একুশের চেতনা বনাম বর্তমান বাস্তবতা by মোফাজ্জল করিম

১৯৪৭ সালের আগস্টে ব্রিটিশরাজের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষ স্বাধীন হলো। আমরা, অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের মানুষরাও স্বাধীন হলাম। দ্বিখণ্ডিত ভারতবর্ষের পাকিস্তান অংশের নাগরিক হলাম আমরা। বিশ্বে আমাদের পরিচিতি হলো পাকিস্তানি হিসেবে।
পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সঙ্গে হাজার-বারো শ মাইল দূরের পূর্ব বাংলাকে জুড়ে দিয়ে যে নতুন দেশ সৃষ্টি হলো তার নাম পাকিস্তান। আমরা তার বাসিন্দা।
২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের বাস্তবতার নিরিখে পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সমাজ নির্দ্বিধায় মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে পাকিস্তান আন্দোলনে শুধু যোগদানই করেনি, এই ভূখণ্ডের প্রথিতযশা মুসলমান নেতারা, যেমন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আকরম খাঁ, আবুল হাশিম, খাওয়াজা নাজিমউদ্দিন প্রমুখ বিশিষ্টজন মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক আবাসভূমি- পাকিস্তান- অর্জনের সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন।
দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর ব্রিটিশ শাসকবর্গ, ভারতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয় ইংরেজদের ভারতবর্ষ ত্যাগের ব্যাপারে। স্থির হলো, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো নিয়ে মুসলমানদের জন্য পৃথক একটি রাষ্ট্র গঠিত হবে। সমস্যা দেখা দেয় পশ্চিমে পাঞ্জাব ও পূর্বে বাংলা প্রদেশ দুটি নিয়ে। এই দুই প্রদেশে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা প্রায় সমান সমান হওয়ায় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কেউই এগুলোর দাবি ছাড়তে রাজি ছিল না। ফলে ইংরেজরা এই দুই প্রদেশকে ভাগ করে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের সঙ্গে জুড়ে দেয়। বঙ্গদেশকে ভাগ করার দায়িত্ব দেওয়া হয় স্যার সিরিল র‌্যাডক্লিফ নামের এক ইংরেজকে। তিনি বানরের পিঠা ভাগের মতো পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরাকে সুতীক্ষ্ণ ছুরি দিয়ে কেটেকুটে যে ভূখণ্ডটিকে পূর্ববঙ্গ বলে ঘোষণা দিলেন, দেখা গেল তার থেকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অন্যায়ভাবে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ সমৃদ্ধ এলাকা ইন্ডিয়াকে উপহার হিসেবে দিয়ে দিয়েছেন। জিন্নাহ সাহেবের তাড়া ছিল বোধ হয় একটি স্বাধীন-সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্রের জনক হওয়ার, তাই র‌্যাডক্লিফের এই অবাঞ্ছিত সিজারিয়ান অপারেশনে তিনি কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না- কর্তিত প্রত্যঙ্গসহ পূর্ববঙ্গ 'আযাদ' পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ হিসেবে স্বাধীন হয়ে গেল।
আমাদের শৈশবে, ১৯৪৭-এ আমি ক্লাস টুতে পড়ি, আমরা আমাদের অগ্রজদের নেতৃত্বে মিটিংয়ে-মিছিলে 'লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান,' 'ছিনকে লেঙ্গে পাকিস্তান,' 'আযাদ করেঙ্গা পাকিস্তান' ইত্যাদি স্লোগান দিয়েছি। সারা বাংলাদেশে একমাত্র বৃহত্তর সিলেটে গণভোট হয়েছিল পাকিস্তান ইস্যুর ওপর। ফলে হৈচৈ-চেঁচামেচিটা ওখানেই বেশি হয়েছিল। আর লক্ষণীয় বিষয় হলো, লড়কে, ছিনকে, লেঙ্গে, করেঙ্গা, আযাদ ইত্যাদি শব্দে ভরপুর ছিল আন্দোলনের ভাষা। বলা হতো, আযাদ পাকিস্তান- স্বাধীন পাকিস্তান নয়। এসব শব্দ বাংলা শব্দ ছিল না। তবু আন্দোলনের জোশে এগুলোর ব্যবহারে কেউ আপত্তি তোলেননি।
কিন্তু গোল বাঁধল তখনি, যখন এসব ভাড়াটে শব্দ তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার পরও 'বাড়ি খালি' করতে চাইল না, বরং জাঁকিয়ে বসে রইল। শুধু তাই নয়, বাংলার আদি ও অকৃত্রিম 'মালিক' বাংলা শব্দগুলোকে হটিয়ে দিয়ে তাদের স্থান দখল করতে তৎপর হয়ে উঠল তারা। তখন নেতৃত্ব ষোল আনাই পশ্চিম পাকিস্তানি পাঞ্জাবি-সিন্ধি-বালুচি-পশ্তুভাষীদের হাতে। খুব দৃঢ়ভাবে না হলেও উর্দু ছিল তাদের লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা। বঙ্গভাষাভাষী কেউ তাদের সঙ্গে উর্দুতে বাতচিত করলে স্বভাবতই তারা খুব প্রীত বোধ করত। আর এই সুযোগে পূর্ববঙ্গের উঠতি চামচার দলও উর্দু ও উর্দুমিশ্রিত বাংলা দেদারসে 'এস্তেমাল' করতে লাগল!
বাংলা ভাষার আকাশে এভাবে যখন দুর্যোগের কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে তখনি বজ পাত ঘটালেন, আর কেউ নন, স্বয়ং পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনি বোধ হয় পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের নাগরিকদের, অর্থাৎ সেই সময়ের (১৯৪৭-৪৮) পূর্ব বাংলার চার কোটি মানুষকে, তখনো চিনে উঠতে পারেননি। হতেও পারে। কারণ তিনি তো তাঁর শৈশব-ছাত্রজীবন-কর্মজীবন সবই কাটিয়েছেন মুম্বাই-করাচি-লন্ডনের উর্দু-ইংরেজি পরিবেশে, 'সুবেহ্ বাঙালের' সঙ্গে তাঁর পরিচয় তো খুবই স্বল্পকালীন, তাও কিছুসংখ্যক শিক্ষিত 'এলিট' শ্রেণীর মানুষ, যাদের অনেকের মাতৃভাষা বা পরিবারে ব্যবহৃত ভাষা ছিল উর্দু, তাদের মাধ্যমে। ফলে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার মাত্র কয়েক মাস পর ডিসেম্বর মাসে বাংলা মুলুকে প্রথম সফরে এসেই জিন্নাহ সাহেব ফাউল করে বসলেন : তিনি তখনকার রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল জনসভায় ঘোষণা দিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারীদের সভায় গলায় আরো তেজ ঢেলে দিয়ে বললেন সেই কৃশকায় বৃদ্ধ, যাঁকে বাঙালি মুসলমান আগাগোড়া তাদের অবিসংবাদী নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছিল : উর্দু, অ্যান্ড অনলি উর্দু, শ্যাল বি দ্য স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান। রেসকোর্স ময়দানের পাবলিক মিটিং ও কার্জন হলের বিশেষ সমাবেশ- দুটো স্থানেই হাজিরানে মজলিস তাৎক্ষণিকভাবে এর প্রতিবাদ জানাল।
আর সেই থেকে শুরু হলো পূর্ব বাংলা (বছর কয়েক পরে 'আকিকা করে' সরকারিভাবে নাম রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান) ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিভাজন। ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য- সব কিছু থেকে বাঙালিয়ানা আস্তে আস্তে মুছে ফেলে ইসলামীকরণের নামে, পাকিস্তানের অখণ্ডতার দোহাই দিয়ে, শুরু থেকে সুকৌশলে পাকিস্তানীকরণের যে অপচেষ্টার সূত্রপাত করা হয়েছিল জিন্নাহ সাহেবের রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত ঘোষণার মধ্য দিয়ে, তা পরিষ্কার হয়ে গেল। বলা যায়, তাঁর বক্তৃতার মধ্য দিয়ে থলের বেড়াল বেরিয়ে এলো। আর ফুঁসে উঠল পূর্ব বাংলার জনগণ।
জিন্নাহ সাহেব, আগেই বলেছি, তাঁর ক্যারিয়ারে এ দেশের মানুষকে স্টাডি করার সুযোগ পাননি। তিনি ভেবেছিলেন, রাষ্ট্রভাষা নিয়ে যখন কথাবার্তা শুরু হয়েছে, পূর্ব বাংলার কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিত ব্যক্তি (যেমন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, সৈয়দ মুজতবা আলী, সিলেটের জোবেদা রহিম প্রমুখ) দাবি তুলেছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য, তখন 'বাবায়ে কওমের' (জাতির জনক) সুরক্ষিত মসনদ থেকে তিনি একটি ফরমান জারি করলেই সবাই চুপ মেরে যাবে! দুঃখ হয়, বেচারা লিঙ্কন'স ইনের ব্যারিস্টার সাহেবের জন্য; পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-সুরমা পারের বাঙালিরা যে কী ধাতু দিয়ে তৈরি, তা তিনি জানতেন না। তাঁকে সঠিক মাশায়েরাও দেয়নি তাঁর কোনো চামচা। তিনি হয়তো বাঙালি আর পাঞ্জাবি-পাঠানকে একই ডালের চিড়িয়া মনে করেছিলেন।
এর পরের ইতিহাস বিধৃত করে এই নিবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি করা বাহুল্য মনে করি। এতক্ষণ এই কালোয়াতির মুখ্য উদ্দেশ্যে বরং চলে আসা যাক। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, একুশের রক্তদান, পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ ইত্যাদি বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করা বোধ করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না। স্কুলে সব প্রবন্ধ-নিবন্ধ-গল্প-কবিতা পাঠ করে যেমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় : ইহা পাঠ করিয়া কী শিক্ষা পাইলে, তেমনি আজ ছয় দশক পর যদি আজকের খোকা-খুকুকে প্রশ্ন করি, পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি- এসব ঘটনা থেকে কী শিক্ষা পাইলে, তা হলে আজকের স্মার্ট পড়ুয়ারা তর্জনীর এক গুঁতোয় ইন্টারনেট ঘেঁটে এক মিনিটে এমন সব তথ্য উগরে দেবে, যার অনেক কিছু হয়তো আমরা অর্থাৎ সেই আমলের প্রত্যক্ষদর্শীরাও জানি না। যেকোনো বিষয়ে কম্পিউটার নামক 'ভৌতিক' যন্ত্রটির এই সদাপ্রস্তুত ও সর্বগ্রাসী ভূমিকার জন্য আজকের পৃথিবীর মানুষ কত যে কৃতজ্ঞ, তা বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু তার পরও কিছু কথা থেকে যায়।
আজকের প্রজন্ম জানে কি যে বাঙালির আবহমান কালের যে শিল্প-সংস্কৃতি-কৃষ্টিসমৃদ্ধ নিজস্ব ঐতিহ্য, যাকে ধারণ করে, লালন করে মধ্যযুগের কবি-সাহিত্যিক থেকে শুরু করে মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল সবাই বিশ্বদরবারে এই ভূখণ্ডটির পরিচিতি তুলে ধরেছিলেন, তা সব কালে সব যুগে ছিল আমাদের সব কর্মকাণ্ডের অনুপ্রেরণার উৎস? আমাদের তিতুমীর, ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন এবং তাঁদের অগণিত অনুসারী স্বাধীনতার জন্য আত্মাহুতি দিয়েছেন এই স্বকীয়তাকে বুকে ধরে। আর বাংলা ও বাঙালিকে বিশ্বের দরবারে বিপুলভাবে তুলে ধরেন যে মহাপুরুষ তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজকের প্রজন্ম তাদের ইন্টারনেট আর গুগল থেকে এসব তথ্য কি বিশদভাবে সংগ্রহ করে? না করলে কিন্তু একদিন আসবে যেদিন বাঙালির অবস্থা হবে একটি নামগোত্রহীন জরদ্গব জাতির মতো। তখন বাঙালি শুধু 'মোরে চ্যানো? মোর বাবায় ছেল ছকিদার'- এই বলে তৃপ্তির কড়ুয়া ঢেঁকুরই তুলবে, যে জাতি, যে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ আজ পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তার ঠিকুজি-কুলজি কিছুই জানবে না।
বাঙালি মুসলমান কিন্তু অনেক আশা নিয়ে জিন্নাহ সাহেবের ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। ব্রিটিশ আমলের লাঞ্ছনা-বঞ্চনা ও আধিপত্যবাদের শিকার একদা এই ভূখণ্ডের শাসক মুসলমানদের এ ছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না। ক্রমাগত অর্থনৈতিক ও সামাজিক অনগ্রসরতার কারণে নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে শঙ্কিত বাংলার মুসলমান ব্রিটিশের প্রস্থানের পর অন্য কোনো প্রভুর সেবাদাস হয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ ঝরঝরে করার কথা কল্পনাও করতে পারত না। তারা পাকিস্তানের স্বপ্নে সংগত কারণেই বিভোর হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানের সংগ্রামে। কিন্তু ঝুমকো পাশা, বেলোয়ারি চুড়ি আর রঙিন ফিতার আশায় ঘরছাড়া কিশোরীর মতো দ্রুতই তাদের মোহভঙ্গ হয় পাকিস্তানের সঙ্গে ঘর করতে গিয়ে। দেশটা যদি গাঙ্গেয় বদ্বীপের বাংলাদেশ না হয়ে মানবিক অনুভূতিশূন্য পাঞ্জাবি-পাঠানদের মুলুক হতো, অথবা হতো মধ্যপ্রাচ্যের কোনো শেখের তালুক, তা হলে হয়তো আরো অনেককাল এ দেশের জনগণ বিনা প্রতিবাদে মাটি কামড়ে ওই দুর্বৃত্তের সংসারে পড়ে থাকত অসহায় গ্রাম্য বালাটির মতো। কিন্তু পাকিস্তানিদেরও কপাল মন্দ, তারা জেনে হোক, আর না জেনে হোক, প্রথমেই ঘা দিয়ে বসল আঁতে। কী? না, বাংলা ভাষা খোদা হাফেজ, উর্দু খোশ আমদেদ। বলে কী? এর পর আর মাকে মা বলে ডাকতে পারব না? রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জসীমউদ্দীন পড়তে পারব না? শুনতে পারব না জারি-সারি-মুর্শিদি? গর্জে উঠল বাংলাদেশ। সত্যের খাতিরে আরো স্পষ্ট করে বলতে হয়, গর্জে উঠল পূর্ব বাংলার তরুণ ছাত্রসমাজ। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার মেহেদির রং মুছে যাওয়ার আগেই রক্তে রঞ্জিত হলো ঢাকার রাজপথ। সেই থেকে শুরু। চেতনার জগতে সেই যে ঝড় উঠল, তা উড়িয়ে নিয়ে গেল প্রতিক্রিয়াশীলদের ক্ষমতার মসনদ। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পূর্ণ সমর্থন সত্ত্বেও ভরাডুবি হলো পশ্চিমাদের উচ্ছিষ্টপুষ্ট কদমবুসি বাহিনীর।
সেই যে বাঙালি জাগল, চোখে মায়া-অঞ্জন লাগিয়েও আর তাকে ময়দান থেকে ফিরিয়ে এনে শয্যায় পাঠানো গেল না। বায়ান্নর একুশ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখাল বাঙালিকে। সত্য ও ন্যায়ের জন্য অকুতোভয় বাঙালি অকাতরে বুকের রক্ত দিয়ে ইতিহাস গড়ল। বায়ান্নর পর চুয়ান্ন, চুয়ান্নর পর বাষট্টির পথ ধরে এলো ঊনসত্তর। তারপর এলো বাঙালির জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় : একাত্তর। বাংলার দামাল ছেলেরা গেয়ে উঠল : মাগো, ভাবনা কেন? আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে/তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি/তোমার ভয় নেই মা, আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।
যে কথাটা বলার জন্য আশা-স্বপ্নের স্বর্ণরথে চড়ে এক লহমায় সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত উড়ে চলে এলাম তা একটু স্পষ্ট করে বলা দরকার। বায়ান্নতে রফিক-জব্বার-সালাম-বরকত কেন জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন? (পুরনো) বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা থেকে ছাত্রছাত্রীরা সমূহ বিপদ জেনেও কেন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে প্রাদেশিক পরিষদ ভবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন? কেন বাষট্টিতে, ঊনসত্তরে শহীদের রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল? সর্বোপরি, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় লাখ লাখ বাঙালি কেন এক হিংস্র পশুশক্তির বিরুদ্ধে ইতিহাসের সম্পূর্ণ অসমযুদ্ধে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল, অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল অগণিত মায়ের বুক খালি করে? এসব কি কোনো দলকে, কোনো ব্যক্তিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য? অথবা জায়গাজমি, ঘরবাড়ি, টেন্ডার, ব্যাংকের টাকা, সেতুর টাকা হাতানোর জন্য? এলাকায় রাতারাতি অতিকায় নেতা বনার জন্য? আশা করি, সবাই এক বাক্যে বলবেন, না, বায়ান্ন-বাষট্টি-ঊনসত্তর-একাত্তরের জাতীয় ইস্যুগুলোতে এবং সেসব দিনের ছোট-বড় আরো অনেক আন্দোলনে-সংগ্রামে যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছিলেন তাঁরা কোনো কিছু পাওয়ার জন্য জীবনবাজি রেখে এগিয়ে যাননি। তাঁদের লক্ষ্য ছিল একটাই : অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসত্যের বিরুদ্ধে, দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে রুখে দাঁড়ানো। এই ছিল তাদের আদর্শের সারকথা। কোনো নেতার কাছ থেকে পাওয়া একটি ১০০ টাকার নোট পকেটে গুঁজে তাঁরা মিটিংয়ে-মিছিলে বা রণাঙ্গনে যাননি। ভবিষ্যতে মন্ত্রী-মিনিস্টার হওয়ার আশায় কিংবা গাড়ি-বাড়ি, ব্যবস্য-বাণিজ্য, টেন্ডার-ব্যাংকঋণ পাওয়ার লোভে তাঁরা আন্দোলন-সংগ্রাম করেননি। তাঁরা তাই সাধারণ মানুষের সমর্থন, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা পেয়েছিল। তাঁরা নিজেরাও ছিলেন সাধারণ বাঙালি পরিবারের সন্তান।
আর এখন যারা চর দখলের মতো হলদখল-জমিদখলে মত্ত, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিতে যে বাবাজিরা বিশাল সুনাম অর্জন করেছে, তারাও নাকি ছাত্র! সাধারণ, নিরীহ ছাত্রদের ইজ্জত রক্ষার্থে আজকাল আবার এদের পরিচয় দেওয়া হয় 'ছাত্রনামধারী' বলে। এটা এখন একটা ফ্যাশন হয়ে গেছে। কোথাও চিহ্নিত কোনো ছাত্রসংগঠনের তাবড় তাবড় নেতারাও মারধর-ভাঙচুর-লুটপাট ইত্যাদি করলেও তাদের না চেনার ভান করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে বাকি সবাই। মায় খবরের কাগজও। এসব কীর্তিমানের পরিচয় দেয়ো হয় 'একদল ছাত্রনামধারী দুষ্কৃতকারী' বলে। যেন ভাসুরের নাম মুখে আনতে নেই। যেন ছাত্ররা সবাই ধোয়া তুলসীপাতা, তারা এমন নোংরা কাজ করতে পারে না।
লুটপাট আর দখলবাজি থেকেও বেশি দুঃখজনক হচ্ছে ছাত্রসংগঠনগুলোর নিজেদের মধ্যে মারামারি-খুনোখুনি। বায়ান্নর আদর্শিক ছাত্ররাজনীতির পথ ধরে ষাটের দশকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান প্রভৃতি অনেক ঐতিহাসিক ক্রান্তিলগ্নে ছাত্ররা রাজপথে নেমেছে, আমতলা-বটতলা ইত্যাদিতে মিটিং করেছে, সেসব আন্দোলনের অনেক ছাত্রনেতা এখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বেও আছেন, কিন্তু কেউ কোনোদিন শোনেনি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে কিংবা অন্য কোনো সময়ে একটি ছাত্রসংগঠন আরেকটি সংগঠনের রক্তে নিজেদের হাত লাল করেছে। পুলিশ-মিলিটারির গুলিতে অনেক তাজা প্রাণ ঝরে গেছে ঠিকই, কিন্তু ছাত্ররা একজন আরেকজনের জীবন নিয়েছে- এমনটা শোনা যায়নি। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল সরকারের পোষ্য পেটোয়া সংগঠন এনএসএফ (ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন)। কিন্তু সাধারণ ছাত্রদের প্রচণ্ড ঘৃণার মুখে তারা দ্রুত বিদায় হয় দৃশ্যপট থেকে।
বাষট্টির আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সময় আমরা (ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ) হাত ধরাধরি করে রাজপথে মিছিল করেছি। আবার ছাত্র সংসদ নির্বাচনে এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে নির্বাচনী লড়াইয়েও মেতে উঠেছি। তবে সেখানেও কোনো সহিংস তৎপরতার লেশমাত্র ছিল না। আর এখন শুধু এক দল আরেক দলের লাশ ফেলছে না, নেতৃত্ব-আধিপত্যের লড়াইয়ে নিজেদের মধ্যেও মারামারি-কাটাকাটি চলছে হরদম। একই টেন্ডারের জন্য শুধু বিপক্ষ দলের লোকজনকে ঠেকানোই নয়, নিজেদের ভেতরের অন্য গ্রুপকেও গুলি মেরে, ছুরি মেরে তাড়িয়ে দেওয়ার মারণখেলায় মেতে উঠেছে সেই 'ছাত্রনামধারী কিছু উচ্ছৃঙ্খল যুবক'।
আর এসব কিছু ঘটছে তাদের মুরব্বিদের নাকের ডগায়। তাঁরা দেখেও না দেখার ভান করছেন। ভাবটা এই, এসব করে হাত-পায়ের পেশিগুলো একটু শক্ত-সমর্থ করে নিক না, পরে তো আমাদেরই কাজে লাগবে! এ ধরনের যত অঘটন ঘটছে, দুঃখজনক হলেও সত্য, তার বেশির ভাগই ঘটছে মুরব্বিদের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ মদদে। তা না হলে এসব বন্ধ করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। বিশ্বজিতের খুনিদের দুনিয়ার লোকে চেনে, এমসি কলেজের শতাব্দীপ্রাচীন সুরম্য হোস্টেল যারা সর্বসমক্ষে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করল তারা সিনা ফুলিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু পুলিশ তাদের দেখে না, একটার পর একটা ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে, কোনো বিচার নেই, খুন হচ্ছে রাস্তায়, ফ্ল্যাটে, হাটে-বাজারে, রাতের অন্ধকারে, প্রকাশ্য দিবালোকে- একজন খুনিরও ফাঁসি হয়নি আজও। বরং খুনের দায়ে ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত কয়েদিকে মাফ করে কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনি আরো কত নৈরাশ্যজনক ঘটনার ঘনঘটা। এতে মানুষ ভুগছে চরম হতাশায়, আর অপরাধীরা পাচ্ছে সীমাহীন প্রশ্রয়, দাঁত কেলিয়ে, বুকে থাবড়া মেরে একটার পর একটা অপরাধ করে চলেছে তারা। কর্তাব্যক্তিদের কাছে সবিনয় নিবেদন, যে আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করেছে আপনার প্রতিবেশীর বসতবাটি, তা এক্ষুনি নিয়ন্ত্রণে না আনলে শিগগিরই যে তা আপনার ভদ্রাসনেও ছড়িয়ে পড়বে না তার নিশ্চয়তা কী? তাই বলি, এখনো সময় আছে, 'শিষ্টের দমন ও দুষ্টের পালন' নীতি বর্জন করুন।
আরেকটি কথা। ফ্রাংকেনস্টাইনের হাতেই কিন্তু তার স্রষ্টাও ধ্বংস হতে পারে, দুধকলা দিয়ে যে কালকেউটেকে পোষা হয়, এক সময় তার দংশনে তার পোষকেরও ভবলীলা সাঙ্গ হতে পারে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে : দেয়ার ইজ নো গান দ্যাট ফায়ারস বাট অনলি ইন ওয়ান ডাইরেকশন। কখন যে নলটা ঘুরে গিয়ে বন্দুকের মালিককেই ধরাশায়ী করে বসে, তার কি ঠিক আছে। কথায় বলে, টাকা দেখলে পাথরও হা করে। দুটো কাঁচা পয়সা দেখলে সন্ত্রাসীর বন্দুকের নলও যে ঘুরে যাবে না, তার নিশ্চয়তা কী!
পাদটীকা : আমরা উঠতে বসতে 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা', 'একুশের চেতনার' কথা বলি, কিন্তু আমরা কজন জানি সেই চেতনা আসলে কী? সে বিরাট আলোচনা সময়সাপেক্ষ। কাজেই, এখন থাক। তবে আর যাই হোক, শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা যে কোনো ব্যক্তিগত লাভের আশায় বা কারো চামচাগিরি করার জন্য যুদ্ধে যাননি, তেমনি অমর একুশের ভাষাশহীদরা যে কারো লেজুড়বৃত্তির জন্য আন্দোলন করেননি বা নিজেদের আখের গোছানোর জন্য মিটিংয়ে-মিছিলে যাননি, তা তো সারা দুনিয়ার লোক জানে।
লেখক : সাবেক সচিব, কবি ও কলামিস্ট
mkarim06@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.