বই পড়ুন ও প্রিয়জনকে উপহার দিন by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

সৃষ্টিজগৎ ও সৌরজগতের সবকিছুর বিবরণ বইপুস্তকেই লিপিবদ্ধ। বই জ্ঞানের বাহন। আসমানি কিতাব বা ঐশী ধর্মগ্রন্থের মাধ্যমে মানবজাতি আল্লাহর পরিচয় ও দিকনির্দেশনা পায়, প্রয়োজনে তারা পার্থিব বইয়েও জাগতিক বিভিন্ন বৈষয়িক জ্ঞানার্জন করতে পারে।
পৃথিবীর সব জ্ঞানের ভান্ডার হলো বই। এতে রয়েছে মানবজাতির ইতিকথা ও জ্ঞানের পথপ্রদর্শন। বই মানবজীবনের এক পরম হিতৈষী, প্রকৃত বন্ধুু ও জীবনসঙ্গী। অবসরে পড়াশোনা করলে বই ধর্মপ্রাণ মানুষকে সৎ পথ দেখায়, জ্ঞানের আলো মানবজীবনকে উন্নতির উচ্চশিখরে পৌঁছে দেয়। মানুষকে স্বশিক্ষিত হিসেবে গড়ে উঠতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে বই পড়ার মাধ্যমে স্বীয় বুদ্ধি ও বিবেক-বিবেচনা অনুযায়ী জীবনকে বিকশিত করে তুলতে হয়। অথচ পাঠচর্চা না থাকার কারণে আমাদের মানবিকতা, মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যপ্রীতি বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ওমর খৈয়ামের ভাষায়, ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে/ প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে/ কিন্তু একটি বই অনন্ত যৌবনা/ যদি তা তেমন বই হয়।’
একটি ভালো বই যেকোনো সময় মানুষের চিন্তা-চেতনাকে আমূল বদলে ফেলতে পারে। তার মানবিক সুকোমল বৃত্তিগুলো বিকশিত করে দায়িত্বসচেতন, দেশপ্রেমিক ও বুদ্ধিদীপ্ত নাগরিকে পরিণত করে। যারা স্বাভাবিক জ্ঞানকে শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে সম্প্রসারিত করে প্রতিটি বিষয়ের তাৎপর্য বোঝার, নিজের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টায় লিপ্ত, তারা কখনোই অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিতদের সমান হতে পারে না। পার্থিব জগতে ভালো-মন্দের পার্থক্য নির্ণয় করার ক্ষেত্রে জ্ঞানার্জনের বিকল্প নেই। তাই আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের অনুসৃত ঐশী ধর্মগ্রন্থের প্রারম্ভিক বাণীতেই বই পড়ার তাগিদ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনের সর্বপ্রথম নাজিলকৃত পাঁচটি আয়াতের চারটিই পড়াশোনাবিষয়ক। ইরশাদ হয়েছে, ‘পাঠ করো! তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে জমাট রক্ত থেকে সৃষ্টি করেছেন। পাঠ করো! আর তোমার প্রতিপালক মহিমান্বিত। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না।’ (সূরা আল-আলাক, আয়াত-১-৫)
পৃথিবীর উন্নতি সাধনে, আধুনিক জগতের প্রচার-প্রসারে এবং মানুষের মরণব্যাধির প্রতিরোধে, জীবন দানের ব্যাপারে ওষুধপত্রাদি আবিষ্কারের বাহন হচ্ছে মহামূল্যবান বই। দুনিয়াতে যাঁরা মরেও অমর হয়ে আছেন, সেসব মহামানব, ধর্মীয় নেতা, জ্ঞানী-গুণীজন, কবি-সাহিত্যিক, লেখক-সাংবাদিক ও বৈজ্ঞানিক— সবাইকে এ বইয়ের মাধ্যমে আয়নাস্বরূপ দেখা যায়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা মানুষকে ধর্মভীরু ও মহৎপ্রাণ করে তোলে, চিত্তকে মুক্তি দেয় এবং মানবাত্মাকে জীবনবোধে বিকশিত করে। বিভিন্ন বিষয়ে সুশৃঙ্খল ও পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানার্জন এবং পরিপূর্ণ মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে হলে অবশ্যই বই পড়া দরকার। আবার প্রকৃত জ্ঞানের স্ব্বাভাবিক বিকাশ সাধনের জন্য বই পড়া একান্ত প্রয়োজন। পাঠকসমাজ নিজস্ব পছন্দ ও রুচি অনুযায়ী বই নির্বাচন করে অগাধ জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করতে পারেন। একদিকে স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন; অপরদিকে বিদ্যার্জনের দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। তাই নর-নারীর জন্য বই পড়া ও বিদ্যা শিক্ষা করা ইসলামে অত্যাবশ্যকীয়। আল কোরআনের শিক্ষার আলোকে রাসুলুল্লাহ (সা.) জ্ঞানার্জনের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘বিদ্যা অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর ওপর ফরজ।’ (বায়হাকি)
মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্ম-দর্শন, অনুরাগ-বিরাগ, আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং অন্তরের সত্য ও স্বপ্ন—সবকিছুর সমন্বয়েই বিভিন্ন সাহিত্যের জন্ম। অন্যান্য শাস্ত্রের চেয়ে সাহিত্যই এসবের পরিপূর্ণতা দিতে সক্ষম। এ জন্য বেশি বেশি বইপুস্তক অধ্যয়ন করতে হবে। বই পড়া ছাড়া শিক্ষা-সাহিত্য, কৃষ্টি-সভ্যতা ও সংস্কৃতিচর্চার অন্য কোনো উপায় নেই। বই পড়ার নির্মল আনন্দ মানুষের মনে পুষ্টি জোগায়, তার ভেতরকার সুকুমারবৃত্তিগুলোকে প্রস্ফুটিত করে তোলে। মানুষের জন্য অকল্যাণকর বিষয় বর্জনের জন্য পবিত্র কোরআন ও হাদিসে একাধিবার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। সেই শিক্ষাই মানুষের জন্য অত্যাবশ্যক, যা তাদের প্রকৃত সত্যের আলো দেখায়, সরল সঠিক পথে পরিচালিত করে এবং মানবতার কল্যাণ সাধন করে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে, তখন তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়; কিন্তু তিনটি আমলের সওয়াব জারি থাকে। ১. সাদকায়ে জারিয়া, ২. এমন বিদ্যা (বই-পুস্তক); যা থেকে লাভবান হওয়া যায় এবং ৩. সুসন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।’ (মুসলিম)
জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতি ও শিল্প-সাহিত্য চর্চা শিক্ষার অন্যতম প্রধান অঙ্গ। সাহিত্য চর্চা ছাড়া কোনো ধর্মপ্রাণ জাতির সুস্থ মানসিকতা ও কল্যাণকর মনোভাব গড়ে উঠতে পারে না। তাই আদর্শ শিক্ষকসমাজ ছাত্রদের মনে জ্ঞানের কৌতূহল সৃষ্টি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজ্ঞাকে সদা জাগ্রত রাখতে পারে, তার আত্মাকে উদ্বোধিত করে জ্ঞান পিপাসায় উন্মত্ত করতে পারে; একে নিবৃত্ত করতে হলে পাঠ্যাভ্যাসের বিকল্প নেই। রুচিশীল সাহিত্যের বিস্তৃত পরিসরে বিচরণের মাধ্যমেই আল্লাহভীরু মানুষের চরিত্রের মহৎ গুণাবলি ও সামাজিক মূল্যবোধ অর্জিত হয়ে থাকে। এমন মহৎপ্রাণ ব্যক্তিরা তাঁদের উন্নত চিন্তা-চেতনা এবং মেধা-মননশীলতা কাজে লাগিয়ে দেশ ও জাতির অনেক বৃহত্তর কল্যাণ সাধন করতে পারেন। পবিত্র কোরআন এসব শিক্ষা মানুষের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বলেছে, ‘যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে, তাদের জন্য রয়েছে ইহকাল ও পরকালে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না।’ (সূরা আন-নূর, আয়াত-১৯)
‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না’ এ কথা সবারই জানা। প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে, মানুষকে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করতে বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। আসুন, প্রাত্যহিক জীবনে অযথা খরচ বা অহেতুক অর্থ অপচয় বর্জন করে একুশে গ্রন্থমেলা থেকে পছন্দমতো বই-পুস্তক ক্রয় করি; দেশের নারী-পুরুষ, তরুণ-যুবক, শিশু-কিশোরদের বই কেনা ও সংগ্রহের জন্য উৎসাহিত করি, যাতে সব বাংলা ভাষাভাষী কোটি কোটি জনগোষ্ঠীর বই পড়ার মানসিকতা তৈরি হয় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পাঠাগারে মূল্যবান গ্রন্থ সংগ্রহে অনুপ্রাণিত হয়ে সত্যিকারের বাংলা মায়ের সন্তান হিসেবে পাঠ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.