বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রদায়িকতা by ইকবাল আজিজ

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যেক মানুষের নিজ নিজ ধর্ম পালনের অবাধ স্বাধীনতা আছে; অন্যের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের অধিকার কারও নেই। কোন শিক্ষিত আধুনিক মানুষ সাম্প্রদায়িক হতে পারেন না। জ্ঞান বিজ্ঞান ও শিক্ষায় পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে; কিন্তু বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার ভূত এখনও পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়নি।


এখনও বর্ণবাদ ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার কারণে পৃথিবীতে রক্ত ঝরছে। একবিংশ শতকে মানবজাতির জন্য এর চেয়ে বড় অপমান আর কী হতে পারে? সাম্প্রদায়িকতার কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তা গড়ে উঠতে পারেনি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর ১৯৪৭ সালের দেশভাগের অন্যতম মূল কারণ তৎকালীন সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। অবিভক্ত ভারতবর্ষে অনেক বড় জাতীয়তাবাদী নেতার আবির্ভাব ঘটেছে; কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ জোরদার আন্দোলন কেউই গড়ে তোলেননি। বরং নিজ নিজ সম্প্রদায়ের উন্নয়ন ও স্বার্থরক্ষাই ছিল নেতৃবৃন্দের প্রধান লক্ষ্য। অপরদিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের ‘ডিভাইড এ্যান্ড রুল’ নীতির কারণে ঔপনিবেশিক আমলে এদেশে কখনই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে উঠতে পারেনি। বিংশ শতকের প্রথম চার দশকে সাম্প্রদায়িকতার কারণে অবিভক্ত বঙ্গে একটি ঐক্যবদ্ধ বাঙালী জাতীয়তার বিকাশ সম্ভব হয়নি। শেরেবাংলা ফজলুল হক তাঁর ‘কৃষক প্রজা পার্টি’র মাধ্যমে যে কল্যাণকামী রাজনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন, দুটি সম্প্রদায়ের পর্যাপ্ত সমর্থনের অভাবে তারও পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব হয়নি। বরং ১৯৩৭ সালের পর থেকে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও অবিশ্বাস ক্রমেই বেড়েছে। এই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষই ১৯৪৬ সালের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রূপ নিয়েছে; অনেকেই এই হিন্দু-মুসলমান ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গাকে ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ হিসাবে অভিহিত করেছেন। মাত্র দু-তিন দিনের এই দাঙ্গায় যে বিপুল সংখ্যক হিন্দু-মুসলমান নিহত হয়েছিলেনÑতাদের মধ্যে বেশিরভাগ ছিলেন সম্পূর্ণ নিরপরাধ। এরা দাঙ্গায় অংশ নেননি; শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে নিহত হন। দাঙ্গার সময় হিন্দু মরেছেন মুসলমানের হাতে, অন্যদিকে মুসলমান মরেছেন হিন্দুর হাতে। অনেক অরাজনৈতিক মানুষ সেদিন দাঙ্গার উন্মাদনায় ‘উন্মাদ’ হয়ে মানুষ খুন করেছেন। আসলে সাম্প্রদায়িকতার চেতনা খুব নিরীহ নিষ্পাপ মানুষকেও অমানুষ করে দেয়। তবে দাঙ্গায় অংশ নেয় নানা শ্রেণীর অপরাধী ও লুটেরা। আর এর পেছনে উস্কানি দেয় সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিকরা।
সম্প্রতি বাংলাদেশের দিনাজপুরে চিরিরবন্দর উপজেলা পল্লীতে জনৈক জামায়াত নেতার উস্কানিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়। জানা গেছে, একটি মসজিদ নির্মাণকে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে ধর্মীয় কট্টরপন্থীরা এই হামলা চালায়। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর পরিচালিত এই হামলাকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। অনেকেরই ধারণা, জামায়াতের উস্কানিতে এই হামলার মূল উদ্দেশ্য, দেশে বড় ধরনের দাঙ্গার সূত্রপাত করা। চিরিরবন্দর উপজেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার সময় মারপিট, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটে। সংখ্যালঘুদের ওপর এ হামলার খবর দেশের প্রায় সব প্রধান পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ খবর পড়ে অনেকেরই মনে সংশয়ের সৃষ্টি হবে, আমরা কি ২০১২ সালের বাংলাদেশের বসবাস করছি? এ হামলার বিস্তারিত বিবরণ পড়ে অনেকেরই মনে হতে পারে, ১৯৭১ সালের বর্বর পাকিস্তানী বাহিনীর হামলার কথা। ১৯৭১ সালে জামায়াতের নেতা ও কর্মীরা অনেকেই পাকিস্তানী বাহিনীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল। হানাদারদের সঙ্গে তারাও হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িত ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে জামায়াত সাময়িকভাবে গা-ঢাকা দিয়েছিল। তখন বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের অনেকেই ছিল জামায়াতের নেতা কিংবা কর্মী। ১৯৭৫ সালে স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শহীদ হবার পর এই বিচার কার্যক্রম রহস্যজনকভাবে স্থগিত হয়ে যায়। এ কথা বিনা দ্বিধায় বলা যায়, স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে জামায়াতের ঘনিষ্ঠ সংযোগ রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে অনেকেই ‘জামায়াত’ ও ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ শব্দ দুটিকে সমার্থক বলে মনে করেন। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর সামরিক স্বৈরাচারী শাসক ও স্বাধীনতাবিরোধীদের পৃষ্ঠপোষকতায় জামায়াত ফের বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজের সর্বস্তরে পুনর্বাসিত। তখন কেউই জামায়াতের এই পুনর্বাসনকে প্রতিরোধ করতে পারেনিÑএটা আমাদের সবার জন্য দুর্ভাগ্যজনক। এরপর আমাদের চোখের সামনেই জামায়াতের শক্তি ক্রমেই বেড়েছে। অনেক আর্থিক, সামাজিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে। স্বাধীনতা চল্লিশ বছর পর জামায়াত এখন নবপর্যায়ে ফ্রাঙ্কেনস্টাইলের মতো ভয়াবহ ধ্বংসের ক্ষমতা নিয়ে জাগ্রত। আমাদের অচেতনার অন্ধকারে তার জন্ম, সে এখন বাঙালীর সমগ্র জাতিসত্তাকে গিলে খেতে চায়। জামায়াত নেতার উস্কানিতে দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়িতে যে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে তা কেবল একটি ‘টেস্টকেস’ বা ‘প্রতীকী ঘটনা’ মাত্র; এরপর আরও বড় ধরনের হামলা তারা চালাতে পারে। এর একটিই উদ্দেশ্য, তা হলো দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দেওয়া; দাঙ্গার মাধ্যমে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করা। সেই সঙ্গে এই প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের আরও একটি উদ্দেশ্য আছে বলে আমি মনে করি। বর্তমানে মহাজোট সরকারের নেতৃত্বে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জামায়াত দেশব্যাপী শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্টের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বানচাল করতে চায়। দেশের ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ষড়যন্ত্র রুখতে সরকারকে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে।
সাম্প্রদায়িক শক্তি শুধু বাংলাদেশেই তৎপর নয়। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশে আছে প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তি। মাত্র কিছুদিন আগে ভারতের অসমের বোরো আদিবাসী ও মুসলমানদের মধ্যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল। দাঙ্গা এ পর্যন্ত ৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ দাঙ্গায় উস্কানি যুগিয়েছে ভারতীয় সাম্প্রদায়িক সংগঠন বিজেপি। বিজেপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, দাঙ্গায় বাংলাদেশের হাত রয়েছে। তাদের এই অপপ্রচারের উদ্দেশ্য অসমে সংঘটিত দাঙ্গার জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করা। আসলে সারা ভারতে বিজেপি শিবসেনা প্রভৃতি সংগঠন সেখানকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। সেখানে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পেছনে এ দুটি সংগঠনের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের শাসনামলে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও হয়নি; তবে মুসলমানদের আর্থসামাজিক অবস্থারও উন্নতি হয়নি। তৃণমূলের শাসনামলে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক শান্তি বজায় থাকবে বলে মনে করি। তবে মমতা ব্যানার্জী যেভাবে মাদ্রাসা শিক্ষা ও রামকৃষ্ণ মিশনের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন তাতে সেখানে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শ্রীলঙ্কায় সিংহলী-তামিল সংঘর্ষ বন্ধ হয়েছে। একই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অনেকখানি জোরদার হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় সর্বস্তরের আধুনিক শিক্ষার বিকাশ এর প্রধান কারণ।
মাদ্রাসা শিক্ষা যে একটি সমাজব্যবস্থাকে অনেক পিছিয়ে দেয়, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ পাকিস্তান। সেখানে তালেবানদের জন্মই হয়েছিল মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে। মাদ্রাসার অনেক ছাত্র বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে হয়েছিল তালেবান। এরা আধুনিক প্রগতিশীলতার বিপক্ষে। একজন তালেবান নেতা সম্প্রতি পাকিস্তানের উত্তম-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে শিশুদের পোলিও টিকা নিষিদ্ধের কথা ঘোষণা করেছেন। তিনি মার্কিন বাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে এ কথা ঘোষণা করেছেন। আসলে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় প্রগতিশীল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বরং সেক্যুলার কল্যাণকামী চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে হবে সর্বত্র। ধর্মীয় কট্টরপন্থা ও সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে কখনই সেক্যুলার কল্যাণমূলক তৎপরতা অব্যাহত রাখা সম্ভব না। এর মধ্য দিয়ে উদারনৈতিক মানবতার বিকাশ অসম্ভব। প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের নির্মমভাবে বিতাড়ন করা হচ্ছে; রোহিঙ্গাদের একমাত্র অপরাধ তারা মুসলমান। সাম্প্রদায়িকতার প্রধান দোষ হলো, এখানে একজন মানুষকে মানুষ হিসাবে বিবেচনা করা হয় না; বরং তার ধর্মীয় ও বর্ণগত পরিচয়কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। মানুষ হিসাবে এ এক ভয়ঙ্কর আত্মঘাতী প্রবণতা। দক্ষিণ এশিয়ায় সব ধরনের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা দরকার। এ জন্য বাংলাদেশকেই পথপ্রদর্শক হতে হবে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে বাংলাদেণের জন্ম হয়েছিলÑতার অন্যতম মূলনীতি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। সেই ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ সমাজের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার অবসান সম্ভব। দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে সাম্প্রদায়িকতার যে অশনি সংকেত দেখা গেছে, তার সমূলে বিনাশ চাই। সেই সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রসমূহের ঐক্য অপরিহার্য। তা না হলে এসব দেশে সত্যিকার গণতন্ত্র ও আধুনিকতার বিকাশ সম্ভব নয়।
র qbalaziz.poet@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.