ঈর্ষণীয় সফলতাই মুজিব হত্যার কারণ by সরদার সিরাজুল ইসলাম

(পূর্বপ্রকাশের পর) বঙ্গবন্ধুর অসহযোগকালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব মেনে মওলানা ভাসানী উভয়ের সমঝোতার কৌশল হিসেবে ভাসানী ২৫ মার্চ ভারতের পথে রওনা দেন। কিন্তু লক্ষণীয় বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ সশরীরে ভারতে যাননি। প্রথমত পালিয়ে যাওয়া স্বভাবের মানুষ ছিলেন না। দ্বিতীয়ত একথা বলা অসঙ্গত নয় যে ভারত যাওয়া তার ছিল না পছন্দ।


পরে অবশ্য রাষ্ট্রনায়ককালীন সীমাবদ্ধতার কারণে সে কথাটি তার পক্ষে বলা সম্ভব ছিল না। তবে তার ভারত না যাওয়ায় নজিরবিহীন কৌশলটি গবেষকদের চূড়ান্ত মূল্যায়নে তিনি যে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন তার উজ্জ্ব¡ল দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বস্তুত মুজিব চেয়েছিলেন যে কারো দয়ায় যেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা না আসে এবং ভারতের সঙ্গে তার দরকষাকষির ক্ষমতা যেন খর্ব না হয়। তাই তিনি নিজের নিরাপত্তার চাইতে জাতীয় নিরাপত্তাকে মূল্য দিয়ে জনতার শক্তির ওপর নির্ভর করে পুরো নয় মাস নির্ভয়ে জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি অবস্থানে কাটিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুজিব মুক্তির জন্য ভারতের অবদান বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধীর কূটনীতি অবিস্মরণীয়। তা সত্ত্বেও শত্রুর কারাগারে থেকে মুক্তি পেয়ে পালাম বিমান বন্দরে (১০ জানুয়ারি, ’৭২) ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রথম বৈঠকে মুজিব বলতে পেরেছিলেন ভারতীয় সৈন্য কখন প্রত্যাহার করা হবে, আর তা ৩ মাসের মধ্যেই ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়। এছাড়া বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সমতার মানদ-েই মুজিব ২৫ বছর মেয়াদী ভারত-বাংলাদেশ সাম্য ও মৈত্রী চুক্তি করেছিলেন। ভৌগোলিক সীমানা নির্ধারণ সমস্যা এবং গঙ্গার পানি বণ্টনসহ বঙ্গবন্ধুর আমলে ফারাক্কার পানি ৪৪ হাজার কিউসেক (জিয়ার আমলে ৩৪ হাজার, এরশাদের সময় ২১ হাজার আর খালেদার সময় ৯ হাজার কিউসেক কিন্তু শেখ হাসিনা ১২.১২.৯৬ তারিখে ৩০ বছর মেয়াদী চুক্তি করে পান ৩৬ হাজার কিউসেক) বিভিন্ন সমস্যার সম্মানজনক চুক্তি করতে সক্ষম হন। আহমদ ছফার ভাষায় শেখ মুজিব বেঁচে থাকলে ফারাক্কা পানি নিয়ে ভারতের সঙ্গে একটা লড়াই তিনি বাধিয়ে দিতেন। ফরহাদ মাযহার ৪ জুলাই ৯৫ তারিখের ভোরের কাগজে প্রকাশিত প্রবন্ধে আহমদ ছফার উক্তিটির প্রসঙ্গে বলেন, যুদ্ধ তাকে করতে হতো না কেননা দুর্বল অবস্থানে দাঁড়িয়ে কিভাবে বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হয় তা শেখ মুজিব একাত্তরে দেখিয়েছেন এবং ফারাক্কার পানি কীভাবে আদায় করতে হয় তা মুজিব ভালভাবেই জানতেন।
প্রসঙ্গত বঙ্গবন্ধু ’৭৪ সালে যে চুক্তি করেছিলেন তাতে তিন বিঘা বাংলাদেশকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়ার কথা কিন্তু বিএনপি সরকার (২৬ জুন ’৯২) তা কেবল দিনের বেলায় ১-২ ঘণ্টা ব্যবহারের সুযোগ মেনে নিয়েছে যা বঙ্গবন্ধুর খুনী এবং মুসলিম লীগারদের ভাষায় বিএনপি ভারতের কাছে দাশখত দিয়ে মুজিব ইন্দিরা চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। (বাংলার বাণী, ২০ জুন ’৯২)। শেখ হাসিনার সময় ২০০৯ এখন অবশ্য ভূখ-টি বাংলাদেশের দখলে।
বঙ্গবন্ধু হত্যায় ভারতের ভূমিকা কি ছিল তা ইতিহাসের গবেষণার বিষয়। এ প্রসঙ্গে ঢাকার দুটি দৈনিকে প্রকাশিত লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে। আজকের কাগজ ২ জানুয়ারি ’৯২ তারিখ সংখ্যা বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক ও জাতীয় রাজনীতি নিবন্ধে রইস উদ্দিন আরিফ লিখেছেন- আমরা একদল সিরাজ সিকদার হত্যা, আরেক দল বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের জন্য বছরের পর বছর মাথা কুটে মরছি। এ দুটো হত্যাকা-ের বিচারের ভার যদি আমাকে দেয়া হয় তাহলে নির্ঘাত আমি জোড়া খুনের ফাঁসি দড়িটি ঝুলাবো ‘র’ এর গলায়। আমার বিচারের রায় শুনে অনেকেই ঠাট্টা বিদ্রƒপ করবেন, কেউ কেউ গাঁজাখোরি বলে হেসে উড়িয়ে দেবেন, কেউ আবার রায় শোনার আগেই দৌড়ে পালাবেন, যেমনটি কলকাতায় দৌড়ে পালিয়েছেন চিত্তরঞ্জন সুতার বঙ্গবন্ধু হত্যার দুদিন আগেই। এ ধরনের বক্তব্যের ভিত্তি কি তা লেখকই জানেন। তবে তৎকালীন ইন্দিরা সরকারকে সম্পৃক্ত করার মতো বস্তুনিষ্ঠ কোন তথ্য শোনা না গেলেও সেখানকার প্রতিক্রিয়াশীলরা এদেশকে ভারতের ভোগ্যপণ্য বাজার দখলের প্রধান অন্তরায় মুজিবকে সরিয়ে দিতে তৎপর ছিল তা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
আরেকটি বক্তব্য এসেছে অধ্যাপক আবু সাইদের ফ্যাক্টস এ্যান্ড ডকুমেন্টস ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসের কথা। “পার্লামেন্টের সাব কমিটি কক্ষে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে বৈঠক বসেছিল। বিকেল হয়ে আসছে। হঠাৎ বঙ্গবন্ধু কক্ষে ঢুকলেন। তাঁর চেহারা থেকে যেন আগুন ঝড়ছে। উত্তেজিত স্বরে বঙ্গবন্ধু বলতে শুরু করলেন, ইউসি বৃহৎ প্রতিবেশী থাকলে স্বভাবতই ডোমিনেশেন এসে যায়। বাংলাদেশের ব্যাপারে এটা হতে পারে না। যে ঘটনায় বঙ্গবন্ধু এত উত্তেজিত হয়েছিলেন তা ছিল বরিশাল সমুদ্র এলাকায় তেল খননকারী স্ট্রাকচার ইন্ডিয়ান গাটবোট এসে ভেঙ্গে দিয়েছিল।” এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা রয়েছে যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, ভারতের ডোমিনেশন মুজিব মেনে নেননি। একমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই সম্ভব ছিল ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা না করে ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তানে ওআইসি সম্মেলনে যোগদান। এছাড়া কিছু কিছু ব্যাপারে ভারতের মাথাব্যথার কারণ হয়েছিল কিনা ভেবে দেখার বিষয়। প্রথমত বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন ভারতের বাংলাভাষীদের ক্ষুব্ধ করার কথা যা সে অঞ্চলের লোকদেরও আলাদা রাষ্ট্র গঠনে উৎসাহিত করতে পারত। তবে দুই বাংলার একত্রিত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই অবাস্তব যা প্রয়াত জ্যোতিবসুও লন্ডনে বলেছিলেন (আগষ্ট ৯২)। তবে তাদের এই শতাব্দীর শুরুতেই পশ্চিম বাংলার নতুন নামকরণ শুধু বাংলা। প্রসঙ্গত ১৯৭৪ সালে কলকাতায় বসন্ত চ্যাটার্জী বাংলাদেশ টুডে নামক এক গ্রন্থে লেখেন মুসলিম বাংলা সেøাগান এই মুহূর্তে বাঙালীরা মেনে নেবে না, তবে লাগসই কাজ হবে বাংলাদেশী যা অর্থের দিকে মুসলিম বাংলা। এই বক্তব্যকে লুফে নেন খোন্দকার আব্দুল হামিদ এবং জেনারেল জিয়া (খবরের কাগজ, ৬ অক্টোবর, ৯২)। দ্বিতীয়ত ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু ঘোষিত সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি সফল হলে ভারতের কমিউনিস্ট অধ্যুষিত রাজ্যসমূহে প্রভাবিত হতে পারত। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে বাঙালী জাতীয়তাবাদের বদলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্র বাদ দেয়া এবং বাংলাদেশের পরবর্তী সরকার ভারতের কাছে নতজানু আচরণ ও ভারতীয় রাষ্ট্রনায়কদের জেনারেল জিয়ার প্রশংসা এবং ভারতীয় পণ্যের অবাধ বিচরণ (বঙ্গবন্ধুর আমলে ছিল না) বরং ভারতীয় কায়েমি স্বার্থান্বেষী মহলকে অনেক নিশ্চিত করেছে। ভারত জাসদ সর্বহারা পার্টির মদদদাতা ছিল বলে শোনা যায়। বঙ্গবন্ধুর পরে এদের কোন তৎপরতা নেই। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু হত্যাকে ভারতীয় প্রচার মাধ্যমে আকাশ বাণীর ভাষায় যিশু নিহত হয়েছিলেন। এখন কোটি কোটি মানুষ ক্রশ ধারণ করে তাকে স্মরণ করে। মুজিবও হয়ত তাই হবেন। আর প্রধানমন্ত্রী গান্ধী পরিবারসহ বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার খবরে মর্মাহত এশিয়া আফ্রিকার জনগণের প্রেরণাদায়ক মহান নেতা, প্রথম শ্রেণীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করলেও হত্যাকা-কে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় চিহ্নিত করে ১৫ আগস্ট দুপুরেই ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেন ঢাকায় না থাকায় তার প্রতিনিধি ঐদিনই এবং সমর সেন দিল্লী থেকে ফিরে এসে ১৮ আগস্ট খন্দকার মোস্তাকের সঙ্গে সাক্ষাত করে দিল্লীর স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন (বাংলাবাজার পত্রিকা, ১৫ আগস্ট ’৯২)। ইহাই বাস্তবতা অথচ প্রতিক্রিয়াশীলদের অপপ্রচার এখনো অব্যাহত মুজিব ভারতের দালাল।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গফফার চৌধুরীর ১২ আগস্ট ৯৭ তারিখের দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পদধ্বনি কি আগে শোনা যায়নি। শিরোনামে নিবন্ধে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের অনেক অজানা তথ্য প্রকাশ করেছেন। জনাব চৌধুরী ছিলেন লন্ডন প্রবাসী। দেশে এসেছিলেন ১৪ জুন এবং লন্ডন ফেরেন ২৪ জুলাই ৭৫। উল্লিখিত সময়ে ঢাকায় বিভিন্ন জনের সঙ্গে আলাপচারিতার সূত্র ধরে বাংলাদেশে মুজিব সরকারকে উৎখাতের চক্রান্ত সম্পর্কে জনাব চৌধুরী তার উৎকণ্ঠার কথা ভারতীয় দূতাবাস প্রধান সমর সেন এবং প্রেস কাউন্সিলর অশোক দাশ গুপ্তকে জানিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, অশোক দাশগুপ্ত বিক্রমাদিত্য ছদ্মনামে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের ওপর কনফিডিনশিয়াল ডায়েরি নামের একটি বই লিখেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পরে তাকে এ দেশ থেকে ৩ দিনের মধ্যে বহিষ্কার করা হয়। উক্ত প্রেস কাউন্সিলর অশোক দাশগুপ্ত পরবর্তীতে প্যারিসে নতুন কর্মস্থলে যোগদানের পূর্বে হিথরো বিমানবন্দরে যাত্রা বিরতির সময় বঙ্গবন্ধু হত্যার কয়েক দিন পওে টেলিফোনে জানান যে, জনাব চৌধুরী যে আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন তা সমর সেন ইন্দিরা গান্ধীর কাছে সরাসরি জানিয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পর খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সেটা খোয়া গেছে, ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পৌঁছেনি।

বাকশাল প্রসঙ্গে
বঙ্গবন্ধু কেন যে বাকশাল পদ্ধতি চালু করতে যাচ্ছিলেন তার নির্মোহ আলোচনা কোনকালেই হয়নি। আর তা বাস্তবায়নের সুযোগ না হওয়ার সফলতা বা ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা সমগ্র তৎকালীন প্রেক্ষিত বিবেচনা করে বাঙালী জাতির কাছে অঙ্গীকার বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চ ৭১-এর এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম অভিব্যক্তির মুক্তির সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। (চলবে)
লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.