বিশ্বব্যাংককে আশ্বস্ত করেছে বাংলাদেশ-পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ স্বচ্ছতার সঙ্গেই হবে

রকার পদ্মা সেতু প্রকল্পের স্বচ্ছতার ব্যাপারে বিশ্বব্যাংককে আশ্বস্ত করে বলেছে, এ বিষয়ে ভবিষ্যতে দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পেলে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে জারিকৃত এক প্রেসনোটে বলা হয়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের কিছু কিছু পদক্ষেপ যথাযথ মনে করছে না সরকার। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন স্থগিতের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে সরকার বলেছে, পরামর্শক নিয়োগে দরপত্র কার্যক্রম আপাতত স্থগিত থাকলেও জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসনসহ অন্যান্য কার্যক্রম অব্যাহত আছে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সৃষ্ট জটিলতা অতিসত্বর নিষ্পত্তি করে দ্রুত পদ্মা সেতুর কাজ সম্পন্ন করা হবে। এ লক্ষ্যে একটি 'অবকাঠামো তহবিল' গঠন করা হবে।


দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন স্থগিতের ঘোষণার প্রেক্ষাপটে গতকাল বৃহস্পতিবার একটি প্রেসনোটে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিয়েছে সরকার। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতা চেয়ে সরকার বলেছে, এ ক্ষেত্রে প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রেসনোটে কানাডীয় অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ করে কাজ শুরু করার জন্য দাতাদের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়ায় প্রাকযোগ্যতা মূল্যায়ন কমিটির প্রধান ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমকালকে তিনি বলেন, সরকারের ব্যাখ্যা এখনও দেখিনি। এ কারণে বিস্তারিত মত দেওয়া সম্ভব নয়। তবে মূল্যায়ন কমিটি যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে সেখানে কোনো ধরনের দুর্নীতি হয়নি। আমরা কোনো দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিইনি। ঠিকাদারদের প্রাকযোগ্যতা মূল্যায়ন সম্পূর্ণ স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হয়েছে। বাইরে থেকে কেউ এ বিষয়ে কোনো প্রভাব খাটিয়ে থাকলে বা কোনো ধরনের দুর্নীতি হলে সে বিষয়ে আমাদের কিছু জানা নেই। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে
২৯০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ১২০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা বিশ্বব্যাংকের। বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সির (আইএনটি) তদন্তে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তোলার পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ সহায়তা স্থগিত করে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এ প্রকল্পে প্রধান অর্থায়নকারী বিশ্বব্যাংক। লিড এজেন্সি হিসেবে বিশ্বব্যাংক অর্থছাড় না করায় বাকি দাতা সংস্থাগুলোও অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। এ অবস্থায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। দাতারা পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের পরিষ্কার অবস্থান জানতে চাইলে গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।
প্রেসনোটে বলা হয়েছে, মূল সেতুর নির্মাণ কাজের ঠিকাদারদের প্রাকযোগ্যতা মূল্যায়ন সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক যে অভিযোগ সরকারের কাছে দিয়েছে, ইতিমধ্যেই সে অভিযোগের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সরকার আশা করছে, দুদকের তদন্তে বিশ্বব্যাংক সহায়তা করবে এবং তার ফলাফল অচিরেই পাওয়া যাবে। দুর্নীতির প্রমাণ পেলে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন স্থগিতের জন্য দুর্নীতিকে দায়ী করে বক্তব্য দিয়ে আসছেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। এর পাল্টা জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার এক জনসভায় বলেন, বিএনপি আমলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির জন্য পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন স্থগিত করেছে বিশ্বব্যাংক।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আরাস্তু খান স্বাক্ষরিত এ প্রেসনোটে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতুর ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনসহ যেসব কার্যক্রম শুরু ও বাস্তবায়ন হয়েছে সেসব ব্যাপারে এখনও কোনো দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়নি। সরকার গৃহীত ব্যবস্থা অনুযায়ী ভবিষ্যতেও দুর্নীতির কোনো সুযোগ থাকবে না। দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে বিশ্বব্যাংককে জানানো হয়েছে।
প্রেসনোটে আরও বলা হয়, সেতু নির্মাণ কাজ তদারকির জন্য পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি কানাডীয় কোম্পানি নীতিবহির্ভূত কাজ করেছে বলে বিশ্বব্যাংকের তদন্তে উঠে এসেছে, যা কানাডা সরকার তদন্ত করছে। সরকার বলছে, বিশ্বব্যাংককে তখনই জানিয়ে দেওয়া হয়, যেহেতু কানাডার তদন্তে কত দিন লাগবে সেটা বলা যাচ্ছে না, সেহেতু ওই প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে অবশিষ্টদের মধ্য থেকে পরামর্শক নিযুক্তির দরপত্র চূড়ান্ত করা যায়। এ সময় হঠাৎ করে সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসাবেল এম গেরেরো ঢাকায় আসেন। তিনি তখন জানান যে, তাদের কাছে মূল সেতু নির্মাণের প্রাকযোগ্য ঠিকাদার নির্বাচন নিয়েও কিছু অভিযোগ আছে এবং সেগুলো তারা খতিয়ে দেখছেন। এই অভিযোগ সম্পর্কে তারা কিছুদিনের মধ্যে সরকারকে অবহিত করবেন। এরই মধ্যে সেতুর বিষয়ে যেসব কাজকর্ম চলছে সেগুলো সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হচ্ছে।
প্রেসনোটে বলা হয়, গত সেপ্টেম্বরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় যোগ দিতে ওয়াশিংটন গেলে সংস্থাটি লিখিতভাবে অভিযোগ করে, তারা মনে করে মূল সেতুর প্রাকযোগ্য ঠিকাদার তালিকা বিবেচনার সময় দুর্নীতি হয়ে থাকতে পারে। দুর্নীতির তদন্তের জন্য সরকারকে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হয়। বিশ্বব্যাংক তাদের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য সরকারকে দেবে বলেও জানায়। অর্থমন্ত্রী দেশে ফেরার পর 'দুর্নীতি' তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত হয়। একইসঙ্গে বিশ্বব্যাংককে জানিয়ে দেওয়া হয়, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় প্রাকযোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানগুলো সব সময়ই কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে থাকে এবং পরবর্তীকালে অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো অসত্য এবং ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হয়।
বিশ্বব্যাংককে সরকারের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, বাস্তবায়িত কার্যক্রমের স্বচ্ছতা, সততা ও দ্রুততার রেকর্ড বিবেচনা করে দরপত্র প্রক্রিয়া স্থগিত করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কানাডীয় অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে ঠিকাদার নিয়োগের কাজটি এগিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংককে প্রস্তাব দিয়েছে সরকার। নদীশাসনের দরপত্র অনুমোদন এবং মাওয়া প্রান্তের অ্যাপ্রোচ রোডের দরপত্রের কাজ শুরুর জন্যও সরকার বিশ্বব্যাংককে অনুরোধ করেছে।
প্রেসনোটে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়ায় প্রাকযোগ্যতা মূল্যায়ন কমিটির নেতৃত্বে আছেন প্রকৌশলী ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। সদস্য ড. শফিউল্লাহ, ড. আইনুন নিশাত, বিশ্বব্যাংকের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ড. দাউদ। তারা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ। মূল্যায়ন কমিটির কাছে কারিগরিভাবে অযোগ্য বিবেচিত হওয়া একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে অধিকতর যাচাই-বাছাই নিয়ে তিন মাস সময় নষ্ট করার পর গত জুলাই মাসে বিশ্বব্যাংক পাঁচ দরদাতাকে প্রাকযোগ্য ঘোষণা করে। ওই প্রতিষ্ঠান শেষ পর্যন্ত অনুমোদিত তালিকায় আসেনি। পদ্মা সেতু প্রকল্পের অন্য সব কার্যক্রম_ যেমন জমি অধিগ্রহণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত জমি মালিকদের পুনর্বাসন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। 'পদ্মা সেতুর কাজ থেমে নেই' শিরোনামে প্রেসনোটে বলা হয়_ সরকার আশা করছে, পদ্মা সেতু নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার শিগগিরই অবসান হবে।

No comments

Powered by Blogger.