ভাষার মাস- কত ভালোবাসি বাংলা ভাষা! by মশিউল আলম

মাতৃভাষার প্রতি আবেগ বলে যদি কিছু থাকে, তবে আমাদের সেই আবেগ প্রকাশের মাস শুরু হলো। পুরো ফেব্রুয়ারি মাসে সংবাদপত্রের লেখালেখি, টেলিভিশনের টক-শো, মাঠে-মিলনায়তনের অনুষ্ঠানে, গান ও কবিতার উৎসবে, বাংলা একাডেমীর গ্রন্থমেলায় এবং বিশেষত একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকাসহ সারা দেশের শহীদ মিনারগুলোতে প্রকাশ পাবে মাতৃভাষা বাংলার প্রতি আমাদের আবেগ।
আবেগ নানা রকমের হয়; ভালোবাসা সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ আবেগ। মাতৃভাষা বাংলার প্রতি আমাদের ভালোবাসার স্বাক্ষর আছে আমাদের ইতিহাসে; ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রক্তের অক্ষরে লেখা হয়েছে সেই ইতিহাস। বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসা আছে—এমন কথা বলা হয় আজও, যখন ইংরেজি ভাষার সর্বমুখী আধিপত্যের পরিবেশে আমাদের আরও ভালোভাবে অভিযোজনের চেষ্টা চলছে, যখন জনপ্রিয়তম জনমাধ্যমে চলছে ‘হিন্দির আগ্রাসন’। কিন্তু ফেব্রুয়ারি না এলে আমাদের স্মরণ হয় না বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসার জন্য শহীদ ভাইদের রক্তে রাঙা হয়েছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। ‘আমি কি ভুলিতে পারি’ কেবল ফেব্রুয়ারির গান। আর কী অদ্ভুত ব্যাপার, ফেব্রুয়ারি না এলে বোঝা যায় না এ দেশে বাংলা ভাষায় বই লেখা হয়, সেসব বই ছাপা হয়; ফেব্রুয়ারি না এলে টের পাওয়া যায় না এ দেশে মানুষ বাংলা ভাষায় লেখা বই কেনে ও পড়ে।
অবশ্য দেশের সিংহভাগ বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে বাংলায়। বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, পৌরনীতি, এমনকি ধর্মও তারা পড়ে বাংলা ভাষায়। ইংরেজি ভাষা বিদ্যালয়ে আছে, কিন্তু সেখানে তার দাপট নেই। বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক বাংলা ভাষায় রচিত, শিক্ষকদের শিক্ষাদানের ভাষাও বাংলা; এমনকি ছেলেমেয়েদের ইংরেজি ভাষাটি শেখানোর কাজেও তাঁদের ব্যবহার করতে হয় বাংলা ভাষা। কিন্তু দেশের সব বিদ্যালয়ের চিত্র এটা নয়: অনেক বিদ্যালয় আছে, যেখানে সব বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয় ইংরেজি ভাষায়। শ্রেণীকক্ষের বাইরেও শিশুদের ইংরেজি বলার চেষ্টা করতে হয়; চেষ্টা করতে হয় বাংলা ভুলে থাকার। এ ধরনের অনেক বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ইংরেজি চর্চার ফলপ্রসূতা বাড়াতে বাড়িতেও ইংরেজিতে কথা বলায় উৎসাহিত করে। ইংরেজি মাতৃভাষা নয় বলে এ ভাষা শিখতে নিষ্ঠার সঙ্গে পরিশ্রম করতে হয়। কোনো মাধ্যমের বিদ্যালয়েই বাংলা শেখার কোনো বালাই নেই।
বাংলা তো মায়ের ভাষা, এ আবার শিখতে হয় নাকি? আর বাংলা ভাষাটা কী এমন কাজে লাগে? নির্ভুল সুন্দর বাংলা লিখতে জানলে কি বেশি বেতনের চাকরি পাওয়া যায়? চাকরিতে শনৈ শনৈ উন্নতি হয়? লোকে সমীহ করে? মোটেও নয়। আপনি যদি শুদ্ধ করে একটি বাংলা বাক্যও লিখতে না জানেন, চাকরির বাজারে আপনার কোনো সমস্যা হবে না, যদি আপনি ইংরেজিটা জানেন। আপনি যদি শিক্ষিত লোকের মতো বাংলা না জানেন, কেউ আপনাকে মূর্খ বলবে না, যদি আপনি ইংরেজি জানেন। কিন্তু ইংরেজি না জানলে চাকরির বাজারে আপনার ‘ভাত নাই’। ইংরেজি না জানলে বন্ধুবান্ধব আপনাকে বলবে মূর্খ।
একবার এক অভিজাত বাঙালি ভদ্রলোক আমাদের এই পত্রিকার চিঠিপত্র কলামের জন্য একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। চিঠিটি তিনি লিখেছিলেন ইংরেজিতে। সেটি অনুবাদ করার দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর। ভদ্রলোক বাঙালি বলে, আর আমার বয়স তখন বেশ কম বলে, জাতীয়তাবাদী অভিমান থেকে আমি সেই চিঠি অনুবাদ করব না বলে গোঁ ধরেছিলাম। আমার বিভাগীয় প্রধানের কাছে পাল্টা যুক্তি তুলে ধরেছিলাম এই বলে: ইংরেজি পত্রিকার চিঠিপত্র কলামে যদি আমি বাংলায় চিঠি লিখে পাঠাই, তাহলে কি সেই পত্রিকা আমার চিঠিটা ইংরেজিতে অনুবাদ করে ছাপাবে?
আমার যুক্তিটা গুরুত্ব পায়নি, বরং ছেলেমানুষি আবেগ বলে স্বীকৃতি পেয়েছিল। যদি জানতে চান, সেই চিঠিটা আমি অনুবাদ করেছিলাম। এখনো আমি অনেক ইংরেজি লেখা অনুবাদ করি; সেগুলো সব ইংরেজভাষীদের লেখা নয়; বাঙালির লেখা ইংরেজিও বাংলায় ভাষান্তর করি। কিন্তু ইংরেজদের লেখা ইংরেজি অনুবাদ করতে যতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ হয়, বাঙালিদের লেখা ইংরেজি ততটা নয়। মনে হয়, সেই বালখিল্য অভিমানটাই কাজ করে আমার মনের গভীরে।
কিন্তু অভিমানে কী এসে যায়? পাড়ার লন্ড্রি, মুদির দোকানের রসিদটাও যে ইংরেজি। বড় বড় চেইন শপের কথা বাদই দিলাম। মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপন ইংরেজিতে, কখনো কখনো বাংরেজিতে। এই দেশে যারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, তারা কি বাংলা জানে না? তাদের ভাষা কি ইংরেজি? লাখ লাখ টাকা খরচ করে আবাসিক ভবন নির্মাণপ্রতিষ্ঠানগুলো যে ইংরেজিতে বিজ্ঞাপন প্রচার করে, তা ইংরেজি ভাষাভাষী লোকদের আকৃষ্ট করতে? আর তারা ভবনগুলোর নামও রাখে ইংরেজি, যেন বাংলা নাম দিলে ফ্ল্যাট বিক্রি হবে না। কয়েকটি এফএম বেতারকেন্দ্র বাংলা ভাষার ব্যবহারে চমক দেখাচ্ছে ইংরেজি উচ্চারণে বাংলা প্রচার করে। ইদানীং আমাদের অগ্রসর চলচ্চিত্রকারেরা ছবির নাম হিসেবে ব্যবহারের জন্য বাংলা শব্দ খুঁজে পাচ্ছেন না (ব্যাচেলর, মেড ইন বাংলাদেশ, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, টেলিভিশন ইত্যাদি); গল্পকার-ঔপন্যাসিকদের অনেকের মধ্যেও একই ঝোঁক। বাঙালি চিত্রশিল্পীদের আঁকা ছবির নাম যে বাংলা হয় না—এটাই যেন প্রতিষ্ঠিত ব্যাপার।
একবার ফার্মগেট থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত রাস্তার দুপাশের দোকানপাট ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাইনবোর্ড জরিপ করেছিলাম: ৯৮ শতাংশ নাম বাংলা নয় (ইংরেজি, আরবি, ফারসি)। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গুটিকয় ব্যাংক (সোনালী, রূপালী, পূবালী, অগ্রণী, জনতা) বাদে সব ব্যাংক-বিমা প্রতিষ্ঠানের নাম ইংরেজি। ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাংলাভাষী, গ্রাহকেরাও বাংলাভাষী। কিন্তু টাকা-পয়সা লেনদেনের কাজে কোনো বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে এক হরফ বাংলা চলে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষকেরা সন্দর্ভ লেখেন বাংলায় নয়, ইংরেজিতে। তাঁরা সম্ভবত ভাবতেও পারেন না যে গুরুত্বপূর্ণ ও বিশদ গবেষণা-সন্দর্ভ বাংলা ভাষায় রচনা করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক পরিসরে যোগাযোগের খাতিরে তাঁরা হয়তো গবেষণাপত্র লেখায় ইংরেজি ভাষার সুবিধাটাকে প্রাধান্য দেন। কিন্তু নিজেদের শিক্ষার্থীদের জন্য মাতৃভাষা বাংলায় পাঠ্যবই রচনা করতেও তো তাঁদের তেমন দেখা যায় না। ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান ইত্যাদি অগ্রসর ও বড় জাতির কথা বাদ দিলাম, ফিনল্যান্ডের লোকেরাও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনা করে মাতৃভাষা ফিনিশে, যে ভাষায় কথা বলে মাত্র ৫০ লাখ মানুষ। নরওয়েজিয়ান ভাষাভাষী লোকের সংখ্যাও প্রায় ৫০ লাখ; সে দেশেও উচ্চতর মানবিক ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়া হয় মাতৃভাষায়। সুইডিশ ভাষায় কথা বলে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ। তারাও বিদ্যাশিক্ষা থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য—সবকিছুই চালায় মাতৃভাষা সুইডিশে। চীন ও ব্রাজিল—পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দুটি দেশে ইংরেজি ভাষার অভ্যন্তরীণ ব্যবহার নেই। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ছাড়া অন্য কোনো কাজে তারা বিদেশি ভাষা ব্যবহার করে না।
ইংরেজি ছাড়া আমাদের উন্নতি-অগ্রগতি হওয়ার নয়—এ কথা হয়তো ব্যবহারিক দিক থেকে সত্য। বাংলার এমন বিকাশ ঘটেনি যে এ ভাষায় উচ্চতর পর্যায়ের জ্ঞান-বিদ্যাচর্চা ও গবেষণা করা যায়। কিন্তু কেন সেভাবে বিকাশ ঘটেনি? সে রকম বিকাশের কোনো সম্ভাবনা কি বাংলা ভাষার মধ্যে ছিল না? কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের মতো গ্রন্থ রচিত হয়েছে যে ভাষায়, সেই সংস্কৃতের উত্তরাধিকার কি বাংলা বহন করে না? দর্শনের অনেক গভীর বিষয়ের চর্চা হয়েছে যে পালি ভাষায়, সেই ভাষার উত্তরাধিকারও কি বাংলায় নেই? অবশ্যই আছে। কিন্তু মাতৃভাষা বাংলাকে সেভাবে বিকশিত করার উদ্যম ও উদ্যোগ আমাদের ছিল না। স্বাধীনতার পর বাংলায় বিজ্ঞান, গণিতসহ বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ্যবই লেখা শুরু হয়েছিল, কিন্তু চর্চাটা আর অগ্রসর হয়নি। ইতিমধ্যে আমাদের মোহ জেগে ওঠে ইংরেজির প্রতি; এই মোহ সম্ভবত ঔপনিবেশিক আমলের চেয়েও তীব্রতর। ইংরেজির মোহে আজ অনেক উচ্চশিক্ষিত বাঙালি ‘আমি তো বাংলা লিখতে পারি না’ বলে গৌরব প্রকাশ করে। সে যে ইংরেজিটাও শুদ্ধ করে লিখতে জানে না, সেটাও তার জানা নেই।
ইংরেজির সঙ্গে বা অন্য কোনো বিদেশি ভাষার সঙ্গে বাংলার কোনো বিরোধ নেই। বরং শুধু ইংরেজি কেন, আমরা যদি ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ, চীনা, জাপানি, হিন্দি ইত্যাদি অগ্রসর ও দ্রুত অগ্রসরমান জাতিগুলোর ভাষাও শিখতে পারতাম, অনেক ভালো হতো। কিন্তু মাতৃভাষা বাংলার প্রতি আমাদের ভালোবাসা কিসে প্রকাশ পায়, সেটাই তো বোঝার উপায় নেই। ইংরেজি জানা গৌরবের বিষয় হতে পারে, কিন্তু বাংলা না-জানাও যে গৌরবের বলে অনেক তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ বাঙালি মনে করে—এই বেজাতপনার প্রতিকার কী?
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.