আঞ্চলিক প্রসঙ্গ-ভারত ও চীন : সম্ভাব্য সংঘাত এবং বাংলাদেশ by রফিকুল হাসান

১৯৬২ সাল। তখন আমি নবম শ্রেণীর ছাত্র। বয়স ও বিদ্যার কমতি থাকলেও রাজনৈতিক চিন্তায় অগ্রসর, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ঘটনাগুলো ভীষণভাবে নাড়া দিত কিশোর মনকে। সুয়েজ ক্রাইসিস, জোটনিরপেক্ষ শক্তির বিকাশ, সমাজতন্ত্রের অগ্রযাত্রা শিহরণ জাগাত মনকে।
সম্ভবত সেই সময় চীনের প্রধানমন্ত্রী ভারত ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেও সফর করেন। নেহরু ও চৌএন লাইয়ের একটি ছবি এখনও আমার চোখে ভাসে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে দু'জন হাত ধরেছেন, চৌয়ের ডান হাত নেহরুর উত্তোলিত বাঁ হাত। বিশাল জনসভার জনগণকে স্বাগত জানাচ্ছেন দুটি প্রতিশ্রুতিময় দেশের দুই নেতা। কলকাতার পত্রিকা এখনও নিয়মিত আমাদের শহরে আসত। ফরওয়ার্ড ব্লকের 'লোকসেবক' আর ইংরেজি কাগজ স্টেটসম্যান। লোকসেবকদের হেডিং 'ভারত-চীন ভাই ভাই'।
এটা দেখে নাকি ভারতে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন দূত হেনরি চেস্টার-বোলজ ভারত সরকারের আমেরিকান লবিকে আশ্বস্ত করেছিলেন 'ঘাবরাও মৎ', অচিরেই এই সম্পর্ক 'ভয় ভয়ে' পরিণত হবে। হয়েছিলও তাই। দুই বছরের মাথায় শুরু হয় ভারত-চীন যুদ্ধ। ভাই ভাই সম্পর্ক ভয় ভয়ে পরিণত হয়। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে পিপলস আর্মির ভয়ে। পালাতে শুরু করে বেসামরিক জনগণ।
এই যুদ্ধ সম্পর্কে কলকাতায় তখন প্রায় গোপনে প্রকাশিত হয় একটি প্রামাণ্য দলিল ভারতের চীন যুদ্ধ। অবাক করার কথাই বটে। ভারতবাসীরা আমেরিকার সৌজন্যে জেনে এসেছে, চীনই আক্রমণ করেছে ভারতকে। তখন এ আবার কেমন কথা। লেখক তথ্য এবং দলিল-দস্তাবেজ দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন উল্টোটাই ছিল আসল চিত্র। আমেরিকার উস্কানিতে চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে যুদ্ধ করতে উৎসাহ দেওয়া ছাড়াও অস্ত্র সরবরাহ করে যুক্তরাষ্ট্র। এক ঢিলে দুই পাখি মারা। সমাজতন্ত্রের আন্দোলন এবং কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ভারতের জনগণকে সংঘবদ্ধ করা আর অস্ত্র বিক্রি করা। সোভিয়েত ইউনিয়ন চীনের বিরুদ্ধে তাদের অস্ত্র ব্যবহার করতে ভারতকে সম্মতি না দিলে আমেরিকা পাশে দাঁড়াবে এটাই ছিল লক্ষ্য। ভারতের বন্ধু জেনারেলরা তো মহাখুশি। বিদেশমন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন এটা জানতে পেরে এই যুদ্ধের বিরোধিতা করলে জেনারেলদের চাপে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ভারত দাবি করতে থাকে ম্যাকমোহন লাইন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। হাজার হাজার ভারতীয় সৈন্য জমায়েত করা হয় অরুণাচল, মেঘালয়, আসাম এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। অন্যদিকে চীনের পিপলস আর্মি। আমেরিকার প্রথম উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। ভারত-চীনের সম্পর্ক তখন ভাই ভাই থেকে ভয় ভয়ের তুঙ্গে।
অর্ধশতাব্দী পর আবার সেই পুরনো দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে। মাস ছয়েক আগে বিলেতের দি ইকোনমিস্ট পত্রিকায় এ ব্যাপারে একটি তথ্যমূলক লেখা ছাপা হয়েছে, যার শিরোনাম ছিল 'ভারত বনাম চীন'। দুটি দেশই এশিয়ার নতুন মহাশক্তি। চীন এগিয়ে থাকলেও ভারত আমেরিকার সমর্থনপুষ্ট। তারা শুধু অর্থনৈতিক দিক দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে না। জনবল ও গণতন্ত্রের সুবাদে পশ্চিমের কাছে একটি গ্রহণযোগ্য শক্তিও বটে। বিশ্ব মতামত ও অভ্যন্তরীণ প্রতিবাদ সত্ত্বেও ভারত আমেরিকার সঙ্গে গড়ে তুলেছে নিউক্লিয়ার বা পারমাণবিক চুক্তি। এ ছাড়া ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় মৌলবাদ ও মুসলিম জঙ্গি চিন্তাধারাকে ঠেকাতে ভারতের সঙ্গে পশ্চিমের একাত্মতা সর্বজনবিদিত। ভারত শুধু উপমহাদেশেই নয়, মধ্য এশিয়াতেও তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য উদগ্রীব। উদ্দেশ্য ক্যাস্পিয়ান সাগরের তলদেশের বিপুল তেল-গ্যাসের মজুদ থেকে তার চাহিদা নিশ্চিত করা। যুক্তরাষ্ট্রের উৎসাহে চীনবিরোধী ভারতীয় সহযোগিতা এখন মার্কিনিদের অতীব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখছে চীনকে। এ ছাড়া অ্যাডভান্স টেকনোলজির ব্যাপারে ভারত একটি মূল্যবান বাজারও বটে। চীনের বিরুদ্ধে যে বলয় যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করছে সেই ছকে ভারত সুন্দরভাবে একটি দাবার ঘুঁটি হলে দু'পক্ষেরই লাভ বৈ ক্ষতি নেই।
দি ইকোনমিস্টের নিবন্ধে ভারতেই উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্যাপক সৈন্য সমাবেশের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই নাকি লক্ষাধিক সৈন্যের প্রশিক্ষণ চলবে ওই অঞ্চলে। ১৯৬২ সালে ভারতের সঙ্গে ২০১১-এর ভারতের অনেক ফারাক। ভারত এখন পারমাণবিক শক্তি আর যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু। কাজেই চীন এত সহজেই তাকে অগ্রাহ্য করতে পারবে না। তবে আশার কথা, ভারতীয় অনেক প্রজ্ঞাবান বর্ষীয়ান নেতারা এখন আগে থেকেই সংঘাতের ব্যাপারে হুশিয়ার করছেন সরকারকে, তারপরও নতুন নতুন কনফ্লিকেট মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
গত বছরের ১২ জুন লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকার একটি সংবাদ প্রতিবেদনে এমনি একটি দ্বিমতের খবর প্রকাশিত হয়েছে। চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিগত বছরগুলোতে ইয়াংসি ও হুলুদ নদীতে পানির নাব্যতা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। শুকিয়ে গেছে খালবিল এবং ছোট শাখা নদীগুলো। ফসলের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক, প্রায় ধু-ধু মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে এই অঞ্চল।
চীন একই প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে এই অঞ্চলকে শস্য-শ্যামলা করতে বিশাল বাঁধ দিতে চাইছে তিব্বতের কাছে, ব্রহ্মপুত্রের উৎসে। তারপর ওই নদীর পানি, খাল, সুড়ঙ্গ এবং বিভিন্ন উপায়ে নিয়ে ফেলতে চাইছে ইয়াংসি ও ইয়েলো নদীতে। ধুলোয় আচ্ছন্ন এই পরিকল্পনা ঝেড়েমুছে নতুন করে বাস্তবতায় রূপ দিতে চাইছে বাঁধ তৈরি অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ চীনের ইঞ্জিনিয়াররা।
সমুদ্র লেভেল থেকে ১১ হাজার ৭৭২ ফুট উঁচুতে এই বাঁধ তৈরির ইঙ্গিত দেন বেশ কয়েক বছর আগে পিপলস আর্মির এক সেনাপতি লি লিং, তার 'তিব্বতের জল বাঁচাবে চীনকে' তার গবেষণামূলক পুস্তকে। এই প্রকাশিত পুস্তক নিয়ে ভারতে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে।
প্রতিবাদ করেছে ভারত সরকারও। বেইজিংয়ে দু'দেশের মধ্যে আলোচনায় ভারত এই বাঁধের ফলে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে এবং বঙ্গোপসাগরের ব-দ্বীপ অঞ্চল পানির অভাবে মরুভূমি হয়ে যাবে বলে ভারত মনে করছে। শুধু ভারতই নয় বাংলাদেশেও এর নেতিবাচক প্রভাব হবে। তাই এই পরিবেশধ্বংসী বাঁধ বন্ধের দাবি করছে ভারত।
ভারতের এই প্রতিবাদ বাংলাদেশকে কতটুকু উদ্বুদ্ধ করবে তা জানা যায়নি। তবে অলক্ষ্যে হাসছেন বিধাতা। ভারতের ফারাক্কা, তিস্তা, টিপাইমুখ ও অন্যান্য বাঁধের জন্য বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল যেভাবে ধু-ধু মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে, তার পরিণতি দেশের মানুষের অজানা নয়। অথচ চীনের বাঁধ যেমন ভারতকে উদ্বিগ্ন করছে, তাতে যেমন সত্যতা আছে, বাংলাদেশের গরিব কৃষকদের সর্বনাশ হওয়ার আগে ভারতকেও বোঝা দরকার ছিল প্রতিবেশীর ওপর তাদের দেওয়া বাঁধ কী সর্বনাশা ডেকে আনতে পারে।
এ ছাড়া এই সংঘর্ষে বাংলাদেশ জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও কম নয়। ভবিষ্যতে ভারত-চীন সংঘর্ষে ভারতের সৈন্যবাহিনী ও রসদ সরবরাহের জন্য ট্রানজিট ব্যবস্থা ভারতের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠবে এবং চীন একটা ভালো চোখে দেখবে না সেটা বলাই বাহুল্য।

ডা. রফিকুল হাসান খান
লন্ডন প্রবাসী লেখক

No comments

Powered by Blogger.