ভেজালকারীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড

আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা হোক মাছে ও দুধে মেশানো হয় ফরমালিন। ফলমূল পাকাতে ব্যবহৃত হয় কার্বাইড। মুড়িতে ব্যবহার করা হয় ইউরিয়া। সারা দুনিয়ায় ডিডিটি নিষিদ্ধ হলেও আমাদের দেশে শুঁটকি তৈরিতে এখনো ডিডিটি ব্যবহৃত হয় বলে জানা যায়। পোকার আক্রমণ থেকে বাঁচাতে সবজিতে সরাসরি কীটনাশক স্প্রে করা


হয় এবং কীটনাশক সক্রিয় থাকতেই সেগুলো বাজারজাত করা হয়। গুঁড়া মসলা, চানাচুর ও রঙিন খাবারে ব্যবহার করা হয় শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর কাপড়ের রং। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, এই রঙে রয়েছে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান। শুধু তাই নয়, মুরগিকে যে খাবার দেওয়া হয়, সেই পোলট্রি ফিড তৈরি হয় ট্যানারি শিল্পের বর্জ্য দিয়ে। অথচ ট্যানারির বর্জ্যে ক্রোমিয়ামসহ এমন সব বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য থাকে, যেগুলো দীর্ঘদিন সক্রিয় থাকে এবং মুরগির মাংসের মাধ্যমে মানবদেহে চলে আসে। খাদ্যে ভেজালের এ তালিকা অনেক লম্বা ও ভয়াবহ। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ কোথায় যাব কিংবা কী খাব? অনেকে বিষের ভয়ে ফল খাওয়া ছেড়েই দিয়েছেন। অথচ শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির প্রতিদিন কমপক্ষে ১১৫ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন। তদুপরি বিপাক ক্রিয়া কিংবা অক্সিডেশনের কারণে শরীরে সৃষ্টি হওয়া ফ্রি-র‌্যাডিক্যালস বা মুক্তকণা নানা ধরনের রোগব্যাধির কারণ। কিছুদিন আগে বিষাক্ত লিচু খেয়ে ১৩ জনের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল। তার আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক বাগান মালিক আমগাছে বিষ দেওয়ার পর নিচে পড়া আম খেয়ে তাঁর নিজের সন্তানই মারা গেছে। বিভিন্ন হাসপাতালের তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে ক্যান্সার, কিডনি ও লিভারের রোগীর সংখ্যা অতি দ্রুত বেড়ে চলেছে। এর জন্য প্রধানত দায়ী এসব ভেজাল ও বিষ মেশানো খাবার। শুধু খাবার নয়, অসুস্থ হলে যে ওষুধ খেয়ে আমরা বাঁচার চেষ্টা করি সেই ওষুধেও ভেজাল। ইটের গুঁড়ার সঙ্গে নানা রকম কেমিক্যাল মিশিয়েও ওষুধ তৈরি করা হয়। নিম্নমানের ওষুধ তো আছেই। কিন্তু যে বিষয়টি আমাদের অবাক করে তা হলো, এত আলোচনা, এত লেখালেখির পরও তা প্রতিরোধে সরকারের বিশেষ কোনো উদ্যোগ আমরা দেখছি না। কালের কণ্ঠে গতকাল মঙ্গলবার এ বিষয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
কালেভদ্রে যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়, সেটি আসলে কোনো পদক্ষেপই নয়। এসব আদালত খাদ্যে ভেজালকারীদের দু-এক মাসের জেল বা কিছু টাকা জরিমানা করে থাকেন। অনেকেই একে 'গুরু পাপে লঘু দণ্ড' মনে করেন। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন অনুযায়ী, খাদ্য ও ওষুধে ভেজাল মেশানো, বিক্রি করা বা বিক্রির জন্য প্রদর্শন করার জন্য মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা ১৪ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এত ভেজালের ছড়াছড়ি সত্ত্বেও এ পর্যন্ত কোনো ভেজালকারীর সে রকম কঠোর কোনো শাস্তি হয়েছে কি? হয়নি। ১৯৯২ সালে বিষাক্ত প্যারাসিটামল খেয়ে কেবল শিশু হাসপাতালেই তিন শতাধিক শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। তার জন্য কি কাউকে কঠোর কোনো সাজা ভোগ করতে হয়েছে? হয়নি বলেই আবার ২০০৯ সালে তিনটি ওষুধ কম্পানির বিষাক্ত প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে আরো ২৭ শিশুকে জীবন দিতে হয়েছে। মামলার দীর্ঘসূত্রতা, অতঃপর সাক্ষী বা তথ্য-প্রমাণের অভাবে ভেজালকারীদের পার পেয়ে যাওয়া এ দেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। অথচ চীনে ২০০৫ সালে একটি নিম্নমানের অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে ১১ জন মারা গিয়েছিল। অথচ সেই অপরাধে দেশটির খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের প্রধান এবং তাঁরই পদমর্যাদার দুজনকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। আর আমাদের এখানে আইন থাকলেও তার কোনো প্রয়োগ নেই। উপরন্তু মাননীয় হাইকোর্ট ২০০৯ ও ২০১০ সালে দুটি রায়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেগুলো পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়নি। এর চেয়ে দুঃখজনক উদাসীনতা আর কী হতে পারে? জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে উদাসীনতা কাম্য নয়।

No comments

Powered by Blogger.