নতুন রুট সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না পেলে এগোবে না জাইকাঃ পথহারা মেট্রোরেল by এ কে এম জাকারিয়া ও আনোয়ার হোসেন

বিকল্প পথ ঠিক করার পরও প্রস্তাবিত মেট্রোরেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি। বিমানবাহিনীর আপত্তিতে বহুল প্রতীক্ষিত মেট্রোরেলের পথ বিজয় সরণির পরিবর্তে সংসদ ভবন এলাকা দিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এখনো জাতীয় সংসদ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে পারেনি। প্রকল্পের অর্থায়নে প্রতিশ্রুতি দেওয়া জাপানি ঋণদান সংস্থা জাইকা বলছে, সংসদ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া তারা এগোবে না।

যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ২৯ সেপ্টেম্বর যোগাযোগ-সচিব মোজাম্মেল হক খান বিজয় সরণির পরিবর্তে সংসদ ভবন এলাকা হয়ে খামারবাড়ির সামনে দিয়ে মেট্রোরেলের নতুন পথ সম্পর্কে অবহিত করতে জাইকাকে চিঠি পাঠান। চিঠিতে বলা হয়, ‘সরকার সংসদ এলাকার পাশ ঘেঁষে মেট্রোরেল নির্মাণের বিষয়ে মতামত দিয়েছে। জাইকা এখন এই পথ ধরে এগোতে পারে।’ তবে এটিই চূড়ান্ত পথ কি না, চিঠিতে তা বলা হয়নি।
চিঠি পাওয়ার পর ৬ অক্টোবর জাইকা মেইল করে কিছু প্রশ্ন জানতে চায় যোগাযোগ-সচিবের কাছে। জাইকা বলেছে, বিজয় সরণি পথ পরিহার করে বিকল্প পথে মেট্রোরেল হলে সংসদ ভবন এলাকার কিছু জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে সংসদের অনুমোদন লাগবে। এই অনুমোদন-প্রক্রিয়া কীভাবে হবে এবং কে অনুমোদন করবে, তা জানাতে হবে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এখনো জাইকাকে এ বিষয়ে কিছু জানায়নি।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মেট্রোরেলের পথ সম্পর্কে অবহিত করার বাধ্যবাধকতা থাকায় জাইকাকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে সংসদ কিংবা সংসদ সচিবালয়। সেটা কীভাবে হবে, তা জানে না যোগাযোগ মন্ত্রণালয়।
সূত্র জানায়, নতুন পথ নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদ যোগাযোগমন্ত্রীকে ফোনে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। যোগাযোগমন্ত্রী স্পিকারকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে সংসদের জায়গা ব্যবহার না করে বিদ্যমান সড়কের ওপর দিয়ে মেট্রোরেল নেওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা। প্রধানমন্ত্রীও স্পিকারকে জানিয়েছেন, সংসদ ভবনের জমি ছাড়াই বিকল্প পথে মেট্রোরেল হবে।
জাইকা সূত্র জানিয়েছে, বিকল্প পথে মেট্রোরেল হলে সংসদ এলাকার ৫৫ মিটার ভেতরে ঢুকতে হবে। সে ক্ষেত্রে লম্বালম্বি এই ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে। আর সংসদ ভবনের জমি বাঁচাতে গেলে খামারবাড়ির ১২ তলা তিনটি ভবন, ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল ভাঙা পড়তে পারে।
মেট্রোরেল নির্মাণের পর এর মাধ্যমে ঘণ্টায় গড়ে ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব। ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মেট্রোরেল নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা। জাপানের আন্তর্জাতিক ঋণদান সংস্থা জাইকা সহজ শর্তে প্রকল্পের জন্য ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
জাইকা প্রাক-সমীক্ষা করেছে। চূড়ান্ত সমীক্ষার পর রুটও ঠিক হয়েছে। শেষ পর্যায়ে রুটের ব্যাপারে আপত্তি এসেছে বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে। তাদের দাবি, উত্তরা থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত প্রায় ২২ কিলোমিটারের মেট্রোরেল রুটটির যে অংশ বিজয় সরণি দিয়ে যাওয়ার কথা, তা তেজগাঁও বিমানবন্দরের উড়োজাহাজ ওঠানামার পথকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে। বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে বিকল্প প্রস্তাবও। তবে তা নিয়ে আবার আপত্তি আছে স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদদের।
আলোচনায় তেজগাঁও বিমানবন্দর: বিমানবাহিনীর আপত্তির মূল বিষয় হচ্ছে ট্রেনসহ মেট্রোরেল লাইনটির উচ্চতা (৬৬ ফুট)। বলা হচ্ছে, রানওয়ে থেকে ৭০১ ফুট দূরে এই উচ্চতার লাইনটি বিমান ওঠানামাকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে। কিন্তু বিমানবন্দরটির মালিকানা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (ক্যাব)। তাদের ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে, সাতটি স্টল (শর্ট টেকঅফ অ্যান্ড ল্যান্ডিং) পোর্টের একটি হচ্ছে তেজগাঁও। এ ধরনের বিমানবন্দরে সাধারণত এমন উড়োজাহাজই ওঠানামা করে, যেগুলো ছোট রানওয়েতে ওঠানামা করতে পারে। তবে ১৫ অক্টোবর ওয়েবসাইটটি হালনাগাদ করে তেজগাঁওকে বিমানবন্দর দেখানো হয়েছে।
তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে দীর্ঘদিন বেসামরিক বিমান পরিচালনা করেছেন এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত বৈমানিক বলেছেন, প্রতিটি বিমানবন্দরের মতো তেজগাঁও বিমানবন্দরের রানওয়ের দুই পাশে অতিরিক্ত আরও ৫০০ ফিট করে ওভার রান রয়েছে। এখন যদি দক্ষিণ দিকের এই রান ওভার ও সঙ্গে আরও এক থেকে দুই হাজার ফুট রানওয়ে ‘ডিসপ্লেসড থ্রেসহোল্ড’ (যে চিহ্নিত অংশটি বাদ দিয়ে রানওয়েতে বিমান নামতে পারবে) হিসেবে চিহ্নিত করে এ অংশটি বাদ দিয়ে এয়ারক্রাফট নামে, তবে মেট্রোরেল লাইনে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এরপর আরও সাত হাজার ফুটের বেশি রানওয়ে থাকবে, যাতে অনায়াসে যেকোনো বিমান নামতে পারবে। বিমানবাহিনী সি-১৩০ এয়ারক্রাফটের কথা বলেছে, এটি নামতে সর্বোচ্চ রানওয়ে লাগে পাঁচ হাজার ফুট।
একাধিক বৈমানিক জানিয়েছেন, বিমানবন্দরে রানওয়ের সক্ষমতার মান বলে একটি বিষয় রয়েছে, যাকে বলা হয় পিসিএন (পেভমেন্ট ক্লাসিফিকেশন নম্বর)। তেজগাঁও বিমানবন্দরের রানওয়ের কোনো নির্দিষ্ট পিসিএন এখন নেই। কোন ধরনের ক্রাফট নামতে পারবে তা নির্ভর করে পিসিএনের ওপর। এখানে নেই কোনো আইএলএস (ইনস্ট্রুমেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম)। শাহজালাল বিমানবন্দরের কোনো উড়োজাহাজ বিশেষ প্রয়োজনে এখানে নামবে সে সুযোগ নেই। আর একমাত্র হেলিকপ্টার ছাড়া এখান থেকে ভিআইপি বা ভিভিআইপি চলাচল করানোও সম্ভব নয়।
একজন বেসামরিক বৈমানিক নাম প্রকাশ করতে চান না জানিয়ে বলেন, ‘বিমানবাহিনীর যে ধরনের বিমান বর্তমানে এখানে ওঠানামা করে বলে জানি, তাতে মেট্রোরেলের এই উচ্চতা নিয়ে সমস্যা হওয়ার কোনো কারণ নেই।’
বিকল্প প্রস্তাবে আপত্তি: বিমানবাহিনীর আপত্তি ও বিকল্প রুট প্রস্তাব করার পর প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে সে রুটটি নিয়েই এগোনোর পথ ধরে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। বিজয় সরণি বাদ দিয়ে সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে খামারবাড়ি হয়ে নতুন এ পথটির বিরোধিতা করছেন দেশের নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশবিদেরা। সংসদ ভবনের মতো একটি স্থাপনা ও এর পারিপার্শ্বিক স্থাপত্য নষ্ট করে এ পথে মেট্রোরেল করার বিরুদ্ধে তাঁরা। স্থপতি ও পরিবেশবাদী সংগঠনের অনেকে এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নগরায়ণ ও সুশাসন কমিটির সদস্য সচিব স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন এভাবে, ‘এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা যখন নেওয়া হয়, তখন অনেক দিক বিবেচনা করে তা নেওয়া হয়, মেট্রোরেলের রুটটি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তা করা হয়েছে। এখন একসময় পরিত্যক্ত হিসেবে ঘোষিত বিমানবন্দরের ঝুঁকির প্রশ্ন তুলে আপত্তি আসার সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনা পরিবর্তনের বিষয়টি অগ্রহণযোগ্য। পরিবহন বিশেষজ্ঞ, নগর পরিকল্পনাবিদ—এঁদের কারও মতামত না নিয়ে শুধু বিমানবাহিনীর আপত্তির কারণে এত সমীক্ষা করে করা একটি রুট পাল্টে যাবে তা কী করে হয়!’
একাধিক স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ সংসদ ভবনের জায়গা দিয়ে এ ধরনের একটি স্থাপনা যাওয়ার বিরোধিতা করে বলেছেন, সংসদ ভবন একদিকে যেমন জনগণের শক্তির প্রতীক, তেমনি এটি একটি অনন্য স্থাপত্য। এই স্থাপনার জায়গা দিয়ে মেট্রোরেল যাওয়ার অর্থই হচ্ছে এর বিকৃতি, যা কোনোভাবেই তাঁরা মেনে নিতে পারেন না।
যে বিমানবন্দরের কারণে মেট্রোরেলের রুট পরিবর্তনের কথা ভাবা হচ্ছে, সেই বিমানবন্দর ঘনবসতিপূর্ণ এই ঢাকা শহরে থাকাটাকে বিপজ্জনক মনে করছেন অনেক নগর পরিকল্পনাবিদ। স্থপতি ইকবাল হাবিব বললেন, ‘বলা হচ্ছে কৌশলগত কারণে, মানে সামরিক দিক দিয়ে এর গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু সে ধরনের পরিস্থিতিতে জনবহুল এই শহরের মাঝখানে এ ধরনের বিমানবন্দর সামরিক কাজে ব্যবহারের ঝুঁকি নেওয়ার অর্থ হচ্ছে ঢাকাবাসীকে অনেকটা মানববর্ম হিসেবে ব্যবহার করা।’
পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা: জাইকার আর্থিক বছর শুরু হয় এপ্রিল মাসে। জাইকার একটি সূত্র জানিয়েছে, তারা চেয়েছিল সরকার মেট্রোরেলের পথ ঠিক করে দিলে চলতি অর্থবছরেই ঋণ চুক্তি চূড়ান্ত করে প্রাথমিক কাজ এগিয়ে রাখতে। নতুবা আগামী বছর এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া পরবর্তী অর্থবছরে প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত করতে হলে প্রক্রিয়াটি প্রায় এক বছর পিছিয়ে যাবে।
যোগাযোগ-সচিব মোজাম্মেল হক খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আমাদের যতটুকু করণীয় করেছি। বাকিটা সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে ঠিক করবে। আমরা চিঠি দেওয়ার পর জাইকা কিছু বিষয়ে জানতে চেয়েছিল। তার জবাব শিগগিরই দেওয়া হবে।’
এ ধরনের প্রকল্প পিছিয়ে যাওয়ার বিপদের বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন মেট্রোরেল বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত কারিগরি কমিটির এক সদস্য। বলেন, ‘এখন মেট্রোরেল তৈরির যে উদ্যোগ চলছে, তা যদি কোনো কারণে পিছিয়ে যায়, তবে সামনে কাজটি আরও কঠিন হয়ে যেতে পারে। দেখা যাবে তখন আরও নতুন নতুন বাধা এসে হাজির হবে। আরও নতুন নতুন আপস করতে হতে পারে, মেট্রোরেলের আদর্শ মান ধরে রাখা সে ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে পড়বে। মেট্রোরেলের নির্মাণকাজটি তাই দ্রুত শুরু করা জরুরি।’
জরুরি মেট্রোরেল: সাধারণভাবে বলা হয়, একটি শহরের আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকা উচিত। কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা করার আগে করা এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকায় সড়ক আছে মাত্র সাত থেকে আট শতাংশ। এই সড়কগুলোর বিন্যাসও এমন যে সব রাস্তায় বাস চলাচল সম্ভব নয়। সমীক্ষা অনুযায়ী বাস চলাচল উপযোগী রাস্তা হচ্ছে মোট রাস্তার ৩০ শতাংশেরও কম। ফলে দেশে একটি সুষ্ঠু গণপরিবহনব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারেনি। নগরের যানবাহনব্যবস্থা হয়ে পড়েছে ব্যক্তিগত গাড়িনির্ভর।
বিশেষজ্ঞরা জানান, বাসের সঙ্গে মেট্রোরেল-ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে অধিকাংশ জনবহুল শহরে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১৭২টি শহরে মেট্রোরেল সার্ভিস রয়েছে, আরও ৩৪টি শহরে এ ব্যবস্থা সংযোজিত হতে যাচ্ছে। ঢাকার মতো একটি জনবহুল শহরে একসঙ্গে সবচেয়ে কম সময়ে বেশি যাত্রী পরিবহনে সক্ষম মেট্রোরেল সার্ভিসকে তাই একটি জরুরি প্রয়োজন বলে মনে করেন দেশের নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও ইউএনএসকাপের (ট্রান্সপোর্ট ডিভিশন) সাবেক পরিচালক ড. রহমতউল্লাহর বক্তব্য হচ্ছে, যে শহরে জনসংখ্যা বেশি এবং ঘনত্বও বেশি, সেখানে মেট্রোরেল সবচেয়ে কার্যকর ও জরুরি একটি বিষয়। অন্য যেকোনো গণপরিবহনের চেয়ে এর কার্যকারিতা সবচেয়ে বেশি। ঢাকা একটি মেগা সিটি, শুধু বাস দিয়ে এই শহরের গণপরিবহন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। মেট্রোরেল প্রতি ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৮০ হাজার লোক এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যেতে পারে, তা ছাড়া এই যাতায়াত বাধাহীন। বাসের মাধ্যমে যা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। ঢাকার জন্য তাই মেট্রোরেলের কোনো বিকল্প নেই।

No comments

Powered by Blogger.