এলো ভাষার মাস-আনুষ্ঠানিকতার পাশাপাশি আন্তরিকতাও প্রয়োজন

বছর ঘুরে আবার এলো ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের এই মাসেই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার প্রয়োজনে রক্ত দিয়েছিল বাংলার অসম সাহসী তরুণরা। পাকিস্তানি বুলেটও সেদিন তাদের দমাতে পারেনি। সেদিনের সেই আত্মদানই পরবর্তীকালে রূপ নিয়েছিল বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলনে।
পাকিস্তানি শাসক এবং তাদের দোসরদের সব চক্রান্ত, সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বাঙালি জাতি এগিয়ে গেল তার অভীষ্ট লক্ষ্যে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম হলো স্বাধীন বাংলাদেশের। তাই এই ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে আমাদের এত অহংকার, এত গর্ব। ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা ফিরে তাকাই আমাদের শিকড়ের দিকে। আমাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য নতুন করে আমাদের এগিয়ে চলার প্রেরণা জোগায়। সংগত কারণেই ভাষার মাস নিয়ে আমাদের মধ্যে একটি অন্য রকম আবেগ কাজ করে। সেই আবেগের বহিঃপ্রকাশ থাকে মাসজুড়েই। আজ শুরু হচ্ছে অমর একুশের বইমেলা। শহীদ মিনারে শুরু হচ্ছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ফেব্রুয়ারিজুড়ে চলবে একুশের অনুষ্ঠানমালা।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' দাবি নিয়ে রাজপথে নামা বাঙালিদের ওপর গুলি চালিয়েছিল পাকিস্তানি শাসকচক্র। শহীদ হয়েছিলেন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেক নাম না-জানা মানুষ। মাতৃভাষার জন্য বুকের রক্ত দেওয়ার এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আর সেই বিরল আত্মদানের স্বীকৃতিও মিলেছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবীতে আজ একুশে ফেব্রুয়ারিকে পালন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হচ্ছে সেই অমর শহীদদের, যাঁরা ভাষার জন্য তাঁদের জীবন দিয়ে গেছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বত্র বাংলার প্রচলন নিশ্চিত করতে পারিনি। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নিচ্ছি। সাইনবোর্ড, ব্যানার, বিজ্ঞাপন, সরকারি দপ্তরের নথি, সংবাদপত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার খাতা থেকে শুরু করে প্রায় সর্বত্রই রয়েছে ভুল বানানের ছড়াছড়ি। ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, এরপর ১৯৯৪ সালে বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম করেছে, অথচ আমরা বাংলা লিখছি যে যার ইচ্ছামতো।
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার যে উচ্চমর্যাদা প্রাপ্য ছিল, আমরা কি তা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি? কেবল কাগজে-কলমেই বাংলা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজে এখনো বাংলা ভাষার ব্যবহার খুবই কম। এখনো সেখানে ইংরেজিরই প্রাধান্য। বেসরকারি খাতে ব্যবসা-বাণিজ্যে বাংলা ভাষার স্থান নেই বললেই চলে। ১০০ বছর আগেও একটি ভিন্ন চিত্র আমরা দেখতে পাই। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ শুধু ইংরেজি নয়, ১৮টি ভাষায় দক্ষতা লাভের পরও বাংলাকে এগিয়ে নিয়েছেন। জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানীরাও বাংলায় তাঁদের গবেষণাপত্র ও অন্যান্য রচনা উপস্থাপন করেছেন।
তাই কেবল আনুষ্ঠানিকতা ও আবেগের মধ্যে থাকলেই হবে না, বাংলা ভাষায় উচ্চতর গবেষণা, উচ্চশিক্ষা এবং প্রাত্যহিক জীবনে শুদ্ধরূপে ভাষা চর্চার জন্য পর্যাপ্ত উদ্যোগ নিতে হবে এবং সেখানে রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ আন্তরিকতার পরিচয় দিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.