ব্রাভোর চেহারায় লারাকে দেখল ঢাকা by নোমান মোহাম্মদ

হাতা গুটিয়ে সেই রাজসিক ভঙ্গিতে ক্রিজের দিকে হেঁটে যাওয়া। অবিকল সেই স্টান্স। হুবহু ব্যাক লিফট। বলে ব্যাট ছোঁয়ানোর আগে শেষ মুহূর্তের ছোট্ট লাফটিও যেন কার্বনকপি। এখানেই কি শেষ? তাঁর ঝলমলে কাভার ড্রাইভ, দৃষ্টিনন্দন স্কয়ার কাট, আসুরিক পুল-হুকে দৃষ্টি চলে যায় অতীতে। ক্রিকেট রোমান্টিকরা বারবার বুঁদ হয়ে যান নষ্টালজিয়ায়। এই ড্যারেন ব্রাভো যে কিংবদন্তি ব্রায়ান লারারই জাতিস্মর!দুজনই ত্রিনিদাদিয়ান। সম্পর্কে দূর সম্পর্কের মামা-ভাগ্নে। তাই বলে এতটা মিল কী করে সম্ভব! বিশেষত লারার ব্যাটিং স্টাইলটা যখন ঠিক ব্যাকরণের বই থেকে উঠে আসা প্রথাগত নয়। আর এটি এমন ব্যাপারও নয়, যা অনুশীলনে রপ্ত করা সম্ভব।


ড্যারেন ব্রাভোর ব্যাটিংয়ের ধরন যে লারার ক্লোন, সেটি তাই সহজাতই। ক্যারিয়ারের উষালগ্নে সেটি যেমন অনেক বড় প্রেরণা হতে পারে, কখনো-সখনো উল্টো চাপ হয়েও ধরে চেপে। প্রেরণার আলোয় বিচ্ছিন্ন দু-একটি ঝলক ছিল বটে, তবে চাপে পড়েই কিনা সামগ্রিক অর্থে লারার কীর্তির ধারে-কাছে যাওয়ার ইঙ্গিতের বড্ড অভাব ড্যারেন ব্রাভোর মাঠের পারফরম্যান্সে!
বাংলাদেশ সফরে এসে টোয়েন্টি টোয়েন্টি, ওয়ানডে এবং কালকের আগ পর্যন্ত টেস্ট সিরিজেও অব্যাহত সেই ধারা। বিবর্ণ, ম্রিয়মাণ। বিখ্যাত পূর্বসূরির প্রলম্বিত ছায়ায় ঢাকা পড়ার উপক্রম! সেখান থেকে কী অপূর্বভাবেই না বেরিয়ে এলেন কাল। চোখধাঁধানো অভিষেক টেস্ট সেঞ্চুরিতে। লারার ধ্রুপদী ব্যাটিংয়ের প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকা শৈল্পিক এক ইনিংসে। তাতে হয়তো বাংলাদেশ ম্যাচ থেকে ছিটকে গেল। পাশাপাশি স্বাগতিকরা দীর্ঘ এক পথচলার প্রথম বড় পদক্ষেপের সাক্ষীও হয়ে রইল হয়তো বা।
বাংলাদেশ সফরে ব্রাভোর আগের ইনিংসগুলো ছিল ৭, ২০, ১*, ০, ২, ২৪* ও ১২ রানের। লারার সঙ্গে তুলনাকে হাস্যাস্পদ করার জন্য সম্ভাব্য সবই করেছেন তিনি। তাই নিজেকে প্রমাণের পণ নিয়ে হয়তো মাঠে নেমেছিলেন কাল। ক্রিজে যখন যান, দলের অবস্থা বেশ নড়বড়ে। ১৭.৪ ওভারে ৩৩ রানে ২ উইকেট হাওয়া। দলের নাজুক অবস্থা, ব্যাট হাতে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন_এমন সময় খোলের ভেতর গুটিয়ে যাওয়াই ছিল স্বাভাবিক। ব্রাভো এসে শুরু করলেন উল্টো আক্রমণ। দ্বিতীয় বলে সাকিবকে সোজা তুলে দিয়ে চার। এ বাঁহাতি স্পিনারের পরের ওভারে লং অনের ওপর দিয়ে ছয়। এরপর নাসিরের এক ওভারে লং অন ও কাভার দিয়ে দুটো বাউন্ডারি এবং মিড উইকেটের ওপর দিয়ে আরেকটি ছক্কা। হ্যারিকেনের গতিতে ২২ বলে ২৫ রানে চলে যান ব্রাভো। এই যে উইকেটে সেট হয়ে গেলেন, আর টলানো যায়নি তাঁকে।
তাই বলে নির্বোধের মতো বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের অনুসরণ করেননি ব্রাভো। থিতু হয়ে যাওয়ার পর তাড়াহুড়ো না করে খেলেছেন বিচক্ষণের মতো। ফিফটির আগে তাই আর মাত্র একটি বাউন্ডারি। দিনের শেষ বলে সোহরাওয়ার্দী শুভকে কাট করে ২ রান নিয়ে যখন ছুঁয়ে যান তিন অঙ্কের জাদুকরী সংখ্যা, ততক্ষণে ১৬৩ বল খেলা সারা ব্রাভোর। ২২৩ মিনিট স্থায়ী ইনিংসে সাতটি বাউন্ডারি ও দুটি ওভার বাউন্ডারি। যথার্থ টেস্ট ইনিংসের মতো ১০৭টি ডট বল, ৩৮টি সিঙ্গেলস এবং ১১টি ডাবলসে সাজানো তাঁর ইনিংস। বাংলাদেশের সব বোলারকে সামলেছেন পেশাদারি দক্ষতায়। রুবেলের ১৭ বলে ৮, নাসিরের ২৬ বলে ১৮, সাকিবের ৩৭ বলে ৩৪, নাঈমের ১০ বলে ৫, সোহরাওয়ার্দীর ৫২ বলে ২১, শাহাদাতের ১০ বলে ৮ এবং রকিবুলের ১৩ বলে ৬ রান নিয়েছেন। ইনিংসে খুঁত বলতে সাকিবের বলে দুবার তাঁর ক্যাচ পড়া। প্রথমবার মুশফিকুর রহিম এবং এক বল পর স্লিপে দাঁড়ানো ইমরুল কায়েসের সৌজন্যে তাঁর বেঁচে যাওয়া।
সেঞ্চুরি পূর্ণ করার পর পরই মাঠে বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি বলে কথা। 'দুজনকে আজ আমি খুব মিস করছি। আমার বাবা ও মা। এই সেঞ্চুরিটি আমি তাঁদের উৎসর্গ করলাম'_দিন শেষের সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন ব্রাভো। নার্ভাস নাইনটিজে নির্ঘুম রাত কাটাতে না হওয়ায় কিছুটা স্বস্তিতে থাকার কথা তাঁর। মুখে অবশ্য তা স্বীকার করছেন না, 'দিন শেষে সেঞ্চুরি করতে পেরে আমি আনন্দিত। তার মানে এই নয় যে আজই তিন অঙ্কে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ছিলাম। সঠিক বলের অপেক্ষায় ছিলাম আমি। সেটি ছিল ব্যাক অব লেন্থ ডেলিভারি। আমি সেটি ভালোই খেলেছি। ভেবেছিলাম ওটি বাউন্ডারি হয়ে যাচ্ছে, তাই আগে থেকেই উল্লাস শুরু করেছি।' সিরিজের প্রথম বড় স্কোর করার পর নিজের সামর্থ্যে আস্থা রাখার কথা জানিয়েছেন এ বাঁহাতি, 'আমি জানতাম বিশেষ কিছু থেকে আমি খুব দূরে নেই। নিজের ওপর আমার সব সময়ই বিশ্বাস ছিল। যে কঠোর পরিশ্রম করেছি, সেটির সুফল পাওয়ায় আমি খুব খুশি। ভালো একটা শুরুর জন্য আমি মুখিয়ে ছিলাম। কিন্তু সেটি খুব একটা কাজে আসছিল না। এবার ভাবলাম আক্রমণই হোক রক্ষণের শ্রেষ্ঠ উপায়। হলোও তাই।'
অভিষেক টেস্ট সেঞ্চুরির আগে ৯ টেস্টে ৬টি হাফ সেঞ্চুরি ছিল তাঁর। কাঙ্ক্ষিত সেঞ্চুরি পেয়ে যাওয়ায় লারার প্রথম সেঞ্চুরির সঙ্গে তুলনাও এল সংবাদ সম্মেলনে। সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ধ্রুপদী ২৭৭ রানের প্রসঙ্গে খুব একটা গেলেন না ব্রাভো। তবে ওই কিংবদন্তি যে তাঁর আদর্শ, সেটি স্বীকারে দ্বিধা নেই ব্রাভোর, 'লারাকে আমি অনেক দেখেছি। সে অবশ্যই আমার রোল মডেল। ওর খেলা দেখতে দেখতে আমি বেড়ে উঠেছি। লারা আউট হয়ে গেলে টিভি বন্ধ করে বাইরে নিজে খেলতে চলে যেতাম। তবে সত্যি বলতে, এটিই আমার সহজাত ব্যাটিং। আমি ক্রিজে গিয়ে নিজের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশই কেবল করি।' তা যাই করুন, লারার সঙ্গে তুলনা তো আসবেই। সেটি কি কখনো-সখনো বোঝা হয়ে যায় না? ডাউন দ্য উইকেটে এসে প্রশ্নটি উড়িয়ে দিলেন ব্রাভো, 'এ প্রশ্ন যে কতবার আমাকে শুনতে হলো। যখন আমি রান করি, তখন এটিকে কারো কাছে চাপ মনে হয় না। ব্যাটের রান শুকিয়ে গেলেই কেবল ওই চাপের প্রশ্নটি উঠে যায়।'
কে জানে, হয়তো প্রশ্নটি আর কখনো তেমনভাবে উঠবে না। কালকের ব্যাটিংয়ের ধারাটি কেবল ধরে রাখতে পারলেই হয়! জাতিস্মরে ভর করে তাহলে বেঁচে থাকবেন ব্রায়ান চার্লস লারা!

No comments

Powered by Blogger.