ঘুষ-দুর্নীতির ব্যাপারে সরকার নির্বিকার by আবুল হাসানাত

যতই দিন যাচ্ছে, সরকারের কাণ্ডারি দিশেহারা হয়ে পড়ছে। এত সমস্যার বোঝা যে, বর্তমান সরকার তার ভার বইতে পারছে না। কাণ্ডারির তরী দিগ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। যে সমস্যাগুলো তীব্র আকার ধারণ করেছে, এর পরিমাণ কম নয়। আমাদের জনগণের দুর্ভাগ্য যে সরকার সেগুলোর সমাধান করতে ব্যর্থ হচ্ছে।


মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপদেষ্টার সংখ্যা বেশি হওয়া সত্ত্বেও সমস্যা চিহ্নিত করে ধীরেসুস্থে সমাধান করার প্রয়াস বর্তমান সরকারের মধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা যেসব বাণী অহরহ দিচ্ছেন এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়ে চলেছেন, তা নেহাতই স্বপ্ন; আকাশকুসুমও বলা চলে।
সরকারের দুর্বলতা ধরা পড়ে সমন্বয়হীনতার মধ্যে। প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রীর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। মন্ত্রীর সঙ্গে সচিবের সম্পর্ক যে কাজের জন্য শুভ, তাও বলা চলে না। উপরন্তু মাথার ওপর বসে আছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা। তাঁরা মন্ত্রীদের ওপরে যে সুপার মিনিস্টার। মাঝেমধ্যে তাঁদের বক্তব্যে এটা ফুটে ওঠে। বিশেষ করে জ্বালানির ক্ষেত্রে তৌফিক-ই-ইলাহীর কর্মকাণ্ডে।
সংকটের চিত্রটি কী রকম? প্রথমেই বলি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানি সংকট, রেন্টাল বিদ্যুতের কারণে দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের নেতা-উপনেতা-পাতিনেতাদের পুকুরচুরি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, প্রশাসনে দলীয়করণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গিন অবস্থা, শেয়ারবাজারে বিপর্যয়, রেলের দামি জমি দখল ইত্যাদি। চরম আশাবাদী মানুষও আজ হতাশাগ্রস্ত। তারা হিসাব মেলাতে পারছে না। অথচ মন্ত্রী-উপমন্ত্রী-উপদেষ্টাদেরও কথার ফুলঝুরি কমে না। তখন মনে হয় বিপুল ভোটে বিজয়ী আওয়ামী লীগ যে আশার আলো জ্বালিয়েছে তা এই সাড়ে তিন বছরের মাথায় একেবারে নিভে গেছে।
আরেকটি বিষয় আমাদের বিস্মিত করে। ভুল হলে তো মানুষ সংশোধন করে। কিন্তু বর্তমান সরকার ওপথে হাঁটে না। এ সম্পর্কে অসাধারণ ও সময়োপযোগী একটি সম্পাদকীয় বেরিয়েছে কালের কণ্ঠে (৩০.৭.২০১২) : ...শাসক দলের একগুঁয়েমি ও অসহিষ্ণুতা দেশকে আরো সংকটের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। বিরোধী দল কিংবা মতের প্রতিও সরকারের অসহিষ্ণুতা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
সরকারের দলীয়করণ, প্রশাসন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে যে সৎ নাগরিকমাত্রই চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন। মূল সমস্যার দিকে নজর না দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ভাসা ভাসা কথা বলছেন। প্রয়োজন সমস্যাগুলোর গভীরে যাওয়া। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এটা প্রকট হয়ে দেখা দিল পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের বিভিন্ন সময় নানা রকম ভাষ্যে, বক্তৃতায় ও আলোচনায়। স্পষ্ট করে কোনো মন্ত্রী, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু নির্মাণের জট খুলে দেশবাসীকে প্রকৃত সত্য বুঝতে দিলেন না। বিরাট নাটক করে সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করলেন। কিন্তু এত দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর পদত্যাগ কাজে এলো না; বরং প্রধানমন্ত্রী তাঁকে যে প্রশংসাপত্র দিলেন, তা বিষয়টি আরো জটিল করে তুলল।
আমরা আশার কথা বলেছি। নির্বাচনের পর সত্যিই আমরা আশাবাদী হয়েছিলাম। উপরন্তু প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী মুখচেনা প্রবীণ নেতাদের মন্ত্রী না বানিয়ে আমাদের প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। তিনি বহু আশা করে এবং আমাদের মনে আশার দীপ জ্বালিয়ে বেশ কয়েকজন তরুণকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। দুঃখের বিষয়, তাঁরা আমাদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছেন। সে জন্য কেবল সংকটের পর সংকটের সম্মুখীন হয়েছে সরকার। এসব সমস্যার জন্য বিএনপি দায়ী- এ অভিযোগ ধোপে টেকে না। কারণ বিএনপির অযোগ্যতা ও ভুলের জন্যই দেশবাসী আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছিল।
আরেকটি সমস্যা বাংলাদেশকে কুরে কুরে খাচ্ছে, তা হচ্ছে ঘুষ ও দুর্নীতি। এটি সব সময় ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে এটা খুবই বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষা বিভাগ থেকে শুরু করে পুলিশ, বিমান থেকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়- সর্বত্র প্রায় প্রকাশ্যে এবং অধিকারবলে যেকোনো পাবলিকের কাজের জন্য ঘুষ নেওয়া হয়। এই বিশাল ঘুষ-বাণিজ্য দূর করা নয়, কিছুটা কম করতে পারত যদি সরকার সৎ হতো। কিন্তু সরকার যে অসৎ, তা প্রমাণিত হলো সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগে।
সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, এই ঘুষ-দুর্নীতি সম্পর্কে সরকার সচেতন নয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান ঘটা করে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই কমিশনের প্রধান একজন আমলা ও চাকরিজীবী এবং আওয়ামী লীগের লোক। এই কমিশন কী কাজ করছে, কতগুলো দুর্নীতি দমন করেছে তা গবেষণাসাপেক্ষ। জনস্বার্থে আসলে কোনো কমিশন নেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, আগের কমিশন দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য কতকগুলো প্রস্তাব দিয়েছিল। বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রধান দুর্নীতি দমন কমিশনার ঘোষণা দিলেন, নতুন কোনো আইন করার প্রয়োজন নেই। কমিশন এমনিতেই যথেষ্ট শক্তিশালী। বোঝা গেল, প্রধান দুর্নীতি দমন কমিশনার অলংকার মাত্র, তা না হলে কমিশনকে শক্তিশালী করবেন না কেন। কমিশন যেটুকু কাজ করছে তা বিরোধীদলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া শিক্ষা, বিমান, যোগাযোগ, স্বরাষ্ট্র ও রেল মন্ত্রণালয়ে যে পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি চলছে, সে সম্পর্কে দুর্নীতি দমন কমিশনের কোনো ভূমিকা নেই। ফলে কমিশন একটা ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে যে সমস্যাটি প্রবল এবং ভবিষ্যতে ভয়াবহ হয়ে উঠবে তা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে দুই দলের ভূমিকা। বিএনপি আবার বলে দিয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না এবং আওয়ামী লীগ, বিশেষ করে তার নেতা শেখ হাসিনা পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় কোনো নির্বাচন হবে না। কারণ সংবিধানে এটা লেখা নেই। অথচ আমরা সবাই জানি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দুই টার্ম নির্বাচন করার কথা সংবিধানে আছে।
নির্বাচন হতে এখনো দেড় বছর বাকি। ইতিমধ্যে এই দাবিতে মাঠ গরম করে ফেলেছে বিএনপি। রোজার জন্য আন্দোলন স্থগিত রয়েছে। রমজান শেষে ঈদের পর প্রবল আন্দোলন শুরু করবে বিএনপি। এটা দলের কোনো ফাঁকা আওয়াজ নয়। এটা তাদের প্রতিজ্ঞা। কারণ এটা ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। ফলে এ দলের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বিএনপির জয় অবশ্যম্ভাবী- এটা তারা বিশ্বাস করে। ফলে দুই দলের দুই মেরুতে অবস্থান হবে এবং সাংঘর্ষিক অবস্থা বিরাজ করবে। সেই সংঘর্ষ, দ্বন্দ্ব ও সংঘাত দেশকে কোন সর্বনাশের পথে নিয়ে যাবে তা দেখার জন্য আমাদের আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক : কথাশিল্পী ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.