গাদ্দাফি নিহত

লিবিয়ার ক্ষমতাচ্যুত নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি গতকাল তার জন্মস্থান সির্তের অদূরে বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়ার পর নিহত হয়েছেন। লিবিয়ার টেলিভিশনে গাদ্দাফির মৃতদেহের ছবি দেখানো হয়েছে। দেশটির অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরাইল গাদ্দাফি নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছেন এবং জনগণকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তথ্যমন্ত্রী মাহমুদ শাম্মাম বলেছেন, গাদ্দাফি যেখানে লুকিয়ে ছিলেন, বিদ্রোহীরা সেখানে অভিযান চালালে তিনি পালানোর চেষ্টা করলে গুলিতে নিহত হন। তার মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছে গোপন একটি স্থানে।


এনটিসি’র কর্মকর্তারা জানান, গাদ্দাফির ছেলে মোতাসসিম, সেনাবাহিনীপ্রধান আবু বকর ইউনুস এবং গোয়েন্দা প্রধান আবদুল্লাহ আল সেনুরিও নিহত হয়েছেন। অপর ছেলে সাইফ আল ইসলাম গাড়িবহর নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়েছেন। বিশ্বনেতারা বলেছেন, গাদ্দাফির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে লিবিয়ার ইতিহাসের নির্মম যুগের অবসান হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, লিবিয়ার সামনে কঠিন পথ রয়েছে। এখন সময় এসেছে লিবীয়দের একত্রিত হওয়ার। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন, লিবিয়ার মানুষের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যত্ রচনার একটি সুযোগ এসেছে। গণতন্ত্রের উত্তরণ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ফরেন রিলেশন কমিটির চেয়ারম্যান জন কেরি বলেছেন, গাদ্দাফির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার ভয়ঙ্কর শাসনের অবসান হলো। এদিকে গাদ্দাফি নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এনটিসি’র যোদ্ধারা আনন্দ-উত্সবে মেতে ওঠে। রাজধানী ত্রিপোলি বন্দরে জাহাজ এবং গাড়ির হর্ন বাজিয়ে, ফাঁকা গুলি করে উল্লাস করেছে জনতা। সির্তসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে আনন্দ-উল্লাসে যোগ দেয়। বিবিসি, এএফপি, রয়টার্স, এপি, আলজাজিরা, সিএনএন, দ্য টেলিগ্রাফ।
দেশটির অন্তর্বর্তী সরকার ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিল তথা এনটিসি কর্মকর্তারা এবং লিবিয়ার টেলিভিশন জানিয়েছে, গতকাল ভোরে গাদ্দাফিকে সির্ত শহরের কাছ থেকে আটক করা হয়। সে সময় তিনি গুরুতরভাবে জখম হন এবং সেই জখমেই তিনি মারা গেছেন। গাদ্দাফির মাথায়ও গুলি লাগে। যদিও এনটিসি কর্মকর্তা আবদেল মজিদ জানিয়েছেন, গাদ্দাফি গতকাল ভোরে একটি কনভয়যোগে পালানোর চেষ্টা করলে ন্যাটোর জঙ্গিবিমান সেটিতে হামলা চালায়। এ সময় তার দু’পায়ে ও মাথায় গুলি লাগে। তিনি আটক অবস্থায় মারা যান। তখন বেশকিছু সময় ধরে গোলাগুলি চলে। গাদ্দাফি সরকারের মুখপাত্র মুসা ইব্রাহিমকেও আটক করা হয়েছে সির্ত শহরের কাছ থেকে। ইলেভেন ব্রিগেডের কমান্ডার আবদুল হাকিম আল-জলিল জানান, গাদ্দাফির সেনাবাহিনীপ্রধান আবু বকর ইউনুস নিহত হয়েছেন। মুসা ইব্রাহিমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সেনাবাহিনীর অপারেশন কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গাদ্দাফির ছেলে মোতাসসিম গাদ্দাফিও সির্ত শহরে নিহত হয়েছেন।
অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরাইল গাদ্দাফি নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছেন এবং জনগণকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তথ্যমন্ত্রী মাহমুদ শাম্মাম বলেছেন, গাদ্দাফি তার লুকিয়ে থাকা অবস্থান থেকে পালানোর চেষ্টা করলে গুলিতে নিহত হন। তিনি এখন ইতিহাস।
বেনগাজিতে এনটিসি’র ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল হাফিজ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। আমাদের সন্তান এবং সারা বিশ্বকে জানাতে চাই লিবিয়ায় স্বৈরাচার ও একনায়কতন্ত্র শেষ হয়েছে। আর তা ফিরে আসবে না। একজন স্বৈরাচারী শাসকের জন্য যা ছিল অবধারিত, গাদ্দাফির ভাগ্যে তা-ই ঘটেছে। বিদ্রোহীদের হাতে গাদ্দাফি নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে একনায়ক শাসনের অবসান ঘটল।
বেশক’টি সূত্র জানিয়েছে, গাদ্দাফি সির্তের একটি ড্রেনের পাইপের ভেতরে লুকিয়ে ছিলেন। গতকাল খুব ভোরের দিকে বিদ্রোহী যোদ্ধারা ওই শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং একইসঙ্গে অতিগোপনে গাদ্দাফিকে আটকের জন্য চিরুনি অভিযান চালায়। স্যাটেলাইট মোবাইলের সাহায্যে তারা গাদ্দাফির অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। এরপরই চালানো হয় শ্বাসরুদ্ধকর এক অভিযান। শহরের অজ্ঞাত ওই স্থানে গাদ্দাফির গোপন অবস্থান নিশ্চিত করে বিদ্রোহী যোদ্ধারা ছুটে যায় সেখানে।
এদিকে এনডিটিভির খবরে এনটিসি’র একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, মৃত্যুর আগমুহূর্তে এনটিসি’র সেনারা তার বাংকারে বা সেই পাইপলাইনে অতর্কিত হানা দেয়ার পর গাদ্দাফি পালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হলে গাদ্দাফি এনটিসি সেনাদের উদ্দেশে ‘ডোন্ট শুট, ডোন্ট শুট’ বলে চিত্কার করছিলেন। কিন্তু তার কথায় কর্ণপাত না করে এনটিসি সেনারা তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। তার কাছ থেকে একটি সোনালি রঙের পিস্তল বিদ্রোহীদের একজন কেড়ে নেয়। সেই পিস্তল দিয়েই তাকে গুলি করা হয়েছে বলে প্রাথমিক খবরে জানা যায়। যদিও এর সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি।
এনটিসি যোদ্ধারা এর আগে জানিয়েছে, গাদ্দাফি অনুগত যোদ্ধাদের নিয়ে ৪০টি গাড়ি শহরটি থেকে বেরিয়ে পশ্চিম দিকে গেছে। আরেক এনটিসি যোদ্ধা আবদুল সালাম মোহাম্মদ জানান, গাদ্দাফির লোকজন পশ্চিমে পালালেও তাদের ঘিরে ফেলা হয়েছে এবং তাদের সঙ্গে দেনদরবার চলছে। অন্তত ১৬ গাদ্দাফিপন্থী যোদ্ধাকে আটক করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমগুলো সে সময় জানায়।
ওদিকে বনি ওয়ালিদ শহরে এখনও গাদ্দাফি অনুগত গুটিকয়েক যোদ্ধার প্রতিরোধ লড়াই মোকাবিলা করতে হচ্ছে সরকারি বাহিনীকে। তবে এরই মধ্যে শহরটির ৯০ শতাংশ এলাকা দখল করেছে তারা।
সির্ত দখল : সির্ত শহরটি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে লড়াই করে গাদ্দাফি বাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলেছিল এনটিসি বাহিনী। তবে শহরটি পুরো দখলের পথে তাদের জন্য বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়ায় গাদ্দাফিপন্থী স্নাইপাররা। কিন্তু গতকাল সকালে এনটিসি সেনারা প্রায় ৯০ মিনিট লড়াইয়ের পর সর্বশেষ অবস্থান থেকে গাদ্দাফিপন্থীদের হটিয়ে দেয়ার কথা জানায়।
শহরটির পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধাভিযানের দায়িত্বরত প্রধান কর্মকর্তা কর্নেল ইউনুস আল-আবদালি বলেন, সির্ত মুক্ত করা হয়েছে। গাদ্দাফি সেনারা আর নেই। আমরা এখন পলায়নপর গাদ্দাফি অনুগত যোদ্ধাদের ধাওয়া করছি। সম্মুখ সারিতে লড়াই করা আরেকজন কমান্ডারও সির্ত পুরোপুরি দখল করে নেয়ার খবর নিশ্চিত করেছেন।
গত ২৩ আগস্টে রাজধানী ত্রিপোলির পতনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হন ৪২ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা গাদ্দাফি। এরপর থেকে তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু জানা যাচ্ছিল না। ১৯৬৯ সালে রাজতন্ত্র বিলোপ করে লিবিয়ার ক্ষমতায় বসেন গাদ্দাফি।

No comments

Powered by Blogger.