রানের পাহাড় গড়ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ by সঞ্জয় সাহা পিয়াল

প্রতীকীই বটে। আহত বক ছানাটিকে কী মনে করে যেন মিরপুরের খেলার মাঠেই মুখ থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে যায় দুষ্ট চিলটি। এরপর গ্রাউন্ডসম্যানরা অনেক চেষ্টা করেছিলেন বক ছানাটির প্রাণ বাঁচাতে; কিন্তু পারেননি। শেষ বিকেলে মৃত্যু হয় হতভাগ্য ওই ছানাটির। ঢাকা টেস্টে বাংলাদেশের অবস্থাও ওই বক ছানার মতো। শেষ বিকেলে ব্রাভোর অশ্রুভেজা সেঞ্চুরিতে এ টেস্টে বাংলাদেশের আহত আশাগুলোর অপমৃত্যু হয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় ইনিংসের রান এখন ৩ উইকেটে ২০৭; কিন্তু প্রথম ইনিংসে ১২৪ রানের দেনা থাকায় মুশফিকদের কাঁধে এখন ৩৩১ রানের বোঝা।


হাতে এখনও ৭ উইকেট নিয়ে চোখ রাঙাচ্ছে ক্যারিবীয়রা। কে জানে, রানের এ পাহাড়ের চূড়া কোথায় গিয়ে দাড়ি টানে। কিস্তি শোধ করার পর এই দেনা
পরিশোধ করার মতো ক্ষমতা কি আছে মুশফিকদের? দিন শেষে ক্লান্ত আর হতাশ মুখগুলোর সামনে এ প্রশ্ন করার মতো অবস্থা ছিল না। তাই কোচ স্টুয়ার্ট ল নিজেই উত্তরটি দিলেন_ 'আমরা আমাদের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারিনি। চেয়েছিলাম ১৩০ ওভার পর্যন্ত ব্যাট করতে। অথচ ...। এখন যে অবস্থা তাতে বলা যায়, বিপক্ষ দলের হাতে ঢাকা টেস্টের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। হয়তো আমাদের সামনে চারশ' থেকে সাড়ে চারশ' টার্গেট সেট করবে তারা।' কোচ শঙ্কিত, কখন এই নিয়ন্ত্রণ ছাড়বে ক্যারিবীয়রা। কেননা এখনও তাদের হাতে ৭ উইকেট রয়েছে। আজ লাঞ্চ অবধি নিশ্চয়ই বাংলাদেশের ছেলেগুলোকে মাঠে ছোটাছুটি করিয়ে ক্লান্ত করবে।
আসলে তৃতীয় দিন শেষে ঢাকা টেস্টের পাণ্ডুলিপি যতটুকু লেখা হয়েছে তাতে বাংলাদেশের কেউ নায়ক কিংবা পার্শ্বচরিত্রেও ছিলেন না। সকালের নায়ক ছিলেন দেবেন্দ্র বিশু। দুুপুরে ব্রাভো আর কির্ক অ্যাডওয়ার্ড। আর সারাদিনই বাংলাদেশিদের কাছে খলনায়ক ছিলেন মিরপুরের ৩ নম্বর উইকেট আর আম্পায়ার নাইজেল লং। যিনি কি-না নিশ্চিত কিছু এলবিডবি্লউর আবেদন দাঁত বের করে হাসতে হাসতে 'না' বলে দিয়েছেন। তবে বিদেশি আম্পায়ারের ওপর ক্ষোভ করা যায়; কিন্তু অভিমান করা যায় কেবল নিজেদের পিচ নিয়ে।
সকালে দেবেন্দ্র বিশু আর স্যামুয়েলসের ঘূর্ণিতে এক ঘণ্টার বেশি দাঁড়াতে পারেননি নাসিররা। কথা ছিল, নাসির আর শুভ মিলে প্রথম সেশনটা কাটিয়ে দেবেন; কিন্তু কোথায় কী! বিশুর এক্সট্রা বাউন্সে ধোঁকা খেয়ে শর্ট লেগে ক্যাচ দিয়ে শুভ ফিরে যান মাত্র ১৫ রান করে। এরপর শাহাদাত হোসেন রাজিবের ওপর খুব বেশি ভরসা রাখতে পারেননি নাসির। স্যামুয়েলসকে চালাতে গিয়ে ডিপ মিড উইকেটে কির্ক অ্যাডওয়ার্ডের হাতে ক্যাচ দিয়ে তার ৪২ রানের সম্ভাবনাময় ইনিংসটির যবনিকা টানেন। এরপর রাজিবকে কুইকার দিয়ে বোল্ড করতে বিশুর দুই ওভারের বেশি লাগেনি। আগের দিনের ৭ উইকেটে করা ২০৪ রানের বাসি ইনিংসটি গতকাল থেমে যায় ২৩১ রানেই।
সকালে বিশুকে দেখে মনে করা হয়েছিল সাকিব, নাসির আর শুভর হাতেও বল ঘুরবে; কিন্তু কোথায় কী, তাদের কেউ উইকেট থেকে টার্ন পেলেন না। প্রথম ওভারেই নাঈম ইসলাম ডাঙ্গুলির টিপ মেরে ব্রাথওয়েটকে রান আউট করেছিলেন। ৩ ওভার পর্যন্ত শূন্য রানে ১ উইকেট পর্যন্ত চলছিল। মাঠেও একটা গরম-গরম ভাব ছিল; কিন্তু একশ'র বেশি লিড নিয়ে ক্যারিবীয়রা বাংলাদেশিদের মতো টি২০ খেলতে যায়নি। মাথা ঠাণ্ডা করে ব্যাট করছিলেন কির্ক আর পাওয়েল। এর মাঝে পাওয়েল সাকিবকে চালাতে গিয়ে মিড অনে নাসিরের হাতে ক্যাচ দিয়ে বসেন। ৩৩ রানে ২ উইকেট, মনে হচ্ছিল মুশফিকের আগের দিন বলা কথাগুলোই মিলে যাবে; কিন্তু কে জানত এ সিরিজে অফ ফর্মে থাকা ড্যারেন ব্রাভো শান্ত হয়ে ছুরি চালাবেন মিরপুরের বুকে, তৃতীয় উইকেট জুটিতে ১৫১ রান করবেন। কেউ কি ভেবেছিলেন, তৃতীয় দিন বাংলাদেশি স্পিনারদের সামনে উইন্ডিজের কোনো জুটি ৪৭.১ ওভার পর্যন্ত খেলতে পারবে। অনেক না-ভাবা ব্যাপারই এদিন একে একে বাস্তব রূপ নিয়েছে।
এর মধ্যে গোটা কয়েক ক্যাচ মিস ছাড়াও আম্পায়ারের নিষ্ঠুর হৃদয় পুরো টেস্ট থেকেই বাংলাদেশকে একটু একটু করে দূরে ঠেলে দিয়েছে। যে ব্রাভো এদিন তার ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পেয়ে কেঁদে ফেললেন, সেই ব্রাভোই ৪৬ রানের মাথায় সাকিবের বলে ব্যাট ছুঁয়ে জিভ কেটেছিলেন; কিন্তু সে ক্যাচ ধরতে পারেননি মুশফিক। একই ওভারে প্রথম স্পেলে শাহরিয়ার নাফীসের হাতেও একটি ক্যাচ দিয়েছিলেন। সেটাও হাতে তুলতে পারেননি নাফীস। হতাশার শেষ এখানেই নয়, ৬১ রানে থাকার সময় ব্রাভো আরও একবার স্লিপে বল তুলেছিলেন, সেবার মিস করেন ইমরুল কায়েস। এরপর ৭২ রানে থাকা ব্রাভোর বিপক্ষে নাঈম ইসলামের সঙ্গে মাঠের সবাই জোরাল একটি এলবিডবি্লউর আওয়াজ তুলেছিলেন। সেটিও হেসে হেসেই নাকচ করে দেন ইংলিশ আম্পায়ার নাইজেল। আর দিন শেষ হওয়ার একটু আগে সোহরাওয়ার্দী শুভ ব্রাভোর পা যেভাবে উইকেটের সামনে পেয়েছিলেন, তাতে ব্যাটসম্যানও যখন ঘাবড়ে গিয়েছিলেন, তখন নাইজেল সেই পুরনো শুকনো হাসিই হেসেছেন। টেলিভিশন রিপ্লেতে পরিষ্কার দেখা গেছে ৯৭ রানে থাকা ব্রাভো আউট ছিলেন।
সারাদিন না পাওয়ার মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য হলেও শুভর বলে কির্ক অ্যাডওয়ার্ডের বোল্ড হওয়ার দৃশ্যটি উপভোগ করেছে মিরপুরের গ্যালারি। পয়েন্টে দাঁড়িয়ে নাসির হোসেনের দুর্দান্ত কিছু সেভ করা দেখেও হাততালি পড়েছে। আর সাকিব মিড অনে দাঁড়িয়ে কির্ক অ্যাডওয়ার্ডের যে ক্যাচটি এক হাতে নিয়েও থার্ড আম্পায়ার ডাকতে বললেন, তা দেখে ধারাভাষ্যকার রুম থেকে ইয়ান বিশপও বলেছেন_ 'ছেলেটি সৎ'। ক্রিকেট মাঠে সৎ হওয়াটা বাড়তি গুণ হতে পারে; কিন্তু লড়াইয়ে নেমে আরও অনেক কিছুই দরকার হয়। যেটা প্রথম ইনিংসে ৫৯ রানে ৫ উইকেট পড়ার পর মুশফিকরা ভালোভাবেই টের পাচ্ছেন।

No comments

Powered by Blogger.