বেইজিংয়ের দুঃস্বপ্ন লন্ডনেও

একটু যেন চিন্তিতই দেখাচ্ছিল তাঁকে। তবে কি মনের পর্দায় ভিড় করেছিল চার বছর আগের দুঃস্মৃতি! হবে হয়তো। হয়তো মনের গহিন কোনো কোণে ভিড় করেছিল ভয়ের মেঘ। শঙ্কাটাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো। চার বছর আগের বেইজিং অলিম্পিকের মতোই কাল লন্ডনেও খোঁড়াতে খোঁড়াতে ট্র্যাক থেকে বেরিয়ে গেলেন লিউ শিয়াং! ১১০ মিটার


হার্ডলসের সাবেক রাজা এবারও বাদ হিটেই। কী বলবেন একে ভাগ্যের পরিহাস ছাড়া!
কাল ৬ নম্বর হিটে অংশ নিয়েছিলেন লিউ। ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকে সোনা জয়, হার্ডলসের সাবেক বিশ্ব রেকর্ডধারী। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড থেকে চীনের ইতিহাসে প্রথম সোনা এনে দিয়েছেন তিনিই। বাস্কেটবল তারকা ইয়াও মিংয়ের পাশাপাশি চীনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রীড়াবিদও। স্বাভাবিকভাবেই বাছাইপর্বে তাঁর খেলা দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন চীনা সাংবাদিকেরা। বিশেষ করে, কিছুদিন ধরে লিউ যে ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন বেইজিং-দুঃস্বপ্ন কবর দিয়ে দুর্দান্ত কিছু করার।
এ বছর সাংহাই গ্রাঁ প্রিঁতে নিজের ঘরের ট্র্যাকে ১২.৯৭ সেকেন্ড টাইমিং করেছিলেন, গত পাঁচ বছরের মধ্যে যেটি ছিল লিউয়ের প্রথম ১৩ সেকেন্ডের নিচে করা টাইমিং। এরপর ওরেগনে করেন ১২.৮৭। ডেরন রবলেসের বিশ্ব রেকর্ডটা ছুঁয়েই দিয়েছিলেন, কিন্তু সেবার বাতাসের আনুকূল্য অনুমোদিত সীমার বেশি থাকায় রেকর্ডটার পাশে লেখা হয়নি তাঁর নাম।
তা না হোক, অলিম্পিক-মুকুট পুনরুদ্ধারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনে হচ্ছিল। কিন্তু বেইজিংয়ে যে অ্যাকিলিস ইনজুরি তাঁর স্বপ্নকে বধ করেছিল, কাল সেটাই কাল হলো। প্রথম হার্ডলটি পেরিয়ে যাওয়ার জন্য যে-ই না লাফ দিয়েছেন, ওমনি পেশির টান। হুড়মুড় করে হার্ডলটি নিয়ে পড়ে গেলেন। সেখানেই পড়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। লাল ট্র্যাক তখন যেন আরও লাল হয়ে উঠছিল তাঁর অদৃশ্য রক্তক্ষরণে।
এরপর দুই হার্ডলার ব্রিটেনের অ্যান্ডি টার্নার আর স্পেনের জ্যাকসন কুইনোনেজের কাঁধে ভর করে বেরিয়ে আসেন। হুইলচেয়ারে তোলা হয় লিউকে। দর্শকদের দিকে হাত নাড়িয়ে চলে যান এই ২৯ বছর বয়সী। এবারের চোটটির কারণে তাঁর ক্যারিয়ারই শেষ হয়ে গেল বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আশঙ্কা সত্যি হলে একজন দুর্দান্ত অ্যাথলেটের ক্যারিয়ারের এ হবে করুণ এক সমাপ্তি।
লিউয়ের এভাবে ছিটকে পড়াটাকে অ্যারিয়েস মেরিট বলছেন ‘ট্র্যাজেডি’। সবগুলো হিট মিলিয়ে প্রথম হয়েছেন এবার সোনার সবচেয়ে বড় দাবিদার মেরিট। নিজের ব্যক্তিগত সাফল্য যেন লিউয়ের বেদনায় আড়াল হয়ে যাচ্ছে মার্কিন হার্ডলারের কাছে, ‘এটা ছিল ভয়াবহ। সর্বকালের অন্যতম সেরা হার্ডলারের সঙ্গে যখন এমনটা হয়, এটা স্রেফ একটা ট্র্যাজেডি। হার্ডলসে কোনো হার্ডলে আপনি যদি ধাক্কা খান, সেটা সামলে নেওয়া প্রায় অসম্ভব। এটা খুবই লজ্জার যে, এই ঘটনা লিউয়ের সঙ্গেই ঘটল। কারণ, আমি ওর সঙ্গে লড়াই করার জন্য মুখিয়ে ছিলাম।’
কেন এমনটা আবার ঘটল, এ নিয়ে শুরু হয়ে গেছে আলোচনা। মেরিটের ব্যাখ্যা, প্রথম হার্ডল পেরিয়ে যাওয়ার জন্য খানিকটা আগে লাফিয়ে উঠেছিলেন লিউ। কিন্তু ভারসাম্য ধরে রাখতে পারেননি। তবে বেশির ভাগই বলছেন, ভারসাম্য, পেশিতে টানের সঙ্গে মানসিক একটা ভয়—সব মিলিয়েই লিউ এদিন ছন্দ হারিয়ে হার্ডলে হোঁচট খেয়েছেন।
লিউ যখন হোঁচট খান, যখন শুধু তিনি নন; একই সঙ্গে ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে ১০০ কোটি মানুষ। বেইজিংয়ে বার্ডস নেস্টে চীনারা সেই ঘটনা তো একেবারে চোখের সামনে দেখেছে। এবার দূর দেশে হলেও ধাক্কাটা ভালোমতোই লেগেছে। সেই হাহাকার উঠে আসছে চীনাদের প্রতিক্রিয়ায়। টুইটারের চীনা সংস্করণ সিনা ওয়েইবোতে একজন লিখেছেন, ‘এই একটা মানুষের চোটে ১৩০ কোটি মানুষ ব্যথা পায়।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘পেশাদার ক্রীড়াজগৎ সত্যিই বড় নির্মম।’ সোয়াহফং ইউজারনেম ব্যবহারকারী একজন লিখেছেন, ‘তুমি এখনো আমাদের হিরো।’
এদিন ট্র্যাক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে শেষ হার্ডলটিতে চুমু এঁকে দিয়েছেন লিউ। কে জানে, হয়তো এটাই বিদায়ী চুম্বন! এএফপি, রয়টার্স।

No comments

Powered by Blogger.