গ্যাস ও গার্মেন্ট এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি by বদরুদ্দিন আহমদ

১৯৫২ সালে সর্বজনশ্রদ্ধেয় ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কার্জন হলে এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণকে অনেকেই ভীতির চোখে দেখে থাকেন।
তারা বলেন, বাংলাদেশের জনবিস্ফোরণ বন্ধ করতে না পারলে দেশের কল্যাণ নেই, দেশের সব উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হবে। কথাটি সত্য নয়। জনশক্তি দেশের বড় সম্পদ। সে দিন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কথা উপলব্ধি করতে পারিনি। কিন্তু আজ দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশ বিদেশে মানুষ রফতানি করে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলেছে।

পাকিস্তান সৃষ্টির গোড়ার দিকেই পশ্চিম পাকিস্তান পৃথিবীর অনেক দেশেই মানবসম্পদ রফতানি করে নিজেরা লাভবান হয়ে এসেছে। পশ্চিম পাকিস্তান এই খাতেও বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে এসেছে। আমাদের ছেলেরা তখন ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে চাকরি পাওয়ার আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছে। তখন সরকারি হাসপাতালে চাকরির কোটা সীমিত ছিল। দেশে উন্নয়নমূলক কাজ না থাকলে ইঞ্জিনিয়ারদের বেকার থাকতে হয় কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির গোড়ার দিক থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান শত শত ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার ও শ্রমিক বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে।

তখন পাকিস্তানের রাজধানী ছিল করাচিতে। কাজের চাহিদা অনুযায়ী বিদেশী রিক্রুটিং এজেন্সি পাকিস্তানের Foreign office-এর সাথে যোগাযোগ রয়েছে। পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ইচ্ছুক প্রার্থীদের চাকরির জন্য যোগাযোগ করতে বলেছে, Foreign office-এর প্রদত্ত বিধিমালায়। করাচিতে Interview হতো। ফলে আমাদের ছেলেরা এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারেনি।

আমার এক আত্মীয় চার-পাঁচ বছর ডাক্তারি করে সুবিধা করতে পারেনি। নিজের মহকুমা শহরে নিজেদের বাড়িতে চেম্বার করে বসে। কিন্তু গরিব আত্মীয়স্বজনও চিকিৎসার জন্য তার কাছে আসত। আমার সেই আত্মীয় ওই সব লোকদের কাছ থেকে ফি আদায় করতে সঙ্কোচ বোধ করতেন। ফলে অর্থকষ্টে ভুগতে হয়েছে তাকে। একদিন তার এক শ্যালক পাকিস্তানের ডন পত্রিকা হাতে করে ডাক্তার সাহেবের কাছে এসে পত্রিকাটি তার হাতে দিয়ে বললেন, এই বিজ্ঞপ্তিটি দেখুন। লিবিয়ায় ডাক্তার নেবে। ইচ্ছা হলে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। বিজ্ঞপ্তিটা দেখে ডাক্তার সাহেব বললেন, এ তো খুব ভালো চাকরি কিন্তু করাচি গিয়ে Interview দেবো কী করে? ডাক্তার সাহেব তার বড় ভগ্নিপতি বিচারপতি এ কে এম নূরুল ইসলামের সাথে দেখা করে বিজ্ঞপ্তি তার হাতে দিয়ে বললেন, লিবিয়ায় ডাক্তার নেবে, তারই বিজ্ঞপ্তি। তার ভগ্নিপতি বিজ্ঞপ্তিটি দেখে বললেন, এ তো খুব ভালো চাকরি। তুমি কি যাবে? ডাক্তার সাহেব বললেন, করাচি যাওয়ার টাকা তো আমার নেই। চেনাজানা লোক নেই, কোথায় গিয়ে উঠব। বিচারপতি সাহেব তখনই করাচিতে তার এক আত্মীয়ের কাছে টেলিফোনে বললেন ঘটনার কথা। তিনি শুনে বললেন, ইন্টারভিউ দিলে অবশ্য ডাক্তারের চাকরি হয়ে যাবে। করাচিতে আমার বাসায় থাকবে। আপনি শিগগির ওকে পাঠিয়ে দেন।
ডাক্তার করাচি গিয়ে ইন্টারভিউ দিলেন। চাকরি হয়ে গেল। তিনি করাচি থেকে ফিরে এসে কয়েক দিনের মধ্যেই স্ত্রীকে নিয়ে লিবিয়া চলে গেলেন।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর করাচি ছিল পাকিস্তানিদের রাজধানী। বিদেশী এজেন্সিরা যারা লোক রিক্রুট করার জন্য পাকিস্তানে আসত তারা করাচিতে অবস্থিত ফরেইন অফিসের সাথে প্রথম যোগাযোগ করত। তারা খবরের কাগজে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে লোক রিক্রুট করত। ফলে বাংলাদেশীরা এই সুযোগ নিতে পারত না।

কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের তরুণসমাজের কাছে অফুরন্ত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এখন শুধু লিবিয়া নয়, মধ্যপ্রাচ্যে লাখ লাখ বাঙালি চাকরি করছে। ইউরোপের জার্মান ও ইতালিতে বহু বাঙালি রয়েছে। এখন মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়াতেও বহু বাংলাদেশী চাকরি করছে। আমেরিকায় কয়েক লাখ বাঙালি আছে সবাই নিয়মিত রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে দেশে। কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় নাগরিকত্ব নিয়ে বহু বাংলাদেশী স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। আজ প্রায় ৮০ লাখ বাঙালি শ্রমিক বিদেশে চাকরিরত। ফলে অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ আজ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।

আজ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কথা মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, দক্ষ জনশক্তি দেশের সম্পদ। পাট শিল্প পাকিস্তানের শেষের দিকে ধ্বংস হয়ে যায়। এই পাট রফতানি করে পাকিস্তান ৬০ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে। এর সবটাই এসেছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে, একমাত্র পাট থেকে অর্জিত অর্থে গোটা পাকিস্তানের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশে পাটশিল্প ধ্বংস হলো কিন্তু বিকল্প গার্মেন্ট শিল্প গড়ে উঠল। পৃথিবীতে বিদেশে রফতানিকারক দেশের মধ্যে চীনের পরেই বাংলাদেশের স্থান। আজ গার্মেন্টে লাখ লাখ মেয়ে কাজ করছে। তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। ছেলেমেয়েদের শিক্ষার দিকে জোর দিতে পারছে। বাংলাদেশে শিক্ষার হার দ্রুতগতিতে বেড়ে যাচ্ছে।

কিন্তু এই শিক্ষাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চলছে। এসব ফ্যাক্টরিতে কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই সে দিন আশুলিয়ায় এক গার্মেন্টে আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করেছে ১৬৫ জন শ্রমিক। আহত অবস্থায় বেঁচে আছে শতাধিক মানুষ। এদের নিরাপত্তা বিধান করার দায়িত্ব আমাদের সরকারের। কিন্তু তারা নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের দেশের কোনো মানুষের নিরাপত্তা নেই। আমাদের দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে গড়ে ১২ জন লোক। নানা ধরনের নিপীড়নে বিরোধী দলের নেতৃস্থানীয় লোক মারা যাচ্ছে। মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে সাংবাদিকদেরও। তা ছাড়া এ সরকার পুলিশ দিয়ে পেটাচ্ছে শত শত মানুষ। বিনা বিচারে আটক রয়েছে হাজার হাজার মানুষ। এই শাসন আমলকে নব্য বাকশালী শাসন বলা যেতে পারে। একটা কথা আমরা বুঝতে পারি না, শেখ হাসিনা মিগ ২৯ বিমান রাশিয়া থেকে ক্রয় করল। সেই বিমান আকাশে উড়তে পারে না। এসব বিমান গোডাউনে রাখা আছে সম্ভবত। এই বিমান ক্রয়ের দালাল তার দালালি অর্থ দিয়ে পাঁচতারকা হোটেল করেছে।

তা ছাড়া সে দিন শেখ হাসিনা রাশিয়া গিয়েছিলেন অস্ত্র কেনার চুক্তিতে সই করার জন্য। ১০ হাজার কোটি টাকার অস্ত্রচুক্তি সম্পাদন করে এসেছেন। এতে কেউ না কেউ দালালি বাবদ পেয়ে থাকবেন কয়েক হাজার কোটি টাকা। এর সাথে জড়িত ক্ষমতাধরদের আত্মীয়দের নাম শোনা যাচ্ছে। পৃথিবীতে বাংলাদেশের মতো লুটপাটের ঘটনা অন্য দেশে নেই। আমাদের সম্পদের উৎস থাকা সত্ত্বেও আমরা অতলে তলিয়ে যাচ্ছি। সবার প্রতি আহ্বান এ অপশাসন থেকে দেশকে মুক্ত করুন।

লেকক : আইনজীবী ও প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.