চরাচর-সার্কাসদলের টিকে থাকার লড়াই by বিশ্বজিৎ পাল বাবু

১৫ থেকে ২০ কেজি ওজনের ফলা (লোহার তৈরি এক ধরনের অস্ত্র) বাঁশের আগায় লাগানো। সোহাগ নামের এক যুবক বাঁশ হাতে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ বাঁশ ছেড়ে দিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লেন তিনি। অনেকেই চোখ বুজে ফেলেন। এই বুঝি সোহাগের গায়ে বিঁধল ফলা।
কী অদ্ভুত, ফলার সাতটি অংশ সোহাগের শরীরের চারপাশ ঘিরে রইল। সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সান্ত্বনার বয়স পাঁচ কি ছয় বছর। লিকলিকে গড়ন। কিন্তু অদ্ভুত তার শারীরিক কসরত। ড্রামের ভেতরে ঢুকিয়ে তাকে ঘোরানো হচ্ছে। একজন একটি বেঞ্চে শুয়ে পায়ে বড় লাঠি নিয়ে দুই পাশে দুজনকে ঘোরাচ্ছেন। দুজনের একজন সান্ত্বনা। দাঁতে কিছু একটা কামড়ে ধরে রাখা অবস্থায় সান্ত্বনাকে ঘোরানো হচ্ছে ৩০-৪০ ফুট উঁচুতে। শারীরিক কসরত দেখানো শেষে এতটুকু ক্লান্ত দেখা গেল না সান্ত্বনাকে।
এই হচ্ছে সার্কাস। বলা যেতে পারে একটা শিল্প। রশি বেয়ে ছাগল চলা, হাতির ফুটবল খেলার দৃশ্য, ভল্লুক, বানর, ঘোড়ার বিভিন্ন শারীরিক কসরত ইত্যাদির প্রদর্শন হয় সার্কাসে। এখানে জাদুটাদুর মতো কিছু নেই। সব কিছুই শারীরিক কসরত, দীর্ঘদিনের সাধনা। ওপরের বর্ণনাগুলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিউ স্টার সার্কাসের।
কথা হচ্ছিল সার্কাস মালিক সমিতির সভাপতি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিউ স্টার সার্কাসের মালিক এম এ সামাদের সঙ্গে। বয়স প্রায় ৮৩ বছর। এ বয়সেও এ জেলা থেকে ওই জেলায় ঘুরে বেড়ান সার্কাসের দল নিয়ে। জানালেন, কখনো বাড়ি ফিরে গেলে মনে হয়, এই বুঝি হাতিটার ভালোভাবে খাওয়া হয়নি, ভল্লুকটাকে বুঝি খেতে দেওয়া হয়নি, ঘোড়ার খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। বললেন, সার্কাস আমার রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে।'
এম এ সামাদ জানালেন, ১৯৬৭ সালে নবীনগরে একটি মেলার আয়োজন করা হলে তৎকালীন মন্ত্রী সবুর খান মেলায় সার্কাস না দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এরপর রশিদ মিয়া নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে তিনি সার্কাসের সরঞ্জামাদি কিনে নেন। একবার খুলনার পাইকগাছায় সার্কাসের প্যান্ডেল পুড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি লুট হলে তা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিত্রালয় হলে 'টারজান' সিনেমা দেখে আবার সার্কাসদল গঠনের ইচ্ছা হয় তাঁর।
নিউ স্টার সার্কাসে বর্তমানে ১৩৬ জন প্রশিক্ষিত কর্মী রয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে ১৭টি পরিবার। ওই পরিবারের সদস্যরা সার্কাসের কোনো না কোনো খেলায় অংশগ্রহণ করেন। তিনজন প্রশিক্ষক তাঁদের প্রশিক্ষণ দেন। বেতনের ভিত্তিতে বছরজুড়েই তাঁরা থাকেন সার্কাসদলের সঙ্গে। সার্কাসের প্যান্ডেলের মধ্যেই তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। জোকার জিল্লু, নিতাই, র্বশীবাদক রশিদসহ অনেকেই সার্কাসদলে থাকাকালীনই মৃত্যুবরণ করেন।
সার্কাসে অবশ্য নতুন করে যোগ দিয়েছেন চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকারা। ওমর সানী, আলেকজান্ডার বো, মাধবী, হারুন কিসিঞ্জারসহ অনেকে সার্কাস প্যান্ডেলে এসে নেচে-গেয়ে, অভিনয় ও কৌতুক করে দর্শকদের বিনোদনের খোরাক জুগিয়ে যান।
নিউ স্টার সার্কাসের তদারককারী এম এ সামাদের ছেলে মো. সাজু বলেন, সার্কাস শিল্পটা আগের অবস্থানে নেই। এখন লাভের আশা করা যায় না। দিন দিন প্রতিকূলতা বাড়ছে।
বিশ্বজিৎ পাল বাবু

No comments

Powered by Blogger.