ঈশ্বরদী বিমানবন্দরের জায়গায় এখন মিলিটারি ডেইরি ফার্ম-এককালে ঢাকা রুটে প্রতিদিন ছিল দুটি ফ্লাইট by আনোয়ারুল আলম রঞ্জু,

কসময়ের অন্যতম ব্যস্ত ঈশ্বরদী বিমানবন্দর এখন এলাকার মানুষের কাছে শুধুই স্মৃতি। এটি পরিত্যক্ত এক বিরাণভূমি মাত্র। সেই ১৯৬২ সালে ৪১২ একর জায়গার ওপর ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে পিএসপি (পারফোরেটড স্টিল প্লান্ট) দিয়ে উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তম এ বিমানবন্দরটির রানওয়ে নির্মাণ করা হয় এবং ডাকোটা ডিসি-৩ এয়ার সার্ভিস চালু করা হয়। ১৯৬৬ সালে পিএসপি রানওয়ে তুলে দিয়ে পাকা কংক্রিটের রানওয়ে নির্মাণ করা হয় এবং বাফার এফ-২৭ চালুর মধ্য দিয়ে এর সম্প্রসারণ ঘটে। এ সময় উত্তরবঙ্গের জরুরি যেকোনো অবস্থা মোকাবিলা ও যাত্রীর কারণে ঈশ্বরদী বিমানবন্দরে মার্কিন সি-১৩০ বিমান ওঠানামা করত।


এ সময় অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে প্রতিদিন দুটি করে ফ্লাইট ঈশ্বরদী-ঢাকা-ঈশ্বরদী রুটে যাতায়াত করত। প্রচুর পান তখন ঈশ্বরদী থেকে ঢাকা হয়ে করাচি যেত।
মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত এ বিমানবন্দরটি ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা হয়। প্রথমে ডাকোটা ডিসি-৩ ও পরে ফকার এফ-২৭ চালু করা হয়। বিমানযাত্রীদের আকৃষ্ট করতে এবং সার্বিক সুবিধার জন্য তৎকালীন পিআইএ কর্তৃপক্ষ ঈশ্বরদীতে জেলা অফিস স্থাপন করে রাজশাহী, পাবনা ও কুষ্টিয়ায় চালু করে শাখা অফিস। এমনকি রাজশাহী থেকে যাত্রী আনার জন্য বিমানের নিজস্ব কোচ সার্ভিস ছিল। ঈশ্বরদী বিমানবন্দর থেকে সে সময় রাজশাহী, বগুড়া, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ভেড়ামারা, নওগাঁ, সান্তাহার ও নাটোর এলাকার যাত্রীদেরও নিয়মিত যাতায়াত করতে দেখা যেত। দেশ স্বাধীনের পর বিমানের সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে বারবার ভাড়া বৃদ্ধি, সময়সূচির অসামঞ্জস্যতা এবং একে একে কুষ্টিয়া ও পাবনার শাখা অফিস বন্ধ করায় এ এলাকার মানুষ সড়কপথে রাজধানীতে যাতায়াত শুরু করে। এরপর এরশাদ সরকারের আমলে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে শুধু রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজশাহীতে একটি বিমানবন্দর চালু করা হয় এবং ঈশ্বরদী বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। প্রবল জনদাবির মুখে ১৯৯৪ সালের ১৭ জুলাই সরকার পুনরায় বিমানবন্দরটি চালু করে। এ সময় সপ্তাহে দুটি ফ্লাইট ঢাকা-ঈশ্বরদী-ঢাকা রুটে দেওয়া হয়। ঈশ্বরদীর নির্ধারিত ১০টি আসনের চেয়ে বেশি চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ১৯৯০ সালের ৪ এপ্রিল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঈশ্বরদীবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৪ সালের ১৭ জুলাই প্রায় চার কোটি ব্যয়ে সংস্কারের মাধ্যমে বিমানবন্দরটি আবারও চালু করা হয়।
ঈশ্বরদী বিমানবন্দর অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গাফিলতি, অপরিকল্পিতভাবে টিকিট বিক্রয়, কেন্দ্র স্থানান্তর ইত্যাদি কারণে বিমানবন্দরকে লোকসান দেখানোর অজুহাতে ১৯৯৬ সালের ৩ নভেম্বর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিমান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৯৯৮ সালের ১০ মে ঈশ্বরদী-ঢাকা রুটে বেসরকারি বিমান এয়ার পারাবতের স্টল সার্ভিস আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হয়। মাত্র ৩৮ দিন চলাচলের পর ওই বছরের ২৮ জুন ঈশ্বরদী বিমানবন্দর কোনো কারণ ছাড়াই বন্ধ হয়ে যায়। এরপর উত্তরবঙ্গের এ বিমানবন্দরটি গত ১৩ বছরেরও চালু করা হয়নি।
এদিকে বিমানবন্দরটি বন্ধের পর পরই এখানে মিলিটারি ডেইরি ফার্ম স্থাপন করা হয়। বর্তমানে অধিকাংশ জায়গা এ ফার্মের আওতায় রয়েছে। পুরো এলাকা গোচারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। বিমানবন্দরের রানওয়েতেও গোবর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। রাস্তায় গোখাদ্য পোয়াল শুকানো হয়। ফলে পরিবেশই হয়ে পড়েছে অন্য রকম। শুধু টাওয়ার আর রানওয়ে না থাকলে মনেই হবে না এটা একসময় বিমান বন্দর ছিল। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ২০টি স্টাফ কোয়ার্টারের মধ্যে ১৬টিই এখন ডেইরি ফার্মের নিয়ন্ত্রণে। অথচ এই বিমানবন্দরে এখনো একজন ম্যানেজারসহ ১৪ জন কর্মচারি রয়েছেন, যাঁদের বেতন ও অন্যান্য খরচ বাবদ প্রতি মাসে প্রায় দুই লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে। এয়ারপোর্ট ম্যানেজার রাজশাহী থেকে এখানে প্রতি মাসে দুদিন অফিস করেন।
সারা দেশের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ ও ভৌগোলিক অবস্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হিসেবে পরিচিত ঈশ্বরদী। এখানে রয়েছে ইপিজেড, এশিয়ার অন্যতম আখ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ডাল গবেষণা কেন্দ্র, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প, রেলওয়ের বিভাগীয় সদর দপ্তর, রেশম বীজাগার, আলহাজ সুতা কারখানা, বিদ্যুৎ বিভাগের গ্রিড অফিসসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অফিস। বিমানবন্দর চালু হলে দেশি শিল্পোদ্যক্তাসহ বিদেশি শিল্পোদ্যোক্তা কম্পানিগুলো ঈশ্বরদী ইপিজেডে শিল্প-কারখানা স্থাপন করতে আগ্রাহী হবে। কারণ শুধু যোগাযোগের ক্ষেত্রে রেল ও স্থলপথ ছাড়া আকাশপথে কোনো ব্যবস্থা না থাকায় ইপিজেডে বিদেশি কম্পানিগুলো বিনিয়োগে আগ্রাহ হারাচ্ছে। সুতরাং এসব প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় কাজ করার জন্য রাজধানীর সঙ্গে জরুরি যোগাযোগ দরকার পড়ে। বিমানবন্দরটি চালু থাকলে এ কাজগুলো সহজ হতো।
ঈশ্বরদী বিমানবন্দরের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্টেশন ম্যানেজার সেতাফুর রহমান জানান, দেশের কোনো বিমানবন্দরই বন্ধ নেই। বিমান ওঠানামা না করলেও কাগজে-কলমে চালু রয়েছে। ঈশ্বরদী বিমানবন্দরসহ দেশের অন্য বিমানবন্দরগুলো চালুর বিষয়ে বিভিন্ন মহলের জোর দাবি রয়েছে। সরকার ইচ্ছা করলেই চালু করতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.