বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণের চার বছর-সুপ্রিম কোর্টের রায় পুরো কার্যকর হয়নি এখনো-পৃথক সচিবালয় গঠন হয়নি * মামলাজট আগের তুলনায় বেড়েছে * নতুন আদালত ভবন নির্মিত হয়নি * বিচারকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়েনি by এম বদি-উজ-জামান ও আশরাফ-উল-আলম

জ ১ নভেম্বর। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণে চার বছর পূর্ণ হয়েছে গতকাল ৩১ অক্টোবর। তবে এ সময়ের মধ্যে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফলে নিম্ন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি- সব কিছুই সুপ্রিম কোর্র্টের পরামর্শে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে আইন মন্ত্রণালয় তথা নির্বাহী বিভাগ থেকে।নিম্ন আদালতের বিচারকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের বেতন বাড়ানোর বিষয়ে হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়িত হয়নি। নানা সমস্যায় জর্জরিত বিচার বিভাগ।


উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের নেই কোনো নীতিমালা। এ আদালতে বিচারক নিয়োগ হচ্ছে দলীয় বিবেচনায়। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সারা দেশের বিভিন্ন আদালতে প্রায় ২০ লাখ মামলা থাকলেও জট কমাতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক নেই। আদালতে মামলার জট বাড়ছেই। গত চার বছরে মামলা বেড়েছে সাড়ে তিন লাখ। একমাত্র ম্যাজিস্ট্রেট আদালতেই মামলা বেড়েছে দুই লাখের বেশি।
পদোন্নতি, বেতনবৈষম্য দূর করা, নিরাপত্তা, কাজের স্বাধীনতাসহ নানাবিধ অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না হওয়ায় সারা দেশের বিচারকরা ক্ষুব্ধ।
বিচারকরা সরকারের কাছে বিচারপ্রার্থী। কয়েক বছর ধরে সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি জানানো হলেও নিম্ন আদালতের বিচারকদের সমস্যা পুরোপুরি সমাধান করা হয়নি।
এ অবস্থায় প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন বিচার বিভাগের নানা সমস্যার কথা নিজেই স্বীকার করেছেন। তিনি গত ১৪ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিচারকদের এক অনুষ্ঠানে সমস্যার কথা তুলে ধরে তা দ্রুত দূর করার চেষ্টার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, 'বিচার ব্যবস্থায় নানা সমস্যা বিদ্যমান। পৃথক সচিবালয় গঠনে মাসদার হোসেন মামলার রায়ে সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত নিজস্ব সচিবালয় আজও গঠন করা হয়নি।' এ বিষয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও জানান প্রধান বিচারপতি।
দেশের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, মামলাজটের কারণে বিচারপ্রার্থী জনগণ ভোগান্তির শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই বিড়ম্বনা দূর করার জন্য বিচারক ও বিচারালয় বাড়ানো দরকার। পৃথক সচিবালয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিচারকদের বদলি ও পদোন্নতি নিয়ন্ত্রণের জন্য দ্রুত সচিবালয় গঠন করা দরকার।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, চার বছর আগে বিচার বিভাগ স্বাধীন ঘোষণা করা হলেও বাস্তবে আজও তা হয়নি। তিনি বলেন, বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নিম্ন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি ও বদলি সব নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে প্রশাসনের অধীন। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে পদোন্নতি ও বদলি করা হচ্ছে। নিম্ন আদালতের দক্ষ বিচারকদের ডেপুটেশনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে রাখা হয়েছে অবৈধভাবে। তিনি বলেন, দক্ষ বিচারক ও সরকারের আন্তরিকতার অভাবেই বিচার বিভাগে এ অবস্থা বিরাজ করছে।
উল্লেখ্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা করার ঘোষণা দেওয়া হয়।
মামলাজট : ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সময় দেশের সব আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার। ওই সময় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা ছিল পাঁচ লাখ ৬৩ হাজার। বর্তমানে সারা দেশে মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ সাড়ে ১৬ হাজারে। এসময়ে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা বেড়ে হয়েছে সাত লাখ ৭০ হাজার ৮০০। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের বড় উদ্দেশ্য ছিল মামলাজট দূর করে জনগণের ভোগান্তির অবসান করা। কিন্তু ভোগান্তি আরো বেড়েছে।
এজলাস সংকট : নিম্ন আদালতের এজলাসের সমস্যার সমাধান এখনো রয়ে গেছে। ফলে এক এজলাসে ভাগাভাগি করে দু-তিনজন বিচারককে কাজ করতে হচ্ছে। রাজধানী ঢাকার জজ আদালতেই বেশ কয়েকটি এজলাস রয়েছে, যেখানে দু-তিনজন বিচারক সময় ভাগাভাগি করে বিচারকাজ পরিচালনা করেন। বিচারকদের খাসকামরা নেই। স্টোর রুম বা অন্য কোনো কক্ষ খাসকামরা হিসেবে ব্যবহার করছেন তাঁরা।
বৈষম্যমূলক বেতন : গত বছর ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হলেও এখনো স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দেওয়া হয়নি বিচারকদের। স্বতন্ত্র বেতন স্কেল না দেওয়ায় বিচারকদের মধ্যে চরম হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেক বিচারক বলেছেন, বিচারকদের বর্তমান বেতন নিয়ে সৎভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন গঠন করা হয়। এই পে-কমিশনকে সহায়তা করার জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কারিগরি সহায়তা কমিটিও গঠন করা হয়। কারিগরি কমিটির প্রধান ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন রেজিস্ট্রার ইকতেদার আহমেদ। জানা গেছে, এই কারিগরি কমিটি গত মার্চ মাসে বিচারকদের বেতন বাড়ানোর সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
ভারত ও পাকিস্তানের অধস্তন আদালতের বিচারকদের বেতনকাঠামো অনুযায়ী এ দেশের বিচারকদের বেতনকাঠামো বলবৎ করার জন্য এই কমিটি সুপারিশ করে। মহানগর এলাকায় কর্মরত বিচারকদের মূল বেতনের শতকরা ৬০ ভাগ (বর্তমানে ৫০ ভাগ) ও মফস্বল শহরে কর্মরত বিচারকদের মূল বেতনের শতকরা ৫০ ভাগ (বর্তমানে ৪০ ভাগ) বাড়িভাড়া দেওয়ারও সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া চিকিৎসাভাতা ৫০০ টাকার স্থলে ১০০০ টাকা ও পোশাকভাতা বছরে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়ারও সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বর্তমানে তিন বছরে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়ার বিধান রয়েছে।
চাকরির বয়স বাড়ানো হয়নি : বিচারকদের চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিটি ঝুলে রয়েছে। বিচারকরা ৫৭ বছর বয়সে অবসর নেন। এটা বহাল থাকলে খুব শিগগিরই অভিজ্ঞ বিচারকের সংখ্যা কমে যাবে বলে বিচারকরা মনে করেন। অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নেই_এই বাস্তব কথা চিন্তা করে সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল ইসলাম কর্মরত থাকা অবস্থায় বিচারকদের বয়স বাড়ানোর আবেদন জানালে সরকার উচ্চ আদালতের বিচারকদের অবসর নেওয়ার বয়স বাড়ায়। কিন্তু নিম্ন আদালতের বিচারকদের অবসরের বয়স বাড়ানো হয়নি। এ অবস্থায় সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. রুহুল আমিনও বিচারকদের বয়স বাড়ানোর দাবি মেনে নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। কিন্তু বিচারকদের এই দাবি বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে বিচারকরা ক্ষুব্ধ বলে জানা গেছে।
পদোন্নতির ধারাবাহিকতা নেই : বিচারকরা অভিযোগ করেছেন, যোগ্যতার চেয়ে ব্যক্তিবিশেষের মর্জির ওপর পদোন্নতি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সিনিয়র বিচারকদের ডিঙিয়ে জুনিয়র বিচারকদেরও পদোন্নতি দেওয়ার রেওয়াজ আগেও ছিল, এখনো রয়েছে। জ্যেষ্ঠ বিচারকদের মধ্যে এ নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে।
বর্তমানে জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা জজ, যুগ্ম জেলা জজ পর্যায়ে বেশ কিছু পদ খালি রয়েছে। অথচ পদোন্নতি দিয়ে এ খালি পদগুলো পূরণ করা হচ্ছে না। এ অবস্থায় বিচারকরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন। তাঁরা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছেন।
নিরাপত্তাহীনতা : ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশের আদালত এলাকায় বোমা হামলা এবং পরবর্তী সময়ে ঝালকাঠিতে জঙ্গি বোমায় দুই বিচারক নিহত হওয়ার পর বিচারকরা নিরাপত্তা দাবি করে জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু সব দাবি এখনো পূরণ করা হয়নি। জেলা জজ পদমর্যাদার বিচারকরা গানম্যান পেলেও অতিরিক্ত জেলা জজ ও অন্য বিচারকরা এখনো তা পাননি।
বাসস্থান সমস্যা : প্রত্যেক জেলায় কর্মরত সব বিচারককে একই স্থানে বাসস্থানের ব্যবস্থা করার দাবি ছিল বিচারকদের। কিন্তু এখনো এই দাবি পূরণ করা হয়নি। এক স্থানে সবার বাসা হলে নিরাপত্তা ও বিচারকদের যাতায়াত দুটি ক্ষেত্রেই সুবিধা হবে। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সংক্রান্ত মাজদার হোসেন মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বিচারকদের বাসস্থান নির্মাণের নির্দেশ দিলেও এখনো সব বিচারকের বাসস্থানের ব্যবস্থা হয়নি বলে জানা গেছে।
যানবাহন সমস্যা : জেলা জজ পদমর্যাদার বিচারকরা ব্যতীত নিম্ন আদালতের অন্য বিচারকদের যানবাহনের ব্যবস্থা করতে সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সব বিচারকের জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেওয়ায় বিচারকরা ক্ষুব্ধ।

No comments

Powered by Blogger.