এবার আসল পরীক্ষা-চাই 'টিম বাংলাদেশের' পারফরম্যান্স by নোমান মোহাম্মদ,

বাংলাদেশ ভয়ংকর দল_প্রতিপক্ষ কোচ-অধিনায়ক-খেলোয়াড়দের মুখে এমন কথা শোনা যায় প্রায়ই। সেটি যত না ক্রিকেটীয় বিশ্লেষণের সিদ্ধান্ত, তার চেয়ে ঢের বেশি ক্রিকেটীয় ভদ্রতার খোলস! আর ক্যারিবিয়ানদের সৌজন্যবোধ তো সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশে আসার পর থেকেই স্বাগতিকদের বারংবার 'ভয়ংকর দল'-এর স্বীকৃতি দিতে তারা কুণ্ঠাহীন। তো ঠিক কী কারণে বাংলাদেশকে ভয়ংকর মনে হচ্ছে, এই প্রশ্নের উত্তরটা দারুণভাবে দিয়েছিলেন মারলন স্যামুয়েলস, 'কারণ বাংলাদেশের খেলার ধরনও আমাদের মতো। একদিন হয়তো আমাদের সামনে অন্য কোনো দলই পাত্তা পায় না, আবার পর দিন সেই আমরাই হেরে যাই বাজেভাবে।'


প্রতিভাবান কিন্তু অধারাবাহিক। সংশয়াতীত সামর্থ্য অথচ মাঠে তার প্রকাশ সামান্য। এক ম্যাচে অবিশ্বাস্য সেঞ্চুরি কিংবা ইনিংসের ৫ উইকেট, তো পরের খেলাতেই পাড়ার ব্যাটসম্যান আর গলির বোলারদের স্তরে নেমে যাওয়া। সাম্প্রতিককালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর চিরকালীন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি এটি। তা দিয়ে টোয়েন্টি টোয়েন্টি আর ওয়ানডেতে যেমন-তেমনভাবে পার পাওয়া যায়। কখনো-সখনো হয়তো মুঠোবন্দি করা যায় জয়ও। কিন্তু টেস্টের উত্তাল সমুদ্র পাড়ি আর দেওয়া যায় না। ক্রিকেটের সবচেয়ে কঠিন সংস্করণের পরীক্ষায় তাই দল দুটি উতরাতে ব্যর্থ হয় প্রায়ই।
দলীয় খেলার মোড়কে ক্রিকেট শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত খেলা। এটি ফুটবল না যে দল যখন আক্রমণে থাকবে, তখনো ডিফেন্ডারদের জন্য বরাদ্দ থাকবে নির্দিষ্ট দায়িত্ব। পুরো দলটাই সেখানে এক সুতোয় বাঁধা। এখানে দুই ব্যাটসম্যান যখন ক্রিজে নামেন, তখন সতীর্থ ৯ জনকে ড্রেসিংরুমে রেখেই যুদ্ধের ময়দানে যান। ক্রিকেট তাই ব্যক্তিগত বীরত্বের। তা হোক না। শেষ পর্যন্ত ম্যাচের ফল অনুকূলে আনতে হলে আবার দ্বারস্থ হতে হয় সেই সামষ্টিক চেষ্টারই। বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটে। ওয়ানডে কিংবা টোয়েন্টি টোয়েন্টিতে হয়তো অনেক সময় একজন ব্যাটসম্যান কিংবা বোলার প্রায় একাই ম্যাচ জিতিয়ে দিতে পারেন। সেটি ২০ বা ৫০ ওভারের খেলা বলে। টেস্টে পাঁচ দিন, ১৫ সেশন, ৪৫০ ওভারের খেলা। এখানে একজন-দুজনের বীরত্বে ম্যাচের ফলে প্রভাব পড়ে সামান্যই। নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে তারা কেবল কিছু হাততালি পান। এ কারণেই ভয়ংকর বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটে গিয়ে হয়ে যায় গড়পড়তা। ৬৯ টেস্টের মধ্যে মাত্র তিনটি জয় সে সাক্ষ্যই দেয়।
নিকট অতীতের দলের খেলোয়াড়দের বিশ্লেষণ দেখলেই বুঝবেন টেস্টে বাংলাদেশের অসহায়ত্ব। সর্বশেষ ১০ টেস্টের ২০ ইনিংসের মধ্যে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা করেছেন মাত্র আটটি সেঞ্চুরি এবং ২৫টি হাফ সেঞ্চুরি। অর্থাৎ ইনিংসপ্রতি মাত্র ১.৬৫টি ইনিংস ৫০ ছাড়ানো। বোলারদের অবস্থা তো আরো ভয়াবহ। এই ২০ ইনিংসের মধ্যে মাত্র ছয়বার কোনো বোলার ইনিংসে পেয়েছেন ৫ উইকেট। এই ছাড়া ছাড়া আলোকদ্যুতি ছড়িয়ে কী টেস্ট জেতা যায়!
কাল সংবাদ সম্মেলনে মুশফিকুর রহিম বলে গেলেন এই সম্মিলিত পারফরম্যান্সের গুরুত্ব। এটি ছাড়া টেস্টে যে ভালো করা সম্ভব না, জানা সেই কথাটি জানিয়ে গেলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক, 'টেস্টে যদি ব্যাটসম্যানরা বড় রান না করে, বোলাররা যদি ৫ উইকেট না পায়, তাহলে ম্যাচ ড্র করা বা জেতা খুব কঠিন। আমাদের টার্গেট আছে, টেস্টে একজন ব্যাটসম্যান পুরো দিন ব্যাটিং করতে পারে কি না। কে প্রথম সেঞ্চুরি করবে, এক শ-দেড় শ রানের জুটি হবে কি না অথবা বোলারদের ইনিংসে ৫ উইকেট, ম্যাচে ৮ বা ১০ উইকেট নিতে পারবে কি না_এ রকম টার্গেট দলের সামনে বেঁধে দেওয়া আছে।'
সেই টার্গেট ছোঁয়ার জন্য সতীর্থরা চাইলে অনুপ্রেরণা নিতে পারেন তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসানের কাছ থেকে। এই সর্বশেষ ১০ টেস্টে তামিম ১০৯২ রান করেছেন ৫৪.৬ গড়ে। এ সময়ে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের যে ৩৩টি পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস, তার মধ্যে ১০টিই এসেছে বাঁহাতি ওপেনারের ব্যাটের তুফানে। চারটি সেঞ্চুরির পাশাপাশি ছয়টি হাফ সেঞ্চুরি তামিমের। আর সাকিব এই ১০ ম্যাচে নিয়েছেন ৪৪ উইকেট। গড় ৩২.২৫, স্ট্রাইক রেট ৬৮.৪। এই ১৯ ইনিংসের মধ্যে কেবল তিনটিতেই উইকেট পাননি বাঁহাতি স্পিনার। তবে সেগুলো ছিল ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে। সেখানে কেবল ১৫, ৮ এবং ০.২ ওভার বোলিংয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন সাকিব।
সাকিব-তামিম ওয়ানডেতে এভাবে জ্বলে উঠে বাংলাদেশকে অনেক ম্যাচ জিতিয়েছেন। টেস্টে সেটি পারবেন কেন! এখানে বেশির ভাগের অবদান ছাড়া ভালো করা অসম্ভব। লর্ডসের দ্বিতীয় ইনিংসে তামিমের সেঞ্চুরির সঙ্গে ইমরুল কায়েসের ৭৫ এবং জুনায়েদ সিদ্দিকের ৭৪ রানে ৩৮২ পর্যন্ত যেতে পেরেছিল দল। আবার গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হ্যামিল্টন টেস্টের প্রথম ইনিংসে সাকিব (৮৭)-তামিমের (৬৮) হাফ সেঞ্চুরির সঙ্গে মাহমুদ উল্লাহর (১১৫) সেঞ্চুরিতে চার শ রান পেরিয়ে যায় বাংলাদেশ। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে এক সাকিব (১০০) ছাড়া আর কেউ হাফ সেঞ্চুরি পর্যন্ত করতে পারেননি। দলও তাই মুখ থুবড়ে পড়েছে ২৮২ রানে। বোলিংয়ের একই কথা। সর্বশেষ ১০ টেস্টের ২০ ইনিংসে যে ছয়বার বাংলাদেশি বোলাররা ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন, এর মধ্যে তিনটিই সাকিবের। গত বছরের জানুয়ারিতে এই চট্টগ্রামেই সাকিবের পাশাপাশি ৫ উইকেট নিয়েছিলেন শাহাদাত হোসেনও। ভারতের পরাক্রমশালী ব্যাটিং লাইনও তাই অল আউট হয়ে যায় ২৪৩ রানে।
ইংলিশ ফুটবল ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কোচ স্যার অ্যালেঙ্ ফার্গুসন কয়েক দিন আগে বলেছিলেন, 'কোনো ম্যাচে আমার দলের ১১ জনের মধ্যে আটজন সেরা ফর্মে থাকলেই আমরা নিজেদের সেরাতে থাকি। বাকি তিনজনের নিষপ্রভতা অন্যরা ঢেকে দিতে পারে।' টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলে আবার নিষপ্রভ তারকার সংখ্যাই বেশি। তাই তো মিটিমিটি করে জ্বলে দল। কোনো কোনো টেস্টে কোনো কোনো ইনিংসে কেউ কেউ হয়তো মহীরুহ হয়ে ওঠেন। কিন্তু অনেক বৃক্ষের বুননে অরণ্য হয়ে উঠতে পারে না বাংলাদেশ।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে সেই 'অরণ্য' হয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের সামনে।

No comments

Powered by Blogger.