয়ানের। মাইকেল শুমাখার, সেবাস্তিয়ান ভেত্তেলরা হতে পারেন ফর্মুলা ওয়ানের কিংবদন্তি কিন্তু এ অঞ্চলে তাঁরা একপ্রকার অপরিচিত মুখই। এ অঞ্চলে 'অপরিচিত' অথচ জগদ্বিখ্যাত এ তারকাদের নিয়ে ভারতে হয়ে গেল উপমহাদেশের প্রথম ফর্মুলা ওয়ানের আসর। দিলি্ল থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরের নয়ডার এক ধু ধু প্রান্তরে বুদ্ধ ইন্টারন্যাশনাল সার্কিট নামের 'আন্তর্জাতিক গ্রাম'-এ অনুষ্ঠিত হলো বছরের ১৭তম রেস। রেসটা দেখতে প্রায় ৯৫ হাজার দর্শক সমাগম হাসি ফুটিয়েছে আয়োজকদের মুখে। সেই দর্শকদের মধ্যে ছিলেন ক্রিকেটের শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলী, যুবরাজ সিং, হরভজন সিং, সুরেশ রায়নার মতো খেলোয়াড়রা।
ক্রিকেটের মতো ভারতে জনপ্রিয় বলিউড তারকারাও। বলিউডের নতুন কোনো সিনেমা না দেখলে অনেকেরই ভালো কাটে না সপ্তাহটা। ভারত এখন কাঁপছে বলিউডের নতুন সিনেমা রা-ওয়ান-জ্বরে। রা-ওয়ানের দেশের তারকারা আবার বুঁদ এফ. ওয়ানে (ফর্মুলা ওয়ানে)। তাই বুদ্ধ ইন্টারন্যাশনাল সার্কিটে শুমাখার-ভেত্তেলদের রেস দেখতে এসেছিলেন বলিউড বাদশা শাহরুখ খান, অনিল কাপুর, ফারদিন খান, প্রীতি জিনতা, বিপাশা বসুর মতো তারকারাও। আর ভারতে ফর্মুলা ওয়ান জনপ্রিয় করতে এই তারকাদেরই কাজে লাগাতে চান আয়োজকরা। তাই ফর্মুলা ওয়ানের তিনবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জন স্টুয়ার্ট বললেন, 'ভারতে ক্রিকেটের পরই খেলাটাকে জনপ্রিয় করতে হলে শচীন টেন্ডুলকারের মতো ক্রিকেটারকে কাজে লাগাতে হবে। ভূমিকা রাখতে পারেন বলিউডের তারকারাও।' তবে ফর্মুলা ওয়ানে বছরে এক দেশে একটা মাত্র রেস হয়, 'উড়ন্ত স্কট'খ্যাত এ কিংবদন্তি মনে করেন ভারতকে এগোতে হলে গাড়ির প্রতিযোগিতা আরো বাড়াতে হবে, 'ভারতে কতগুলো ক্রিকেট পিচ বলুন তো, গোনা সম্ভব নয়। এত পিচ থাকলে তবেই একজন শচীন টেন্ডুলকার পাওয়া যায়। ফর্মুলা ওয়ানের ভালো ড্রাইভার পেতে হলে গাড়ির আরো খেলা চাই এই দেশে। ট্র্যাকও বাড়াতে হবে। তবে বুদ্ধ সার্কিকটটা অসাধারণ। নতুন যতগুলো সার্কিট যোগ হয়েছে তার মধ্যে আমার দেখা সেরা এটাই।'
শচীন টেন্ডুলকার কি ভাবছেন ভারতে ফর্মুলা ওয়ানের ভবিষ্যৎ নিয়ে? পরশু 'চেকার্ড ফ্ল্যাগ' নাড়ানোর সম্মান পেয়েছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা এ ব্যাটসম্যান। আয়োজকরাও তাঁর সম্মানে পতাকাটা দিয়ে দেন টেন্ডুলকারকে। অনুভূতি জানাতে গিয়ে টেন্ডুলকারও আবেগাপ্লুত, 'চেকার্ড ফ্ল্যাগ নাড়ানোর অভিজ্ঞতাটা দুর্দান্ত। ফ্ল্যাগটা রেখেও দিতে পারলাম আমি! দারুণ ট্র্যাক, দুর্দান্ত আয়োজন। এফ. ওয়ান সত্যি আমাদের সবাইকে স্মরণীয় একটা দিন উপহার দিয়ে গেল। ভারতীয় হিসেবে এ জন্য আমি গর্বিত। ফর্মুলা ওয়ান আয়োজন করতে পেরে ভারতও গর্বিত।'
শচীন টেন্ডুলকারের মতো উচ্ছ্বসিত ভারতীয় দলের অন্য ক্রিকেটাররাও। তবে খেলাটা ক্রিকেটকে ছাড়িয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠবে এটা মনে করেন না ২০১১-এর ওয়ানডে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় যুবরাজ সিং, 'রেস শুরুর সময় ভ্রুম, ভ্রুম, ভ্রুম করে যে শব্দটা হলো, এককথায় রোমাঞ্চকর ব্যাপার। আমার ধারণা খেলাটা ভারতে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। তবে ক্রিকেটকে জনপ্রিয়তায় পেছনে ফেলতে পারবে না, কেননা বছরে ১৯টা মাত্র রেস হয় বিশ্বের ১৯টা দেশে। ভারতেও তাই বছরে একবারই হবে আর ক্রিকেট তো পুরো বছরের খেলা।'
খেলাটা জনপ্রিয় হবে কি না, সময়ই বলবে। তবে ফর্মুলা ওয়ান দেখতে ভারতে আসা সবাই কিন্তু ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এ আয়োজনের। ফর্মুলা ওয়ানের প্রধান বার্নি একলেস্টোন মুগ্ধতা প্রকাশ করলেন এভাবে, 'আমি অভিভূত। বিশ্বের এ প্রান্তে এত সুন্দর একটা ট্র্যাক হতে পারে ভাবতেই পারিনি। প্রায় লাখখানেক দর্শকের উপস্থিতিও অবাক করেছে আমাকে। প্র্যাকটিসের সময় একটা কুকুরের ট্র্যাকে ঢুকে পড়া ছাড়া অনভিপ্রেত আর কিছুুই হয়নি।' অভিভূত সাতবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মাইকেল শুমাখারও, 'দেশটা দারুণ, রেসটাও ভালো হলো। আমার পক্ষ থেকে প্রচুর প্রশংসা রইল ভারতের জন্য।' রেসের আগে সাধারণত কারো সঙ্গে দেখা করেন না শুমাখার। বন্ধু শচীন টেন্ডুলকারের জন্য নিয়মটা ভাঙলেন পরশু। রেস শুরুর আধ ঘণ্টা আগে দেখা করলেন টেন্ডুলকার, তাঁর স্ত্রী অঞ্জলি ও মেয়ে সারার সঙ্গে। কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে তুললেন ছবিও। শুমাখারকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে আপ্লুত টেন্ডুলকার-তনয়া সারা, 'শুমাখার বলেছেন তাঁর মেয়েও আমার বয়সী। আমি তাঁর ভক্ত কি না জানতে চাইলে বলেছি, আমি ফর্মুলা ওয়ান বুঝি না, টেনিস খেলি।' বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার পর রেসটাও ভালোই হয়েছে শুমাখারের। ১২ নম্বরে শুরু করে হয়েছেন পঞ্চম আর দল মার্সিডিজকে এনে দিয়েছেন ১০ পয়েন্ট।
ভারতের মাটিতে ঐতিহাসিক এই রেসের প্রথম বিজয়ী শুমাখারেরই স্বদেশি সেবাস্তিয়ান ভেত্তেল, যাঁকে এখন থেকেই বলা হচ্ছে 'নতুন শুমাখার'। না বলার কারণও নেই, দুজনের জীবন আর ক্যারিয়ারের বাঁকে বাঁকে যে অনেক মিল! জার্মানির ছোট্ট শহর আর সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেছেন দুজনই। শুমাখারের বাবা ছিলেন রাজমিস্ত্রি আর দুবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভেত্তেলের বাবা ছিলেন ছুতোর। অভিষেক রেসে সপ্তম হয়ে চমকে দিয়েছেন দুজনই। ক্যারিয়ার শুরুর তৃতীয় মৌসুমে ৫ নম্বর গাড়ি চালিয়ে শুমাখারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছেন ভেত্তেলও।
পরশু ৪২তম ল্যাপে নাইজেল ম্যানসেলের ১৯ বছরের রেকর্ড ভেঙে এক মৌসুমে ৬৯৩ ল্যাপে এগিয়ে থাকার অনন্য নজির গড়েছেন সেই ভেত্তেল। এ কারণে উচ্ছ্বসিত এই মৌসুমে সবচেয়ে বেশি ৩৪৯ চ্যাম্পিয়নশিপ পয়েন্ট পাওয়া এই তরুণ। সংবাদ সম্মেলনে হিন্দিতে কথা বলে তো চমকেই দিয়েছেন রীতিমতো। ভারতীয় মেয়েদের রূপের প্রশংসা করে জানালেন, 'ভারতীয় মেয়েরা খুবই সুন্দর, বিশেষ করে ওদের চোখগুলো। প্রথম ভারতীয় গ্রাঁ প্রিঁতে চ্যাম্পিয়ন হতে পেরে গর্বিত আমি। এই দেশটা আমাদের ইউরোপের চেয়ে আলাদা হলেও এখানকার মানুষ সুখী। ওদের সংস্কৃতিটাও আলাদা।'
এই সংস্কৃতিতে কদর ক্রিকেট আর রা-ওয়ানের মতো বলিউডি সিনেমার। রা-ওয়ানের মতো এফ. ওয়ান নিয়েও কি একটা সময় মাতবে ভারতবাসী? ওয়েবসাইট

ইন্ডিয়ান গ্রাঁ প্রিঁতে সংঘর্ষ হয়েছে লুইস হ্যামিল্টন ও ফিলিপ মাসার গাড়ির। এ মৌসুমে এ নিয়ে ছয়বার সংঘর্ষ হলো দুজনের।
১১
এ পর্যন্ত হওয়া মৌসুমের ১৭ রেসের মধ্যে সেবাস্তিয়ান ভেত্তেল জিতেছেন ১১টি। আর দুটি রেস জিতলে তিনি স্পর্শ করবেন ২০০৪ সালে মাইকেল শুমাখারের ১৩ রেস জয়ের রেকর্ড।
৬৯৩
এ মৌসুমে ৬৯৩ ল্যাপে এগিয়ে থেকে নতুন রেকর্ড গড়লেন সেবাস্তিয়ান ভেত্তেল।
৯৫০০০
বুদ্ধ ইন্টারন্যাশনাল সার্কিটে রেস দেখতে এসেছিল ৯৫ হাজার দর্শক। এ সার্কিটে একসঙ্গে ফর্মুলা ওয়ান উপভোগ করতে পারেন এক লাখ ২০ হাজার দর্শক।

No comments

Powered by Blogger.