সরকারের জনপ্রিয়তার নিম্নমুখী পারদ ও ব্যর্থ ইসির তৃপ্তির ঢেঁকুর by এম আবদুল্লাহ

রকারের জনপ্রিয়তার পারদ যে কতটা নিচে নেমে গেছে, ব্যালটে তার দালিলিক প্রমাণ পাওয়া গেল রাজধানীর উপকণ্ঠে বন্দর নগরী নারায়ণগঞ্জে। ভোটাররা স্বাধীনভাবে রায় দেয়ার ন্যূনতম সুযোগ পেলে সরকার সমর্থিতদের যে কত দূরে ছুড়ে ফেলতে পারে তা সাম্প্রতিক আরও কয়েকটি নির্বাচনে দেখা গেছে। এক সপ্তাহ আগে অনুষ্ঠিত গাজীপুরের কালিয়াকৈর ও কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া পৌরসভার মেয়র নির্বাচনের সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের আশীর্বাদ এবং সরকারি দলের কেন্দ্রীয় ও অঙ্গসংগঠনের নেতাদের মরিয়া প্রচারণাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে শামিম ওসমান শীতলক্ষ্যায় ডুবেছেন।


এখন শামীম ওসমানের সমর্থকরাও বলছেন, সরকার প্রকাশ্যে সমর্থন না দিলে ভোটের ব্যবধান আরও কম হতো। সরকারের পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতায় পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ব্যালটে ঝেড়েছে নারায়ণগঞ্জবাসী। সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ফলাফল হিসেবে বিশাল বিজয় পেয়েছেন ডা. আইভী। সরকারের সরাসরি সমর্থিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগেরই অপেক্ষাকৃত ক্লিন ইমেজের আইভীকে মন্দের ভালো হিসেবে বেছে নিয়েছে ভোটাররা।
রোববারের নির্বাচনের ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) প্রতিও ভোটারদের একটি বড় অংশের অনাস্থা ও অবিশ্বাস প্রকাশ পেয়েছে। খোদ সরকারদলীয় প্রার্থী শামীম ওসমান অভিযোগ করেছেন—তার মার্কা দেয়াল ঘড়িতে ভোট দিলে তা চলে গেছে আইভীর দোয়াত কলমে। অনেক বয়স্ক ভোটার দারুণভাবে ভয় পেয়েছেন মেশিনে ভোট দিতে গিয়ে। তারা সংশয় প্রকাশ করে বলেন, ভোট যে মার্কায় দিলাম সে মার্কায় যোগ হলো কি না নিশ্চিত তো হতে পারলাম না। তাছাড়া নারায়ণগঞ্জের সদ্যসমাপ্ত নির্বাচন নিয়ে বড়াই করার মতো কোনো কৃতিত্ব নির্বাচন কমিশনের আছে কি না, সে ব্যাপারেও প্রশ্ন উঠেছে। এ নির্বাচনে চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। দলীয় সরকার সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতায় যে থোড়াই কেয়ার করে, তা-ও স্পষ্ট হয়েছে। নায়ায়ণগঞ্জে বিপুলসংখ্যক র্যাব-পুলিশ মোতায়েন করে সম্ভাব্য গোলযোগ এড়াতে পেরে কমিশন যে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে তারও কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। কারণ জাতীয় নির্বাচনে সারাদেশে একসঙ্গে এত র্যাব-পুলিশ মোতায়েনের কোনো সুযোগ নেই।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচন রাজনীতিতে যতটা উত্তাপ ছড়াতে পারত ততটা ছড়ায়নি। ভোটের আগের দিন মধ্যরাত পর্যন্ত উত্তাপ-উত্তেজনায় কাঁপছিল নারায়ণগঞ্জ। শনিবার রাত ১টার পর দৃশ্যপট বদলে যায়। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশের অনুপস্থিতি এবং নির্বাচন কমিশন প্রতিশ্রুত সেনা মোতায়েন না হওয়ায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিলে গোটা নির্বাচন হয়ে পড়ে একতরফা। রোববার ভোটের লড়াই চলাকালে সারাদেশের রাজনৈতিক সচেতন মানুষের আগ্রাহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার কথা নাসিক নির্বাচন। দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশনায় তৈমূর আলমের বর্জনের ফলে দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত আওয়ামী লীগ নেত্রী ডা. সেলিনা হায়াত্ আইভীর বিজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। এতে ফলাফল নিয়ে মানুষের আগ্রহে অনেকটাই ভাটা পড়ে। কিন্তু সরকার সমর্থিত প্রার্থী শামীম ওসমান লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানের বিশাল পাহাড়ের নিচে এভাবে চাপা পড়বেন, এমনটা বোধহয় অনেকেই ধারণা করতে পারেননি। বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার মাঠে থাকলে সরকারি প্রার্থী শামীম ওসমান এবং প্রশাসনকে ভিন্ন চেহারায় দেখা যেত বলেও মনে করছেন অনেকে। একতরফা নির্বাচনে সেমসাইড হওয়ার আশঙ্কায় ওই পথে পা বাড়াননি তারা। লড়াইয়ে থাকা প্রধান দুই প্রার্থীর যে-ই জিতুক দলের বাইরে যাচ্ছে না—এমন সান্ত্বনায় সরকারের পক্ষ থেকেও হস্তক্ষেপ হয়নি বলেই মনে করেন পর্যবেক্ষক মহল।
অতীতের বিভিন্ন নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জনসমর্থন প্রায় সমানে সমান। দু’দলেরই রিজার্ভ ভোট প্রায় ৪৫ শতাংশ করে। বাকি ১০ শতাংশ পরিবর্তনশীল। এরা জোয়ারের সঙ্গে যে কোনো দিকে ঝুঁকে পড়ে। রাজধানীর মতো নারায়ণগঞ্জের সংসদীয় আসনগুলোও দেখা গেছে সরকারি দলের ঘরে যায়। অর্থাত্ এসব আসনে যে দল জেতে তারাই সরকার গঠন করে। রোববারের নির্বাচনে প্রায় ৭০ শতাংশ ভোট পড়েছে। অর্থাত্ আওয়ামী লীগের পুরো ৪৫ শতাংশ ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে, ধরে নিলেও আরও প্রায় ২৫ শতাংশ ভিন্নমতের ভোট পড়েছে। এদের একটি বড় অংশ বিএনপির। বর্জন সত্ত্বেও বিএনপি নেতা-কর্মী-সমর্থকরা সরকারের দুঃশাসন ও সরকারি দলের গডফাদার-চাঁদাবাজ ঠেকাতে আইভীকে ভোট দিয়েছে বলে নিশ্চিতভাবে মনে করা হচ্ছে। তৈমূর আলম খন্দকার মাঠে থাকলে প্রদত্ত ভোটের হার ৯০ শতাংশ ছুঁত। সেক্ষেত্রে মূল লড়াইটা হয়তো আইভী ও তৈমূরের মধ্যেই সীমিত হয়ে যেত। তৈমূর মাঠে থাকলেও শামীম ওসমানের ভোট বাড়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না।
অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পর নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষাপটে নারায়ণগঞ্জে শামীম ওসমানের ভরাডুবি দৃশ্যত ক্ষমতাসীন দলের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা হিসেবেও দেখছেন কেউ কেউ। সরকারি শিবির থেকেই বলা হচ্ছে নায়ারণগঞ্জের নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী আইভীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে সরকারের একটা বড় শিক্ষা হয়েছে। এ ভুল থেকে আওয়ামী লীগের শিক্ষা নেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তারা।
এদিকে সেনা মোতায়েন নিয়ে সরকারের বৈরী সিদ্ধান্তে দৃশ্যত ক্ষুব্ধ প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা এখন সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেয়ার বড়াই করলেও দলীয় সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্ব উলঙ্গভাবে প্রকাশ পেয়েছে নাসিক নির্বাচনে। নির্বাচন কমিশনাররা যতই বাগাড়ম্বর করুন না কেন, তারা যে ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার তা বারবার প্রমাণ হচ্ছে। একটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন রাষ্ট্রক্ষমতা নির্ধারণের নিয়ামক নয়। সেক্ষেত্রেও সরকার নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক অধিকারের বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ করেনি। আর যে জাতীয় নির্বাচনে ৫ বছরের জন্য গোটা রাষ্ট্রক্ষমতা নির্ধারিত হবে, সেক্ষেত্রে দলীয় সরকার নির্বাচন কমিশনকে অবাধ ক্ষমতাচর্চা করতে দেবে, তার গ্যারন্টি পাওয়ার বিষয়টি অবান্তর। সরকার নির্বাচন কমিশনের চাহিদামত সেনা মোতায়েন না করে কেন সংবিধান লঙ্ঘন করল সে বিষয়ে সরকারের ব্যাখ্যা চাইবে বলে সিইসি যে ঘোষণা দিয়েছেন তা জানার অপেক্ষায় থাকবে জনগণ।
পর্যবেক্ষক মহলের মতে শেষ মুহূর্তে বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে না দাঁড়ালে এবং ফলাফল অন্যরকম হলে সেনা মোতায়েন না করার বিষয়টি গোটা নির্বাচনকেই বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ফেলে দিতে পারত।
যদিও বর্তমান নির্বাচন কমিশন যে সরকারের অজ্ঞাবহ হিসেবে বরাবরই ভূমিকা রেখে আসছে সে ব্যাপারে জনমনে বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে। সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও স্বশাসিত সংস্থা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ড. এটিএম শামসুল হুদার নিয়োগের পর এটি সরকারের একটি আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। জরুরি অবস্থার সরকারের সময় কমিশন রাজনৈতিক দল ভাঙা এবং বিশেষ করে বিএনপিকে ধংসের সব রকম উদ্যোগ আয়োজন করেছে কোনো রাখ-ঢাক ছাড়াই। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরও কমিশন সরকারের প্রতি নতজানু ভূমিকা রেখে চলেছে। এর আগে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের উদ্যোগ নেয় নির্বাচন কমিশন। সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন পিছিয়ে দিতে বলার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশনও তা পিছিয়ে দেয়। তারও আগে ভোলার উপ-নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিরোধিতা করে সরকার। নির্বাচন কমিশন সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সেনা মোতায়েন থেকে বিরত থাকে।

No comments

Powered by Blogger.