ঈদের পর দুই দলের সংলাপ-রাজনীতি by পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য ও শফিক সাফি

ঈদের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি কৌশলী রাজনীতি নিয়ে মাঠে নামছে। বড় দুটি দলই এক ধরনের সংলাপে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। এ সংলাপ হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে দেশে কোন ধরনের সরকার থাকবে অর্থাৎ কোন ধরনের সরকারের অধীনে ওই নির্বাচন হবে।
এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ প্রথমে মহাজোটের অন্য শরিকদের সঙ্গে, পরে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে সংলাপ করবে। আর বিএনপিও সরকারি দলের সঙ্গে সংলাপে বসতে প্রস্তুত আছে, তবে তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রয়োজনে সংলাপ এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন পাশাপাশি চলবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মুখোমুখি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনের সময় বিএনপিকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা গঠনের যে প্রস্তাব রাখেন এবং সেটাতেই অটল অবস্থান নেন, তা থেকে এখন কিছুটা সরে এসেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু অনির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা না দেওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে তারা। আর বিএনপি এখনো নির্দলীয় সরকারের দাবিতে অটল।
দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের বর্তমান অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কারণে ঈদের পর দেশের রাজনীতিই মূল আলোচনার বিষয়ে পরিণত হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিএনপি ইতিবাচক মনোভাব দেখালে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানানো হবে- এমন ঘোষণা দেওয়া হলেও ভেতরে ভেতরে বিরোধী দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছে ক্ষমতাসীন দলটি। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে সংলাপে আসতে রাজি না হলে সেই ক্ষেত্রে বিএনপির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করবে আওয়ামী লীগ। সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রী ও দলীয় নেতাদের বিভিন্ন ফোরামে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ইতিবাচক দিকগুলো বিএনপিকে বোঝানোর নির্দেশ দিয়েছেন। ঈদের পর তাঁরা মহাজোটভুক্ত দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবেন। এরপর দলটির পক্ষ থেকে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে সংলাপ করা হবে। সেই সংলাপের ভিত্তিতে সম্মানজনক সমাধান আসবে বলে মনে করছেন দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। আর এই প্রক্রিয়ায় কোনো সমাধান এলে জনগণও সেটার পক্ষে অবস্থান নেবে বলে মনে করছেন দলটির নেতারা।
ঈদের পর আওয়ামী লীগের সংলাপের কথা স্বীকার করে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, আওয়ামী লীগের তরফে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে, শরিক দলগুলোর সঙ্গে এবং বিএনপির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা হবে। বিরোধী দল আলোচনায় রাজি না হলে তাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এসব বৈঠকের মাধ্যমে সবার চাহিদা জানা যাবে এবং এভাবে সমাধান হলে তাতে জনসমর্থনও থাকবে। বিএনপির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে ক্ষমতাসীন মহাজোট শরিকরা। শরিক দলের নেতারা মনে করেন, বিএনপিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আলোচনার দরজা খুলে দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে ইতিবাচক সমাধানের পথে এগিয়েছেন। এখন বিএনপির উচিত প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসা। তিনি বলেন, সংবিধানে যা-ই থাকুক না কেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁর আহ্বানের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা কী হবে সেটা নির্ধারণে আলোচনার সূত্রপাত করেছেন। একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল সংলাপে বসে নির্বাচনকালীন নির্বাচন কমিশন, আমলাতন্ত্র, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী- এদের পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হবে এগুলো নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন হাসানুল হক ইনু।
অন্যদিকে বিএনপিও আন্দোলনের পাশাপাশি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা কী হতে পারে তা নিয়ে ঈদের পর শরিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবে বলে সূত্রে জানা গেছে। গত বৃহস্পতিবার দলটির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে আওয়ামী লীগ সংলাপের আহ্বান জানালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা, সেই সরকারের প্রধান কে হবেন এবং অন্য কে কে থাকবেন- সেগুলো তুলে ধরার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। সংলাপে গেলে আওয়াম লীগকে দলের পক্ষ থেকে একটি রূপরেখা উত্থাপন করা হবে। ইতিমধ্যে বিএনপির কিছু আইনজীবীকে নিয়ে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা এই রূপরেখা তৈরির কাজ করছেন বলে জানা গেছে। এই রূপরেখার অগ্রগতি নিয়েও বৃহস্পতিবারের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
ইস্যুটি নিয়ে বিএনপি ১৮ দলীয় জোটের শরিক ও সমমনা দলগুলোর সঙ্গেও ঈদের পরে বৈঠক করবে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া দাবি আদায়ে তাদের আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে শরিকদের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখবে বিএনপি।
সূত্র মতে, কী ধরনের কর্মসূচি নেওয়া যেতে পারে তা নিয়ে কয়েক মাস ধরেই কাজ করছেন দলটির নেতারা। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে দলের বেশ কয়েকজন সদস্যকে নির্দেশও দিয়েছেন খালেদা জিয়া। আন্দোলনের রূপরেখা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে। তবে পুরো বিষয়টির সমন্বয় করছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তাঁদের সার্বিক সহায়তা করছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার, ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকাসহ গুলশান অফিসের দুজন কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে দলের দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সরকারকে নির্বাচনে বাধ্য করা ছাড়া আমাদের বিকল্প কোনো রাস্তা নেই। আমরা সেই অনুযায়ী ঈদের পর কর্মসূচি ঘোষণা করব।' তিনি বলেন, 'ঈদের পর আমাদের স্থায়ী কমিটির বৈঠক হবে, তার আগে ১৮ দলীয় জোটের দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে। পরে কর্মসূচি চূড়ান্ত হবে।'
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, 'একটু খেয়াল করলে দেখবেন, সরকার তার আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। তারা প্রথমে যে গোঁ ধরে বসে ছিল, সেখান থেকে সরে এসে নতুন প্রস্তাব দিয়েছে। এটাকে আমরা পজিটিভ ধরতে পারি।' তিনি বলেন, সরকার ১৫তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে যে সংকট তৈরি করেছে তা তাদের নিজেদেরই সমাধান করতে হবে। কারণ তারা বুঝতে পেরেছে, এইভাবে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা যাবে না। তাই অবস্থান থেকে সরে এসে নতুন প্রস্তাবের কথা বলছে। তিনি বলেন, 'আমাদের বিশ্বাস, সরকার আরো একটু সরে এসে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দেবে। তার পরই আমরা বসব ওই সরকারের প্রধান ও অন্যরা কে হবেন, কিভাবে নির্বাচন হবে- এসব নিয়ে।'
তিনি আরো বলেন, দাবি না মানা পর্যন্ত প্রয়োজনে সরকারি দলের সঙ্গে সংলাপ এবং আমাদের রাজপথের আন্দোলন দুটিই একসঙ্গে চলবে।
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, 'সরকার আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিতে পারে। আমরাও রাজি আছি আলোচনা করতে। কিন্তু আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি, নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের ঘোষণা দিলেই আমরা যেকোনো আলোচনায় প্রস্তুত।' সংলাপের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব এলে বিএনপির অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, 'বিষয়টি সম্পর্কে আমার জানা নেই। তা ছাড়া কোনো কিছু সম্পর্কে আগাম বলা ঠিক নয়। সময় হলে এ বিষয়ে জানানো হবে।'
স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, 'সুনির্দিষ্ট এজেন্ডার ভিত্তিতে সরকার প্রস্তাব দিলে সংলাপ হবে তবে পাশাপাশি আন্দোলনও চলবে। সরকার আমাদের দাবি মেনে নিলে আমরা আন্দোলন থেকে সরে আসব। আর সংলাপ ভেস্তে গেলে আমরা আন্দোলনের গতি আরো কঠোর করব।' সরকারের প্রস্তাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'সরকার কী ধরনের সংলাপের প্রস্তাব দেয় তা আমাদের দেখতে হবে।'
স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ বলেন, 'আলোচনা আর আন্দোলন দুটি সঙ্গে নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। সরকার আমাদের দাবি মেনে নিলে আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। আর দাবি না মানলে আন্দোলন চলবে। দেশের স্বার্থে সরকারের উচিত দাবি মেনে নেওয়া।'
তবে বিএনপিকে আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল সম্ভব নয় স্মরণ করিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ আবারও প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে ইতিবাচক সাড়া দেওয়ার অনুরোধ জানান।

No comments

Powered by Blogger.