ধর্ম- রোজাদারদের প্রতিদান চিরস্থায়ী জান্নাত by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

মাহে রমজান উম্মতে মুহাম্মদির জন্য আল্লাহ তাআলার অপার সন্তুষ্টি ও তাঁর প্রতিশ্রুত বেহেশত লাভের সওগাত। রমজান মাসে আল্লাহ তাআলা তাঁর রহমত ও নিয়ামতের অফুরন্ত ভান্ডারের দরজা রোজা পালনকারীর জন্য উন্মুক্ত করে দেন। পবিত্র রমজান মাসের সম্মানজনক মর্যাদা সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যখন রমজান মাস আগত


হয় তখন আকাশ বা বেহেশতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, সারা রমজান মাসে তা বন্ধ করা হয় না, আর দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, সারা রমজান মাসে তা খোলা হয় না, আর শয়তানকে জিঞ্জিরে বন্দী করা হয়।’ (তিরমিজি, নাসাঈ, ইবনে মাজা)।
হাদিস শরিফে বর্ণিত আকাশ বা বেহেশতের দরজাগুলো খুলে দেওয়ার অর্থ এই যে রমজান মাসে আল্লাহর অসীম রহমত উম্মতের ওপর অনবরত বৃষ্টির মতো বর্ষিত হতে থাকে। সৎকাজ ও নেক আমলগুলো মহান আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয় এবং দোয়া কবুল হয়। আল্লাহ তাআলা রোজাদারদের জন্য পবিত্র রমজান মাসে তাঁর রহমতের দরজা অবারিত করে দেন। রোজাদারদের জন্য স্বর্গসমূহের দরজা এ জন্য খুলে দেওয়া হয় যে তারা শারীরিক কামনা-বাসনার ঊর্ধ্বে উন্নীত হয় এবং মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ ও মানবতার সেবায় নিজেদের নিমগ্ন রাখে। হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘রমজান মাসে আমার উম্মতকে পাঁচটি বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যা আমার পূর্ববর্তী কোনো নবীকে দেওয়া হয়নি। ১. রমজানের প্রথম রাতে আল্লাহ তাদের দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন, আর আল্লাহ যার দিকে দৃষ্টি দেন, তাকে কখনো শাস্তি প্রদান করেন না। ২. সন্ধ্যার সময় তাদের মুখ থেকে যে গন্ধ বের হয়, তা আল্লাহর কাছে মেশেকর সুগন্ধির চেয়েও উত্তম। ৩. মাহে রমজানের প্রত্যেক দিনে ও রাতে ফেরেশতারা রোজাদারদের জন্য দোয়া করেন। ৪. আল্লাহ তাআলা তাঁর বেহেশতকে বলেন, তুমি আমার বান্দার জন্য সুসজ্জিত ও প্রস্তুত হও! আমার বান্দারা অচিরেই দুনিয়ার দুঃখ-কষ্ট থেকে অব্যাহতি পেয়ে আমার বাড়িতে ও আমার সম্মানজনক আশ্রয়ে এসে বিশ্রাম নেবে। ৫. রমজান মাসের শেষ রাতে আল্লাহ তাদের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। এক ব্যক্তি বলল, এটা কি লাইলাতুল কদর? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, না, তুমি দেখোনি শ্রমিকেরা যখন কাজ শেষ করে তখনই পারিশ্রমিক পায়?’ (বায়হাকি)
মাহে রমজানে অন্য মাসের তুলনায় নেক আমল বা সৎকাজ করার বেশি তাওফিক হয়, যদ্দ্বারা জান্নাতে প্রবেশ করা সহজ হয়। যখন রোজাদার ব্যক্তি বেশি নেক আমল করবেন, তখন তিনি নিশ্চয়ই বেহেশতের উপযোগী হবেন এবং দোজখ থেকে বাঁচবেন। আর যখন বান্দা রমজান মাসের বদৌলতে গুনাহর কাজ করা থেকে বেঁচে থাকবেন, তখন জাহান্নামের দরজা বন্ধই থাকবে। এ নরকাগ্নি থেকে মুক্তির একমাত্র গ্যারান্টি থাকবে বেহেশতিদের জন্য। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘(পৃথিবীতে) প্রথম মৃত্যুর পর তারা সেথায় আর মৃত্যু আস্বাদন করবে না। তোমার প্রতিপালক (আল্লাহ) নিজ অনুগ্রহে তাদের জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করবেন—এটাই তো মহাসাফল্য।’ (সূরা আদ-দুখান, আয়াত: ৫৬-৫৭)
রোজা পালনের মধ্য দিয়ে মুমিন বান্দারা আত্মিকভাবে নিজেদের গড়ে তুলতে সক্ষম হন। তাই মাহে রমজানে রোজাদার ব্যক্তি মহান আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য ধৈর্যধারণপূর্বক সকল প্রকার পাপ কাজ, পানাহার, ইন্দ্রিয় তৃপ্তি, ভোগবিলাসিতা ও লোভ-লালসা থেকে বিরত থাকেন। সে জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রোজাদারদের প্রতিদানস্বরূপ জান্নাত প্রদান করবেন। এ সুসংবাদ দিয়ে রাসুলে করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘এ মাস (রমজান) ধৈর্যের মাস এবং ধৈর্যের বিনিময় হচ্ছে বেহেশত।’ (মিশকাত) প্রকৃত রোজাদার ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ করেন এবং তার জান্নাতের পথ সুগম হয়। হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত আছে যে তাৎপর্যপূর্ণ ও ফজিলতময় পবিত্র মাহে রমজানে রোজা পালনকারী ব্যক্তির জন্য আল্লাহ তাআলা পুরস্কারের ভান্ডার নির্ধারণ করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেছেন, আদম সন্তানের প্রত্যেকটি কাজ তার নিজের জন্য, তবে রোজা ব্যতীত, কেননা রোজা আমার জন্য এবং আমিই তার প্রতিদান দেব।’ (বুখারি ও মুসলিম)
রোজাদার ব্যক্তিকে শয়তান প্রতারিত করতে পারে না। কেননা একজন রোজা পালনকারী যখন এত অধিক পরিশ্রম ও ত্যাগ-সাধনা করে রোজার কঠোরতম সংযম করতে থাকেন, তখন তিনি প্রতিটি পদক্ষেপে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করে থাকেন। তিনি সর্বদা পাপ কাজ থেকে বিরত থাকেন, যাতে তার রোজাব্রত পালন বা সিয়াম সাধনা বৃথা না যায়। পৃথিবীতে কোনো জিনিস পেতে হলে বা ভোগ করতে চাইলে সে জিনিসের জন্য চেষ্টা, পরিশ্রম ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে টাকা-পয়সা বা ধন-সম্পদের প্রয়োজন হয়। কিন্তু রোজাদারগণ বেহেশতে ইচ্ছে হওয়া মাত্রই সে জিনিস তার সামনে উপস্থিত হবে। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘সেথায় তোমাদের জন্য রয়েছে যা কিছু তোমাদের মন চায় এবং সেথায় তোমাদের জন্য রয়েছে যা তোমরা ফরমায়েশ করবে। এটা হবে ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু আল্লাহর তরফ থেকে মেহমানদারি।’ (সূরা হা-মীম আস-সাজদা, আয়াত: ৩০-৩১) আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘এবং আমি বেহেশতিদের তাদের পছন্দ অনুযায়ী ফলমূল ও গোশত প্রদান করতে থাকব।’ (সূরা আত্-তুর-২২) এ নিয়ামত স্থান-কালের সঙ্গে সীমাবদ্ধ হবে না, নিয়মিতভাবে চিরদিন প্রদান করা হবে। স্থায়ী জান্নাত সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘সেথায় তারা শান্তি ব্যতীত কোনো অসার বাক্য শুনবে না এবং সেথায় সকাল-সন্ধ্যা তাদের জন্য থাকবে জীবনোপকরণ।’ (সূরা মার্য়াম, আয়াত-৬২)
রমজান মাস মুমিন বান্দাদের আত্মিক অগ্রগতি এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জন তথা প্রতিশ্রুত জান্নাত লাভের জন্য বিশেষভাবে সহায়ক ও উপযোগী। যারা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মাহে রমজানে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে পার্থিব যাবতীয় কামনা-বাসনা, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষাকাতরতা পরিহার করে রোজার যথার্থ তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য উপলব্ধি করে মুত্তাকি হওয়ার গৌরব অর্জন করেন, সেসব রোজাদারকে আল্লাহ তাআলা তাঁর অপার করুণা, ক্ষমাশীলতায় চিরস্থায়ী জান্নাতে প্রবেশ করান এবং জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি লাভের তাওফিক দান করেন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.