পশুবাহী ট্রাকে ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি : বেহাল রাস্তায় যানজটে দুর্ভোগ বেপারি ও ট্রাকচালকদের by আলাউদ্দিন আরিফ

কোরবানির পশুবাহী ট্রাকগুলোতে ঘাটে ঘাটে চলছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। এবার স্থানীয় মাস্তানদের পাশাপাশি পুলিশই বেশি চাঁদাবাজি করছে বলে অভিযোগ করেছেন গবাদিপশু ব্যবসায়ী ও ট্রাকচালকরা। কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা বা রাজশাহী থেকে গাবতলী পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রতিটি ট্রাককে কমপক্ষে ১০টি পয়েন্টে কমবেশি চাঁদা দিতে হচ্ছে। চাঁদার পরিমাণ ট্রাকপ্রতি এক থেকে আড়াই হাজার টাকা। এর মধ্যে সর্বাধিক চাঁদা দৌলতদিয়া ও পাটুরিয়া ঘাটে। এই বেপরোয়া চাঁদাবাজির প্রভাব পড়ছে গবাদিপশুর দামের ওপর। এছাড়াও বেহাল রাস্তার কারণে অসহনীয় যানজটে দুর্ভোগ পোহাতে


হচ্ছে ট্রাকচালক ও গবাদিপশুর বেপারিদের। গতকাল ঢাকার গাবতলী হাটে গরুর বেপারি, ট্রাকের মালিক, চালক ও হেলপারদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে।
গবাদিপশুবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার গতকাল আমার দেশকে বলেন, কোরবানির পশুবাহী গাড়িতে চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে পুলিশ। চাঁদাবাজিসহ যে কোনো ধরনের অনিয়ম রোধে রাস্তায় টহল জোরদার করা হয়েছে। যেসব পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। দৌলতদিয়া, পাটুরিয়াসহ কয়েকটি পয়েন্টে বেপরোয়া চাঁদাবাজির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে তিনি তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নেবেন। যার বিরুদ্ধেই অভিযোগ পাওয়া যাবে, তার বিরুদ্ধেই কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
কুষ্টিয়া ট-১১-১২৩৯ গাড়িটি গতকাল কুষ্টিয়া সদর থেকে গরু নিয়ে গাবতলী পৌঁছে বেলা ৩টায়। গাড়ির চালক জমির উদ্দিন জানান, প্রায় ১৮শ’ টাকা তাকে চাঁদা বাবদ গুনতে হয়েছে। এর মধ্যে দৌলতদিয়ায় ট্রাফিক পুলিশকে ২৫০ টাকা ও আরিচাঘাটে ৭০০ টাকা দিতে হয়েছে। এছাড়া দৌলতদিয়া ঘাটে সিরিয়াল দেয়ার জন্য বাড়তি টাকা (জিপি) নিয়েছে স্থানীয় মাস্তানরা। তিনি বলেন, এবার হাইওয়ে পুলিশ চাঁদাবাজি করছে না। তারা বরং কোরবানি পশুবাহী ট্রাকগুলো নিরাপদে পারাপারে সহযোগিতা করছে।
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থেকে গরু নিয়ে গাবতলী আসে ঝিনাইদহ ট-১১-০৮৩২ গাড়িটি। গাড়ির চালক জানান, কমপক্ষে ১০টি পয়েন্টে তাকে ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৭০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়েছে। দৌলতদিয়া ঘাটে ফেরি পারাপারে নির্ধারিত ফি ৯৭০ টাকা। অথচ তার কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে ১৪০০ টাকা। অর্থাত্, বেশি নেয়া হয়েছে ৪৩০ টাকা। পাটুরিয়া ঘাটে ফেরি থেকে নামার পর ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট গাড়িটি আটকে দেয়। সেখানে ক্লিয়ারেন্সের নামে আদায় করা হয়েছে ৭০০ টাকা। এছাড়া মাগুরা, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, ধামরাই ও সাভারে ৫০ টাকা করে নেয়া হয়েছে। ওই গাড়ির চালক আরও জানান, দৌলতদিয়া ঘাটে এখন ব্যাপক যানজট। রাস্তা খারাপ হওয়ায় যমুনা সেতু হয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে সমস্যা হয়। ট্রাফিক পুলিশ ও স্থানীয় মাস্তানদের চাহিদামত টাকা না দিলে কোরবানির পশুবাহী গাড়ি ফেরিতে উঠতে দেয়া হয় না, অযথা আটকে রাখা হয়। হয়রানি করায় তারা বাধ্য হয়ে বাড়তি টাকা দিয়ে ফেরি পার হন।
অপর ট্রাকের চালক বাবুল মিয়া জানান, জায়গায় জায়গায় পুলিশ ডাউন (থামানোর নির্দেশ) দেয়। ডাউন দিলেই কমপক্ষে ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করে। টাকা না দিলে বিভিন্ন অজুহাতে রাস্তায় আটকে রাখে, মামলা দেয়, জরিমানা করে। তিনি আরও জানান, ভাঙা রাস্তা ও যানজটের কারণে ৫ ঘণ্টার রাস্তা পাড়ি দিতে তাদের সময় লাগছে ১০ থেকে ১৪ ঘণ্টা।
চুয়াডাঙ্গা ট-১১-০০২৭ ট্রাকের চালক জানান, তারা নিয়মিত ঢাকায় আসেন। তারা ট্রাক চালানোর জন্য মাগুরা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও মাদারিপুরে মাসিক ভিত্তিতে টাকা দেন। যেহেতু তারা মাসে ১০ থেকে ১৫টি ট্রিপ দেন, তাই প্রতিদিন চাঁদা না দিয়ে প্রত্যেক পয়েন্টে মাসিক ২০০ টাকা হারে চাঁদা দেন। ঝিনাইদহের ট্রাকচালক হাবীবুর রহমান জানান, পথে পথে পুলিশ ও মাস্তানদের চাঁদাবাজির কারণে ট্রাক চালানোই দায় হয়ে পড়েছে। পুলিশ ও মাস্তানদের চাঁদা না দিলে তল্লাশির নামে হয়রানি করা হয়। মাদকদ্রব্য তল্লাশির নামে গরু-ছাগল গাড়ি থেকে নামিয়ে ফেলা হয়। ফলে তারা বাধ্য হয়ে চাঁদা দেন। সারাদিন ট্রাক চালিয়ে দেখা যায়, খালি হাতে ঘরে ফিরতে হয়। চালক হাবীব আরও জানান, গরু নামানোর পর তারা খালি ট্রাক নিয়ে ঝিনাইদহে যাবেন। চাঁদাবাজির ভয়ে পাটুরিয়া হয়ে না গিয়ে যমুনা সেতু হয়ে যাবেন। এতে তাদের বাড়তি সময় যেমন লাগছে, তেমনি বাড়তি তেলও পুড়ছে।
ফরিদপুরের ভাঙা থেকে কেওড়াকান্দি মাওয়া হয়ে গরু নিয়ে ঢাকায় পৌঁছান ট্রাকচালক রতন। তিনি জানান, ভাঙা থেকে ২২টি গরুতে ১৮ হাজার টাকা ভাড়া নির্ধারণ করেন। কেওড়াকান্দি ঘাটে ফেরিতে ওঠার জন্য তাকে বাড়তি দিতে হয়েছে ৩০০ টাকা। মাওয়াঘাটে জিপি আদায় করে ২০০ টাকা। যাত্রাবাড়ীতে ট্রাফিক পুলিশ মামলা দেয়ার ভয় দেখিয়ে আদায় করে ৪০০ টাকা। রাজশাহীর গোদাগাড়ী থেকে আসা ট্রাকের চালক মুহিবুর রহমান জানান, প্রায় ৮-১০টি পয়েন্টে চাঁদা দিতে হয়েছে।
ঝিনাইদহের ট্রাকচালক মজিবুর রহমান জানান, রাস্তায় বেপরোয়া চাঁদাবাজির কারণে গরুর দাম বাড়ছে। নির্ধারিত ভাড়া ১৬ হাজারের চাইতে ২ হাজার টাকা বাড়িয়ে ১৮ হাজার টাকা ভাড়া নিতে হচ্ছে। বাড়তি দুই হাজার টাকা ভাড়া নেয়া হচ্ছে চাঁদার জন্য।
ঝিনাইদহের গরুর বেপারি আবদুর রশিদ জানান, মাঝারি আকারের প্রতিটি গরু ঝিনাইদহ থেকে ঢাকায় পৌঁছতে পরিবহন বাবদ খরচ হয় প্রায় ১৮শ’ টাকা। চাঁদাবাজি না হলে পরিবহন বাবদ খরচ কমপক্ষে ৫০০ টাকা কম পড়ত। এরপর হাটে গরু ওঠানোর পর প্রতিদিন একটি গরুর জন্য খরচ হয় ৩০০ টাকা। অথচ সে অনুযায়ী বাজারে গরুর দাম নেই। তিনি আরও জানান, খারাপ রাস্তায় যানজটের কারণে গরু নিয়ে ঢাকায় পৌঁছানো কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত রোববার ফজরের নামাজের পর ঝিনাইদহ সদর থেকে ঢাকায় রওনা দিয়ে দৌলতদিয়া পৌঁছান সকাল ৮টায়। ফেরি পার হয়ে গাবতলী হাটে পৌঁছাতে রাত ৯টা বেজে যায়।
গাবতলী হাটের ইজারাদারের প্রতিনিধি ও পরিচালক মো. সোহেল জানান, হাটের বাইরে রাস্তায় ট্রাকে চাঁদাবাজি হলে তাদের কিছু করার থাকে না। তবে হাটের ভেতর কোনো ধরনের চাঁদাবাজি নেই। পর্যাপ্ত পুলিশি টহলের পাশাপাশি তাদের নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও হাটের গবাদিপশু ও বেপারিদের নিরাপত্তায় কাজ করছে। হাটে টোল আদায়কারী মো. নয়ন মিয়া জানান, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, ফরিদপুর, রাজশাহী, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিপুলসংখ্যক গবাদিপশু গাবতলী হাটে আসে। সব রুটে কিছু কিছু চাঁদাবাজির অভিযোগ তাদের কাছেও আসছে।

No comments

Powered by Blogger.