বাড্ডায় শিশু হত্যা-মৃত্যুদুয়ার থেকে ফেরা মা জানেন না বুকের ধন বেঁচে নেই by এস এম আজাদ

মার সুবর্ণা কোথায়? ওকে দেখি না কেন? আমার সামনে নিয়া আসো।' জ্ঞান ফেরার পর থেকেই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে এভাবে বিলাপ করছেন সন্তানহারা মা রীনা। কাঁদছে সন্তানহারা বাবা ভবদীশ মৃধাসহ স্বজনরাও। বুকে পাথর বেঁধে ভবদীশ স্ত্রীকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছেন, 'সুবর্ণা ঢাকা মেডিক্যালে আছে। ও অসুস্থ, তাই তোমার কাছে আনা যাচ্ছে না।'মৃত্যুর দুয়ার থেকে ভাগ্যক্রমে ফিরে আসা রীনার ধারণা, অভিযুক্ত ঘাতক মানিক ও তার সহযোগী প্রকাশ কেবল তাঁকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েই ক্ষান্ত হয়েছে। পালিয়ে গেছে ভয়ে।


দুই বছরের শিশু স্বর্ণা ও চার বছরের সুবর্ণার ওপরও নির্মম আক্রমণ হতে পারে, তা তাঁর কল্পনায় আসেনি এখনো। তিনি জানেন না, তাঁর বুকের ধন সুবর্ণা আর নেই। ঘাতকরা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।
রাজধানীর মহাখালীতে আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রীনা ও তাঁর ছোট মেয়ে স্বর্ণার শারীরিক অবস্থা কিছুটা উন্নতির দিকে। রীনা জানান, ঘাতকরা তাঁকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার চেষ্টা চালায়। স্বজনদের দাবি, রীনা ও সুবর্ণার মৃত্যু হয়েছে ভেবে ঘাতকরা পালিয়ে যায়। কারণ তারা সাক্ষী রাখতে চায়নি।
সৌভাগ্যক্রমে রীনা বেঁচে গেলেও সুবর্ণাকে আর ফিরে পাওয়া যায়নি। গতকাল বিকেলে স্বজনরা রাজারবাগে কালী মন্দিরের শ্মশানঘাটে সুবর্ণার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করেছে।
এ ঘটনায় ভবদীশ মৃধা গতকাল বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় মামলা করেছেন। বাড্ডা থানার ওসি মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, দুজনকে আসামি করে দায়ের করা মামলায় খুন, গুরুতর জখম ও এক লাখ টাকা চুরির অভিযোগ আনা হয়েছে।
রবিবার মামলা দায়েরের আগেই আটক করা হয় মানিক কুমার দাসকে। গতকাল তাকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তবে জিজ্ঞাসাবাদে মানিক দাবি করছে, হত্যার জন্য সে হামলা চালায়নি। খালার সঙ্গে বাকবিতণ্ডার পর 'মেজাজ খারাপ' হওয়ায় সে কেবল মারধর করেছে। মানিকের সহযোগী প্রকাশকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, রবিবার রাতে রীনা ও স্বর্ণাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে মহাখালীর আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, স্বর্ণা আশঙ্কামুক্ত। রবিবার বিকেলে জ্ঞান ফিরলেও রীনা মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছেন। বারবার চার সন্তানের খোঁজ করছেন। সবার মাঝে সুবর্ণাকে না দেখে বারবার তিনি মেয়ের কথাই বলছেন।
ওই দিন যা ঘটেছিল
হাসপাতালের বেড়ে শুয়ে গতকাল সোমবার রীনা রানী মৃধা তাঁর ওপর নির্মম হামলার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি জানান, তাঁদের বাসা রাজধানীর উত্তর-পূর্ব বাড্ডার পূর্বাঞ্চলে। রবিবার সকাল ১১টার দিকে তাঁর বোনের ছেলে মানিক ও এক যুবক তাঁদের বাসায় যায়। বাসার একটি অংশ টিনশেড টংঘর ও একটি অংশ পাকা। বাসায় যাওয়ার পথে সাঁকো দেওয়া। টিনশেড ঘরের একটি কক্ষে বিছানায় স্বর্ণা ও মেঝেতে সুবর্ণা খেলছিল। অতিথিদের তিনি মুড়ি ও কলা দিয়ে আপ্যায়ন করেন। একপর্যায় তিনি পাকা ভবনে গেলে দরজা বন্ধ করে হঠাৎ আক্রমণ করে মানিক ও তার সহযোগী। তারা রীনার গলা টিপে ধরে মারধর করতে থাকে। ঘরে রাখা একটি কুঠার দিয়ে মাথায় আঘাত করে। এতে অচেতন হয়ে পড়েন রীনা। একপর্যায়ে জ্ঞান ফিরলে দেখেন গলায় কাপড় বেঁধে জানালার গ্রিলের সঙ্গে তাঁকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। প্রাণপণ চেষ্টা করে নিজের গলা থেকে ফাঁস খোলেন। তখন শরীরে আর শক্তি ছিল না। তাঁর রক্তে ঘরের মেঝে ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু ওই সময় বাসায় মানিক ও প্রকাশ ছিল না। এক সময় সুস্মিতা ও সুমা স্কুল থেকে ফিরে ওই অবস্থায় তাঁকে দেখতে পায়।
স্বামী ভবদীশ জানান, ঘাতকরা ভেবেছিল রীনা মারা গেছে। গলায় ফাঁস দেওয়ার কারণে তাঁর গলা এখনো ফুলে আছে। মানিককে চার বছরের সুবর্ণা চিনে। ঘটনার সময় হয় তো সে কান্নাকাটি করেছে, এ জন্য মাথায় আঘাত করে পরে পাতিলের পানিতে ডুবিয়ে শিশুটিকে হত্যা করে পাষণ্ডরা। কান্নাকাটি করায় স্বর্ণাকেও তারা ছুড়ে মারে। এতে শিশুটির নাক-মুখ ফেটে যায়। তিনি আরো জানান, ঘটনার পর মানিক ও প্রকাশ সাঁতারকূলের রাস্তা দিয়ে পালিয়ে যায়।
ঘাতকদের পরিচয়
মানিক রীনার বোন মীনার বড় ছেলে। বাড়ি মুন্সীগঞ্জের মাকহাটিতে। দুই বছর আগে মীনার স্বামী অধির মারা যান। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে বড় মানিক বখাটে স্বভাবের। বোনের কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে রীনা মানিককে তাঁদের বাসায় নিয়ে আসেন। স্বামী ভবদীশের সঙ্গে কাঠমিস্ত্রির কাজেও লাগিয়ে দেন। এরই মধ্যে মানিকের চোখ পড়ে রীনার স্কুলপড়ুয়া মেয়ে সুস্মিতার দিকে। ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী সুস্মিতাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে রাগ করে মানিককে বাসা থেকে চলে যেতে বলেন রীনা ও ভবদীশ। ওই ঘটনার জের ধরেই সে সহযোগীকে নিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এর আগে সে অজ্ঞান মোবাইল ফোনে ভবদীশকে একাধিকবার হুমকিও দিয়েছে।
জানা গেছে, মানিকের সহযোগী প্রকাশ তার সঙ্গেই কাঠমিস্ত্রির কাজ করে। বাড়ি মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায়। তার বাবার নাম লক্ষণ দাস।
প্রসঙ্গত, ঘটনার দিন রাতেই পুলিশ রীনার কাছ থেকে তথ্য পেয়ে অভিযুক্ত মানিককে গ্রেপ্তার করে।

No comments

Powered by Blogger.