সংবিধানের সঙ্গত-অসঙ্গত ব্যবচ্ছেদ- অবলোকন by মাসুম খলিলী

বাংলাদেশের সংবিধানের ব্যবচ্ছেদ নিয়ে একসময় বেশ ভালো বিতর্ক উঠেছিল। সেই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু ছিল জাতীয় সংসদ।
সংবিধান প্রণয়নের পর দেশের শাসনতন্ত্রে সংযোজন-বিযোজনের এখতিয়ার দেয়া হয়েছিল জনপ্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্যদের। সংশোধনী প্রসঙ্গে সংবিধানের ১৪২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদের আইন দ্বারা এই সংবিধানের কোন বিধান [সংযোজন পরিবর্তন প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণের দ্বারা সংশোধিত]্ হইতে পারিবে’। সংবিধান সংশোধনের শাসনতান্ত্রিক পন্থা এটিই। বাংলাদেশে এ যাবৎ যে ১৫টি সংশোধনী আনা হয়েছে, তার সব ক’টি এভাবেই হয়েছে। তবে অষ্টম সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জের মামলার রায়ে এই সংশোধনীর একটি অংশ বাতিল ঘোষণার পর সংবিধান পরিবর্তনের আরেকটি উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের রায়। সংবিধান পরিবর্তনের এখতিয়ার আদালতের রয়েছে কি না, থাকলে তার ব্যাপ্তি কতটুকু এ নিয়ে বিচারপতিদের মধ্যেও ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। অষ্টম বা পঞ্চম কোনো সংশোধনী মামলায় আপিল বিভাগের সব বিচারপতি একমত হয়ে রায় দেননি। কয়েকজন সাবেক প্রধান বিচারপতির সাথে আলাপ করেও সবার একই মত পাওয়া যায়নি এ ব্যাপারে।

সংবিধান সংশোধনীকে অবৈধ বা বাতিল ঘোষণা করার ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতার বিষয়টি সংবিধানে সরাসরি কোথাও উল্লেখ নেই। সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি সংবিধানের সাথে অসমঞ্জস হয়, তাহা হইলে সে আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।’ অন্য দিকে সংবিধানের ৭, ২৬, ৪৪, ১০১ ও ১০২ অনুচ্ছেদে উচ্চতর আদালতের এখতিয়ারের যে বিষয়টি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রয়েছে, তার পথ ধরে সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের সংশোধনীকে বিচারিক নিরীক্ষণ ক্ষমতার আওতায় এনেছে। সংবিধানে প্রত্যক্ষ কোনো বিধান না থাকায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট মামলার মাধ্যমে আইনের যে নজির স্থাপিত হয়, অষ্টম সংশোধনী মামলার ক্ষেত্রে আদালতের এখতিয়ার প্রতিষ্ঠার জন্য সেটি অনুসরণ করেন। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের গোলকনাথ, ইন্ধিরা গান্ধী, কেশাবনন্দ ভারতী, মিনারভা মিল প্রভৃতি রায়ে যে ব্যাখ্যা ও অনুসিদ্ধান্ত এসেছে, তার উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে সংবিধান সংশোধনীর বিচারিক নিরীক্ষণ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য।

সংবিধান পর্যালোচনা-সংক্রান্ত ক্ষমতাকে এ প্রসঙ্গে দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়। এর একটি হলো সংবিধানের বিচারিক নিরীক্ষণ ক্ষমতা আর অপরটি হলো সংবিধানের সংশোধনী বিচারিক নিরীক্ষণ ক্ষমতা। মূল সংবিধান প্রণয়নের ক্ষমতা ছিল গণপরিষদের একান্ত এখতিয়ারের বিষয়। বলা হয়েছে, গণপরিষদ প্রণীত এ সংবিধানকে বিচারিক নিরীক্ষণ ক্ষমতার আওতায় আনার এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের নেই। কিন্তু সংবিধানের সংশোধনী বিচারিক নিরীক্ষণ ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের রয়েছে। গণপরিষদ বিলুপ্তির পর সংবিধানের সংযোজন-বিযোজন-পরিবর্তনের এখতিয়ার সংসদকে দেয়া হয়েছে। সংসদ সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত আইন দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস করে তা কার্যকর করতে পারে। কিন্তু সংবিধান সংশোধনে সংসদের এ যে ক্ষমতা, সেটি অনিয়ন্ত্রিত বা অসীম নয় বলে বিচার বিভাগের অভিমত।

সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে সংসদ ও বিচার বিভাগের এই এখতিয়ার প্রশ্নে দুই ধরনের বিতর্ক বাংলাদেশে প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে। এর একটি হলো, তাত্ত্বিক বিতর্ক। এই বিতর্কে সংসদ সদস্যরা মোটা দাগে এক পক্ষ। আর আদালতের সরব বিচারপতিরা এক পক্ষ। সংসদে সার্বভৌমত্বের পক্ষে যারা সোচ্চার তারা মনে করেন যে, সংসদ হলো সার্বভৌম। সংসদ যে আইন পাস করবে সেটি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হলে সেটি বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনায় বাতিল হতে পারে। কিন্তু সংবিধান সংশোধনী বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার বিষয় হতে পারে না। তাদের বক্তব্য হলো মামলার মাধ্যমে যে আইন তৈরি হয়, সেটি সংবিধানের সুস্পষ্ট বিধানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না। বাংলাদেশের সংবিধানে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা একান্তভাবে সংসদকে দেয়া রয়েছে। এ ক্ষমতাকে বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তের অধীন করা হলে দুই বিভাগের অনাকাক্সিত সঙ্ঘাতে অচলাবস্থা দেখা দেবে। এ প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে, সংবিধানের সংশোধনীকে হাইকোর্টের এখতিয়ারের অধীন করা হলে আদালত ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের পর সব সংশোধনী বাতিল করার ক্ষমতা রাখে। অষ্টম সংশোধনীর ক্ষেত্রে বিবেচনার ক্ষেত্রটা অতি সংক্ষিপ্ত ছিল বলে তা নিয়ে এতটা আলোচনা হয়নি। কিন্তু এর পথ ধরে পঞ্চম, সপ্তমসহ আরো কিছু সংশোধনী বাতিল ঘোষণার পর কার্যত সংবিধান সংশোধনে সংসদের এখতিয়ার একেবারেই সীমিত হয়ে গেছে। পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে অতীতের সরকারকে, সরকারের কার্যক্রমকে এবং সংবিধান সংশোধনীকে অবৈধ বলে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে। সংশোধনীর কোনো কোনো বিষয়কে মার্জনা বা গ্রহণযোগ্য করা হয়েছে। অবৈধ সরকারের কার্যক্রমকে অতিক্রান্ত ও সম্পন্ন বলে উল্লেখ করে পরবর্তী সরকারের ধারাবাহিকতার জন্য বৈধতা দেয়া হয়েছে। সংসদের সার্বভৌমত্বের পক্ষের ব্যক্তিদের বক্তব্য হলো সংবিধানকে ব্যাখ্যা দেয়ার এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের বলে আদালত নিজের এখতিয়ার বৃদ্ধিকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। ক্ষমতার পৃথকীকরণ ও ভারসাম্য তত্ত্বের সাথে এটি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটি চলতে থাকলে এক ধরনের বাড়াবাড়ি বা অরাজকতা তৈরি হবে। এর পাল্টা যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের সংসদ কোনোভাবেই সার্বভৌম নয়। সংবিধান পরিপন্থী আইন সংসদ তৈরি করতে পারে না। আবার গণপরিষদ যে সংবিধান তৈরি করেছিল তার মূল চেতনা ও বৈশিষ্ট্যকে পরিবর্তনের এখতিয়ারও সংসদের নেই। সুতরাং বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের সংশোধনীকে বিচারিক নিরীক্ষণ ক্ষমতায় এনে যে রায় দিয়েছে তা যথার্থ।

সংসদ ও বিচার বিভাগ গঠনের একটি তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য হলো, আইনসভায় কোনো বিল পাস করতে হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন হয়। আর সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব পাস করতে হলে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের সমর্থনের প্রয়োজন হয়। অন্য দিকে হাইকোর্টের শতাধিক বিচারপতির মধ্যে দুইজনের এখতিয়ারসম্পন্ন একটি বেঞ্চ একমত হয়ে একটি রায় দিতে পারেন। আর সেটি আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চ অনুমোদন করলে তা নতুন করে পর্যালোচনা না হওয়া পর্যন্ত অনুসরণীয় সিদ্ধান্ত হিসেবে কার্যকর হয়। বিচারপতি খায়রুল হক মুন সিনেমা হল-সংক্রান্ত যে রিটটির সূত্র ধরে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেছেন, তা এর আগে চারটি বেঞ্চে খারিজ হয়ে গিয়েছিল। এতে দেখা যায় আটজন বিচারপতির সিদ্ধান্তের ওপর দুইজন বিচারপতির সিদ্ধান্ত প্রাধান্য পেল পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতার কারণে। আবার যদি ধরে নেয়া হয় মুন সিনেমার খারিজ হওয়া হাইকোর্টের রায় নিয়ে আপিল করা হয়েছে এবং তা নাকচ হয়ে গেছে তাহলে পঞ্চম সংশোধনীর এ মামলায় আপিল বিভাগের যতসংখ্যক বিচারপতি এটি বাতিলের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তার চেয়ে অধিকসংখ্যক বিচারপতি এর বিপক্ষে ছিলেন। এতে দেখা যায় হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের রায় হিসেবে আমরা যেটি পাই সেটি সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কর্মরতদের বেশির ভাগের মতামতের প্রতিফলন না-ও হতে পারে, আইনসভার ক্ষেত্রে দুই তৃতীয়াংশ প্রযোজ্য। অবশ্য এ বাস্তবতা শুধু বাংলাদেশের নয়, এটি অন্য দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সংসদ ও বিচার বিভাগের এখতিয়ার প্রশ্নে তত্ত্বগত যে বিতর্ক তার অবসান আদালতের নেতৃত্ব ও সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা একই রাজনৈতিক ধারায় থাকলে হয়তো হবে না। কিন্তু সংবিধানের সংশোধনীকে আদালতের বিচারিক নিরীক্ষণ ক্ষমতার বিষয় করে গড়পড়তা বাতিল, মার্জনা, নির্দেশনা দেয়ার বিপক্ষে আদালতের এখতিয়ার নির্দিষ্ট করে সংসদে ভবিষ্যতে কোনো সংশোধনী আনা হলে বিষয়টি নতুন মাত্রা পেতে পারে। এ ক্ষেত্রে আদালত কেইস ল বা মামলার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বিধানকে সাংবিধানিক আইনের ওপর প্রাধান্য দিয়ে সংবিধানের সেই সংশোধনীকে বাতিল করতে হয়তো পারবে না।

সংবিধান সংশোধনের প্রায়োগিক বিতর্কটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সংবিধান অনুযায়ী আইনসভার হাতে সংশোধন পরিমার্জনা বিযোজনের ব্যাপক ক্ষমতা থাকায় এসব কাজে যথেষ্ট সময় নিয়ে প্রয়োজনীয় বিন্যাস করা সম্ভব হয়। কিন্তু উচ্চ আদালতের বিচারিক নিরীক্ষণ বা পর্যালোচনায় কোনো আইন তৈরি করা যায় না, কেবল ব্যাখ্যার মাধ্যমে আইনের নজির স্থাপন করা সম্ভব হয়। আদালত কোনো আইন বাতিল করে পুরনোটি পুনরুজ্জীবিত করতে পারেন। ক্ষেত্রবিশেষে মানুষটিকে হত্যা করে মার্জনার মাধ্যমে মৃত মানুষের কর্নিয়া সংযোজনের মতো অন্ধকে আলো দেখাতে পারেন। কিন্তু এর মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে ব্যাপকভিত্তিক ক্ষমতার প্রয়োগ করতে গেলে সংশোধিত অবয়বটা অবিন্যস্ত এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে বিকৃতও হয়ে যেতে পারে। সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বাতিলের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়টি হাইকোর্ট বিকেন্দ্রীকরণে সীমিত থাকায় তা নিয়ে বিপত্তি ঘটেনি। এ রায়ের পর সংবিধান থেকে সুপ্রিম কোর্টের বাতিল ঘোষিত অংশটি বাদ দিয়ে পুনর্মুদ্রণ করা হয়। এ জন্য পৃথক কোনো সংশোধনী সংসদে পাস করা হয়নি। এতে আদালত নির্দেশিত সংবিধান সংশোধনী প্রশ্নে নতুন করে সংসদে বিল না আনার বিষয়টি একটি দৃষ্টান্ত হয়ে যায়। পঞ্চম সংশোধনীতে বিচারপতি খায়রুল হকের ব্যাপকভিত্তিক রায়টি আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির পর সে দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে সংবিধানের সংশোধিত সংস্করণ প্রকাশের মাধ্যমে তা কার্যকর করার কথা বলা হয়। প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণের পর বিচারপতি খায়রুল হক বলেছিলেন, ‘পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এটি আর নতুনভাবে কার্যকর করার কিছু নেই। তবে সংসদ চাইলে সংবিধানের মৌলিক স্তম্ভ ছাড়া অন্য সব কিছু পরিবর্তনের এখতিয়ার তাদের রয়েছে।’ তিনি সংবিধানের পুনর্মুদ্রণেরও নির্দেশ দেন। এ নির্দেশের প্রেক্ষিতে সরকার ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংবিধানের নতুন সংস্করণ প্রকাশ করে। এর উপক্রমণিকায় আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, ‘লিভ টু আপীলে (পঞ্চম সংশোধনী-সংক্রান্ত) প্রদত্ত রায়ে জারীকৃত সামরিক আইন ফরমান আদেশ দ্বারা সংবিধানের যে সকল বিধান সংশোধন করা হইয়াছিল উহা কতিপয় মার্জনা সাপেক্ষে অবৈধ (Ultra Viras) ঘোষিত হওয়ায় সেই সকল বিধানের কার্যকারিতা, আপীল বিভাগ প্রদত্ত রায়ের তারিখ হইতে আর নাই।’ আইনমন্ত্রীর এই বক্তব্যে প্রধান বিচারপতির নির্দেশ অনুসারে রায়ের ভিত্তিতে পুনর্মুদ্রিত সংবিধানই যে চূড়ান্ত তাতে সংশয়ের অবকাশ থাকে না। কিন্তু সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত সংসদের বিশেষ কমিটি টেকনোক্র্যাট আইনমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির বক্তব্যÑ কোনোটাকেই গ্রহণ করেনি। কমিটির সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সংসদীয় কমিটির কাছে সংবিধানের যে কপি দেয়া হয়েছে সেটি একটি খসড়া সংবিধান। আমরা এটিকে খসড়া সংবিধান হিসেবে গণ্য করে সংবিধান সংশোধন করব।’ ‘সংবিধান কোনো দিন খসড়া হতে পারে না’ বলে এর আগে আইনমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছিলেন, বাস্তবে সেটির প্রতিফলন সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপেও দেখা যায়নি। রায়-পরবর্তী পুনর্মুদ্রিত সংবিধান একেবারেই সীমিতসংখ্যক ছেপে তা একরকম গোপন করা হয়। আর পরে সংসদে সংবিধানের যে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় তাতে পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের অনেক কিছু হুবহু তুলে দেয়া হয়। এতে প্রমাণ হয় সংসদে প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক উচ্চতর আদালতের রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিস্থাপন ও কার্যকর হবে বলে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, তা সরকার গ্রহণ করেনি। এমনকি আইনমন্ত্রী পঞ্চদশ সংশোধনীসহ ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত সংবিধানের উপক্রমণিকায় আপিল বিভাগের রায়ের তারিখ থেকে অবৈধ ঘোষিত বিধানের কার্যকারিতা নেই বলে বক্তব্য থেকে সরে এসে বলেন, ‘সামরিক আইন ফরমান দ্বারা সংবিধানের সংশোধন অবৈধ বাতিল ও অস্তিত্বহীন ঘোষণা করা হয়েছে।’ এর মাধ্যমে অন্তরালে সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে আইনসভা ও বিচার বিভাগের যে দ্বন্দ্ব সেটিরই প্রকাশ ঘটেছে। যদিও দু’পক্ষের মধ্যে (পাকিস্তানের মতো) রাজনৈতিক ভাবধারা-সংক্রান্ত সঙ্ঘাত সেভাবে না থাকায় তা প্রকাশ্যে আসেনি।

সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার প্রশ্নে আইনসভা ও বিচার বিভাগের সঙ্ঘাত অন্তরালে থেকে গেলেও এটি যে একসময় প্রকাশ্যে আসবে তা এখন নানা কিছুতেই স্পষ্ট হচ্ছে। সংশোধনী অবৈধ করার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের আমলের সংবিধান একেবারে ওলটপালট হওয়ার মতো যে রায় দেয়া হয়েছে এরকম দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে দেখা যায় না। এতে সংবিধানে নানা অসঙ্গতিও বের হয়ে আসছে। একাদশ সংবিধান সংশোধন আইনের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ ও পরবর্তী সময়ে প্রধান বিচারপতি পদে ফেরত যাওয়ার বৈধতা দেয়া হয়েছিল। দ্বাদশ সংবিধান সংশোধন আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে প্রত্যাবর্তন এবং পঞ্চম সংসদের নির্বাচন ও গঠনের বৈধতা দেয়া হয়েছিল। আপিল বিভাগ ক্রান্তিকালীন বিধান হিসেবে সংবিধানের এই সংযোজনকে অবৈধ ঘোষণা করে। তবে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে চতুর্থ সংশোধনী (বাকশাল) বাতিল, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনসহ সামরিক ফরমানের মাধ্যমে জনস্বার্থে সংঘটিত কার্যক্রমকে মার্জনা দেয় আদালত। পরে সরকারপক্ষ আপিল বিভাগের ওই রায়ের বিরুদ্ধে পুনর্বিবেচনার আবেদন করে। আদালত কিছু পর্যবেক্ষণসহ পুনর্বিবেচনার আবেদনটির নিষ্পত্তি করে। আগের আপিল বিভাগ জনস্বার্থে যেসব বিষয় মার্জনা করেছিল, পুনর্বিবেচনার আবেদনে বর্তমান আপিল বিভাগ সেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত করে এ জন্য ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। পরে সরকারের আবেদনক্রমে আপিল বিভাগ আগামী ১৩ জুন পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করে। এই সময়ের মধ্যে কোনগুলো মার্জনা করা হবে সংসদকে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু মার্জনার বিষয়টি সংসদের ওপর ছেড়ে দিলেও ১৫০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আদালত ক্রান্তিকাল নির্দিষ্ট করে দেয়। রায়ে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে সংবিধান প্রণয়নের আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর পর্যন্ত সময়কে ক্রান্তিকাল হিসেবে গণ্য করা হবে। এর বাইরে ক্রান্তিকাল হিসেবে সংবিধানে যা কিছু অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তা সঠিক হয়নি। আপিল বিভাগের এ রায়ের পর ২০১১ সালের  অক্টোবরে পঞ্চদশ সংশোধনীর পর সর্বশেষ মুদ্রিত সংবিধান থেকে এগুলো বাদ দেয়া হয়েছে। ফলে একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী এখন আর সংবিধানের অংশ নয় যার ফলে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে প্রত্যাবর্তন অবৈধ হয়ে গেছে। কিন্তু এই অবৈধ শাসনপদ্ধতি এখনো কার্যকরভাবে চলে আসছে।

সংবিধানের সাম্প্রতিক সংস্করণে চতুর্থ তফসিলে সংযুক্ত ১১শ ও দ্বাদশ সংশোধনীসহ পাঁচটি প্যারা (১৮ থেকে ২২) ফেলে দেয়া হয়েছে। এতে একধরনের অস্বচ্ছতা ও গোঁজামিলের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে শাসনতন্ত্রে। আবার এমনও শোনা যাচ্ছে, বিষয়টি নিয়ে সরকারপ্রধান সিদ্ধান্তহীন ছিলেন বলে পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় ইচ্ছা করেই সরকারপদ্ধতির বিষয়টি অনিষ্পন্ন রাখা হয়। নতুন আরেক সংশোধনীর মাধ্যমে আবার রাষ্ট্রপতিশাসিতব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া হতে পারে যাতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুযোগ পাবেন। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রত্যক্ষ না পরোক্ষ ভোটে হবে সেটি নতুন করে নিষ্পত্তি করা হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাকশাল গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতি হন। তখন নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়নি, সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে এটি সম্পন্ন করা হয়। এ ক্ষেত্রেও তেমন কিছু করার বিষয় বিবেচিত হতে পারে।

সংবিধানের এই ক্রান্তিকালীন সময় নির্ধারণ নিয়ে জটিলতার বিষয়টি সংবিধান বিশেষজ্ঞরা নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছেন। এ প্রসঙ্গে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘রাজনৈতিক বিষয় নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতা আমরা দুই বছরে সুপ্রিম কোর্টের কাছে প্রত্যক্ষ করেছি। এর ফলে এমন কিছু সঙ্কট ভবিষ্যতে তৈরি হবে যা সামাল দেয়া রাজনীতিবিদদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। গত দুই বছরে উচ্চ আদালত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় অনেক কিছুই অবৈধ ঘোষণা করে ফেলেছে। জিয়া ও এরশাদের শাসন অবৈধ হয়েছে। একাদশ, দ্বাদশ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ ঘোষিত হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনটি নির্বাচন কি বৈধ হয়েছে? যদি অবৈধ হয় তাহলে মার্জনা কে করবে? আপিল বিভাগ তো এ বিষয়ে কোনো মার্জনা করেনি। সংসদকেও মার্জনার ক্ষমতা দেয়নি।’ (ইত্তেফাক, ২৩ জানুয়ারি)

ড. শাহদীন মালিকের এ সম্পর্কিত বক্তব্যটি ছিল এ রকম : ‘আপিল বিভাগের রায়ের কিছু কিছু অংশের বাক্য গঠন ও ব্যাকরণ মেলাতে পারছি না। তারা একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনীর বিষয়াবলি চতুর্থ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করাকে সঠিক হয়নি বলে অভিহিত করেছেন। ক্রান্তিকাল নির্দিষ্ট করার পর চতুর্থ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করাকে অবৈধ বলেছেন। তবে তারা ’৭৯-এর সংসদকে অবৈধ ঘোষণা করেননি। পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। ওই সংসদ এবং তার পরবর্তী সংসদ চতুর্থ তফসিলে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছিল, ওই সব বিষয় বর্তমান সংসদকে বিবেচনা করতে বলেছেন আদালত। এখন বর্তমান সংসদ যদি আদালতের দৃষ্টিতে যা অবৈধ তা রেখে দেয়, তাহলে অবৈধ বিষয় চতুর্থ তফসিলে থেকে যাবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়েও তারা (আদালত) সংসদকে পরামর্শ দিয়েছেন। তারা যেটিকে অবৈধ মনে করেন, সংসদ সেই অবৈধ জিনিস কেন আরো দুই মেয়াদের জন্যে রাখবে? এভাবে রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে হস্তক্ষেপ করলে সংসদ সদস্যদের সংসদ বিলুপ্ত করে নিয়ে বাড়ি চলে যাওয়া উচিত।’ (ইত্তেফাক, ২৩ জানুয়ারি)

পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর থেকে সংবিধানে যেসব জটিলতা তৈরি হয়েছে, তার ওপর রাজনৈতিক আছরের বিষয়টি অনেকেই বলছেন। কলামিস্ট-সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বিষয়টির ওপর আলোকপাত করে নানা ব্যবচ্ছেদে অসংলগ্ন ও বিতর্কিত হয়ে পড়া সংবিধানটি একেবারে বাদ দিয়ে নতুন গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়নের প্রস্তাব করেছিলেন। শাসনতান্ত্রিক সঙ্কট যেভাবে দানা বেঁধে উঠছে, তাতে এ বিষয়টি নতুন করে আলোচিত হচ্ছে। খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ ও জাসদের তাত্ত্বিক গুরু সিরাজুল আলম খানও সংবিধানের আমূল পরিবর্তনের প্রয়োজন তুলে ধরে বলেছেন, “১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান রচনা শেষে জনমত যাচাইয়ের পর্যায়ে আমরা সংবিধানকে পুরোপুরি বর্জন না করে ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’ হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম। ৪০ বছরের ব্যবধানে আজ সেই সংবিধানকে যে আমূল সংশোধন অপরিহার্যÑ এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।” তিনি বাংলাদেশের বর্তমান এককেন্দ্রিক সরকার পাল্টে প্রাদেশিক ব্যবস্থা সংবলিত ফেডারেল সরকার গঠনেরও বিস্তারিত প্রস্তাব দিয়েছেন।

বাংলাদেশ এখন শুধু রাজনৈতিক ক্রান্তিকালেই নেই একই সাথে সাংবিধানিক ক্রান্তিকালও অতিক্রম করছে। এটিকে জটিলতর করেছে শাসনতন্ত্র সংশোধনের বিষয়টি নিয়ে কিছুটা মাত্রাছাড়ানো বাড়াবাড়ি। এটি না হলে আজ সংবিধান নিয়ে যে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে এবং আরো হতে যাচ্ছেÑ তা হয়তো এতটা দেখা যেত না। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর এভাবে নতুন করে গণপরিষদ গঠন

করে সংবিধান প্রণয়নের প্রসঙ্গটিও হয়তো উত্থাপিত

হতো না।

No comments

Powered by Blogger.