এসইসির অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন- ৪৩৬ কোটি টাকার শেয়ার কারসাজি by সুজয় মহাজন

পাঁচ পরিবার, দুই ব্যক্তি আর দুই প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজার থেকে প্রায় ৪৩৬ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। তিনটি মার্চেন্ট ব্যাংকের ১৯টি বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাবের মাধ্যমে সেকেন্ডারি বাজার থেকে এই টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।


এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানির লেনদেনের প্রথম দিনেই ঋণসুবিধা গ্রহণ করেছেন। অথচ আইন অনুসারে, নতুন কোম্পানির লেনদেনের প্রথম ৩০ কার্যদিবসে এর শেয়ার কেনাবেচার জন্য কোনো ধরনের ঋণসুবিধা দেওয়ার বিধান নেই। একইভাবে কেউ কেউ নির্ধারিত মূল্য-আয় (পিই) অনুপাত ছাড়িয়ে অতিমূল্যায়িত শেয়ারে ঋণসুবিধা নিয়েছেন। বেআইনিভাবে এই বাড়তি তারল্য-সুবিধা নিয়ে তাঁরা কারসাজি করেছেন। আবার কেউ কেউ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স ১৯৬৯-এর ১৭(ই) ধারা লঙ্ঘন করেছেন।
বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নেওয়ার পরও ২০১১ সালের ১৫ জুন পর্যন্ত এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিও হিসাবে জমা ছিল আরও ২৫০ কোটি টাকার বেশি। আর তাদের বিনিয়োগ ছিল ৩৫০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে সেকেন্ডারি বাজার থেকে এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মোট আয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় দ্বিগুণ, ৬৮৬ কোটি টাকা।
শেয়ারবাজার থেকে যেসব পরিবার এসব অর্থ তুলে নিয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে আলোচিত ব্যবসায়ী লুৎফর রহমান বাদলের পরিবার, তাঁর স্ত্রীর বড় ভাই আহসান ইমামের পরিবার, ইয়াকুব আলী খোন্দকারের পরিবার, সামরিক কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন ফকিরের পরিবার ও গোলাম মোস্তফার পরিবার। এ ছাড়া দুই ব্যক্তি হলেন আওয়ামী লীগের নেতা এইচ বি এম ইকবাল ও আমেরিকা-প্রবাসী শেয়ারব্যবসায়ী মনিরউদ্দিন আহমেদ। আর প্রতিষ্ঠান দুটি হলো নূর আলীর মালিকানাধীন ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস এবং লুৎফর রহমানের মালিকানাধীন নিউ ইংল্যান্ড ইক্যুইটি।
এর বাইরে বিএনপির নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালুর বিও হিসাবে কারসাজির ঘটনা খুঁজে পাওয়া গেলেও ওই হিসাব থেকে টাকা তুলে নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) অপ্রকাশিত এক তদন্ত প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। এসইসির নির্বাহী পরিচালক আশরাফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এই বিশদ তদন্ত প্রতিবেদনটি গত ডিসেম্বরে কমিশনের চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেনের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।
এর আগে ২০১১ সালের ২০ জুন অমনিবাস হিসাবের আওতায় পরিচালিত কিছু বিও হিসাবের অস্বাভাবিক লেনদেন অধিকতর তদন্তের জন্য দুই সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিশনের পরিচালক মাহমুদুল হক ও সহকারী পরিচালক ওহিদুল ইসলামকে এ তদন্তভার দেওয়া হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে মোসাদ্দেক আলী, লুৎফর রহমান, ইয়াকুব আলী খোন্দকারসহ বেশ কয়েকজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে ধরা হয়। তা সত্ত্বেও এসইসি এখনো পর্যন্ত তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি তদন্ত প্রতিবেদনটি এখন পর্যন্ত গোপন রাখা হয়েছে। কমিশনের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরাও এ তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে কিছুই জানেন না।
অপ্রকাশিত বা গোপন করে রাখা সেই তদন্ত প্রতিবেদনের একটি কপি প্রথম আলোর হাতে এসেছে। এই তদন্ত প্রতিবেদনে এবি ইনভেস্টমেন্ট, প্রাইম ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট ও সাউথ ইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেস লিমিটেডের অমনিবাস হিসাবের মাধ্যমে এসব পরিবার ও ব্যক্তির কারসাজির বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এসইসির অধিকতর তদন্তের আওতায় এসব বিষয় উদ্ঘাটিত হয়।
তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত কয়েক বছরে পরিবার পাঁচটি শেয়ারবাজার থেকে তুলে নিয়েছে ৩৬৮ কোটি ২১ লাখ টাকারও বেশি অর্থ। এর মধ্যে লুৎফর রহমান ও তাঁর স্ত্রী সোমা আলম রহমানের নামে পরিচালিত তিনটি বিও হিসাব থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে প্রায় ৯২ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। লুৎফর রহমানের মালিকানাধীন নিউ ইংল্যান্ড ইক্যুইটির নামে পরিচালিত বিও হিসাব থেকে তুলে নেওয়া হয় প্রায় ৪৮ কোটি টাকা।
লুৎফর রহমানের স্ত্রীর বড় ভাই আহসান ইমাম ও তাঁর স্ত্রী মেহজাবীন মোস্তফা ইমামের মোট তিনটি বিও হিসাবের মাধ্যমে তুলে নেওয়া হয়েছে ৫২ কোটি ২৮ লাখ টাকারও বেশি। এর মধ্যে আহসান ইমামের দুটি বিও হিসাব থেকে তুলে নেওয়া হয় প্রায় ৪১ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
ইয়াকুব আলী খোন্দকার ও তাঁর মেয়ে সারাহ খোন্দকারের তিনটি বিও হিসাব থেকে তুলে নেওয়া হয় ৬৪ কোটি ৮১ লাখ টাকারও বেশি। গোলাম মোস্তফা ও তাঁর স্ত্রী নাসিমা আক্তারের দুটি বিও হিসাব থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে ১০৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকারও বেশি। এ ছাড়া আমজাদ হোসেন ফকির ও তাঁর স্ত্রী রোকসানা আমজাদের দুটি বিও হিসাব থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে প্রায় ছয় কোটি টাকা।
দুই ব্যক্তির মধ্যে মনির উদ্দিন আহমেদ নামের একজন শেয়ার ব্যবসায়ী তাঁর দুটি হিসাব থেকে তুলে নিয়েছেন প্রায় পৌনে চার কোটি টাকা। আর আওয়ামী লীগের নেতা ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান এইচ বি এম ইকবাল তাঁর একটি বিও হিসাব থেকে তুলে নিয়েছেন প্রায় ১০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। আর নূর আলীর মালিকানাধীন ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টসের নামে থাকা বিও হিসাব থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে ৫৩ কোটি ৪৬ লাখ টাকারও বেশি।
এঁদের মধ্যে রোকসানা আমজাদ, লুৎফর রহমান, আহসান ইমাম, মেহজাবীন মোস্তফা ইমাম, ইয়াকুব আলী খোন্দকার, এইচ বি এম ইকবালের বিরুদ্ধে ঋণসুবিধা-বহির্ভূত শেয়ারে বেআইনিভাবে ঋণসুবিধা গ্রহণ করে কারসাজির অভিযোগ আনা হয়। আর গোলাম মোস্তফা, নাসিমা আক্তার এবং মোসাদ্দেক আলীর বিরুদ্ধে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স ১৯৬৯-এর ১৭(ই) ধারা লঙ্ঘনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১১ সালের ১৫ জুন সময়কালের মধ্যে এসব কারসাজি ও আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে।
বক্তব্য: তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে এসইসির চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেনের কাছে জানতে চাইলে গত সোমবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেকগুলো তদন্তই তো হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিভাগে ও ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা না বলে সেগুলো কী অবস্থায় আছে তা বলতে পারব না।’ পরে মঙ্গলবার তাঁর সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলার জন্য একাধিকবার তাঁর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলেও তিনি ফোন ধরেননি।
তদন্ত প্রতিবেদনে উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে ইয়াকুব আলী খোন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত এ ধরনের অভিযোগ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। এসইসি থেকে এ ব্যাপারে আমাকে কিছুই জানানো হয়নি। কখন, কিসের ভিত্তিতে এ অভিযোগ করা হয়েছে, তা না জেনে কিছু বলা কঠিন। তবে আমার জানামতে, আমি কখনো নির্ধারিত ঋণসীমার বাইরে কোনো শেয়ারে ঋণসুবিধা নিইনি।’
অভিযোগের বিষয়ে গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমি কিছুই জানি না। কেউ এ বিষয়ে আমার কাছ থেকে কোনো বক্তব্য বা তথ্যও নেয়নি। তাই পুরো বিষয় না জেনে এ মুহূর্তে কিছুই বলতে পারছি না।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান এইচ বি এম ইকবালের সঙ্গে কথা বলার জন্য ব্যাংকটির জনসংযোগ কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে তিনি বলেন, ‘স্যার অফিসে আছেন কি না তা জেনে আমি আপনাকে জানাচ্ছি।’ এরপর তিনি আর ফোন করেননি, ফোন ধরেনওনি।
ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টসের নূর আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তদন্ত সম্পর্কে কিছুই জানেন না, তাঁর সঙ্গে কেউ যোগাযোগও করেননি। এর সত্যতা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন।
এ ছাড়া মোসাদ্দেক আলীর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। লুৎফর রহমান দেশের বাইরে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.