অলিম্পিকের মহোৎসবে- ক্যারিবিয়ান বিস্ময় by উৎপল শুভ্র

এটা অলিম্পিক তো, নাকি ক্যারিবিয়ান অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপ? সংবাদ সম্মেলনে বসে বারবার মনে হলো প্রশ্নটা। একেবারে সামনের সারিতে বসেছি। পুরুষদের ৪০০ মিটার দৌড়ে পদকজয়ীদের দেখতে ঘাড় উঁচু করে তাকাতে হচ্ছে।


মাঝখানে সোনাজয়ী গ্রেনাডার কিরানি জেমস, তাঁর বাঁয়ে রুপাজয়ী ডমিনিকান রিপাবলিকের লুগেয়েলিন সান্তোস, ডানে ব্রোঞ্জজয়ী ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর লালোন্ডে গর্ডন।
একটু আগে দৌড়টাও দেখেছি। কিরানি জেমসের সোনা জয়ের পর একটু স্মৃতিকাতরতায় আক্রান্ত। গ্রেনাডার ছেলে! এই গ্রেনাডায় তো আমি দুবার গিয়েছি। স্মৃতিকাতরতার আসল কারণ অবশ্য অন্য—এই গ্রেনাডাতেই রচিত হয়েছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন ইতিহাস। ২০০৯ সালে এই গ্রেনাডা টেস্ট জিতেই দেশের বাইরে প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র টেস্ট সিরিজটি জিতেছে বাংলাদেশ।
একটু বিস্মিতও হয়েছিলাম। গ্রেনাডায় দুবার গিয়েছি বলে দেশটা সম্পর্কে মোটামুটি জানি। লাখ খানেকের একটু বেশি হবে জনসংখ্যা। ‘মসলা-দ্বীপ’ হিসেবে খ্যাতি আছে। এলাচ-দারচিনি-তেজপাতা সবই হয়, তবে সবচেয়ে বেশি জায়ফল। বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই নাকি! ২০০৯ সালে বাংলাদেশের সফরের সময় রাস্তার দুই পাশে সেই মসলার বাগান ঘুরেও এসেছি। তবে মসলা ছাড়া আয়ের আর একটাই উৎস—পর্যটন।
হয়তো এত কম লোকের দেশ বলেই বলার মতো কোনো ক্রীড়া-ঐতিহ্য নেই। বড় কোনো ক্রিকেটারও জন্ম দিতে পারেনি ছোট্ট এই দ্বীপরাষ্ট্র। সেই দেশ থেকে অলিম্পিক সোনাজয়ী! কিরানি জেমস অবশ্য গ্রেনাডার হলেও অ্যাথলেটিকসে তাঁর সাফল্যের মূলে যুক্তরাষ্ট্র। ইউনিভার্সিটি অব অ্যালবামায় পড়েন, নামী কোচের কোচিং পান। অনূর্ধ্ব-১৩, ১৪, ১৫-তে রেকর্ড ভাঙতে ভাঙতে বড় হয়েছেন। জুনিয়রে বিশ্বসেরা হওয়ার পর গত বছর জিতেছেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপও। অলিম্পিকে যুক্তরাষ্ট্রের ২৮ বছরের আধিপত্য ভেঙে গত পরশু জিতলেন ৪০০ মিটার। মার্কিনদের বাইরে এই প্রথম কারও ৪৪ সেকেন্ডের নিচে দৌড়ানো।
কথাবার্তায়ও তিনি আত্মবিশ্বাসী। ৪০০ মিটার দৌড়ে শেষ কথা মাইকেল জনসন। ১৯৯৯ সালে গড়া তাঁর বিশ্ব রেকর্ড টিকে আছে এখনো। স্বয়ং জনসনেরও ধারণা, কিরানি সেটি ভেঙে দেবেন। অথচ সেই মাইকেল জনসনের সঙ্গে তুলনার প্রসঙ্গে বলে দিলেন, তিনি কিরানি জেমস হিসেবেই পরিচিত হতে চান।
বোল্টের সঙ্গে তুলনা করাতেও একবার বলেছিলেন, তিনি ৪০০ মিটারের বোল্ট হিসেবে পরিচিত হতে চান না। বোল্টের যেমন অনেক বিশেষত্ব আছে, তাঁরও আছে। সবাই তাঁকে তাঁর মতো করেই চিনুক। মাত্র ১৯ বছরের একটা ছেলের এমন কথা বলতে সাহস লাগে।
সংবাদ সম্মেলনে কথাবার্তা শুনেও খুব ভালো লেগে গেল। গ্রেনাডার পশ্চিম উপকূলে জেলেদের গ্রাম গুয়াভে থেকে উঠে এসেছেন, বাবা একজন শ্রমিক—বিশ্বজয় করে ফেলার পর এসব বলতে অনেকে হয়তো একটু বিব্রত হতেন, কিন্তু কিরানি বললেন একেবারে স্বাভাবিক মুখে।
গ্রেনাডায় একটা ফিশিং ভিলেজে আমি গিয়েছিলাম। সেটিই গুয়াভে কি না ভাবছি। ঠিক আছে, সংবাদ সম্মেলন শেষে কিরানির সঙ্গে মিলিয়ে নিলেই হবে। সেই সুযোগও হলো। কিরানি অবশ্য আমার বর্ণনা শুনে ঠিক বুঝতে পারলেন না, আমি গুয়াভেতেই গিয়েছি কি না।
দেশ নিয়ে খুব গর্ব। অলিম্পিকে আসার আগে তাঁর লক্ষ্যের কথা জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকেরা। কিরানি বলেছেন, যত জোরে সম্ভব দৌড়ানো আর দেশের পক্ষে সেরাটা উজাড় করে দেওয়া। এতে পদক এল কি এল না, তাতে আসে যায় না। আমি গ্রেনাডায় দুবার গিয়েছি শুনেও কিরানিকে খুব খুশি মনে হলো। দুবার গ্রেনাডায় গিয়েছি এবং আমি বাংলাদেশের সাংবাদিক—এই দুটি তথ্য জেনেই বলেছেন, ‘ওহ্, ক্রিকেট!’ ক্রিকেট পছন্দ করেন, তবে কখনো ক্রিকেটার হতে চাননি, ছোটবেলা থেকে ট্র্যাকই তাঁকে বেশি টেনেছে।
শুধু গ্রেনাডা নিয়ে স্মৃতিকাতরতাই নয়, সংবাদ সম্মেলন শেষে কিরানির সঙ্গে কথা বলতে নিয়মবহির্ভূতভাবে মঞ্চে উঠে যাওয়ার আসল কারণ ছিল অন্য। গ্রেনাডা আর ত্রিনিদাদের দুই পদকজয়ী, এঁদের সঙ্গে কথা বললে তো ক্রিকেটের লাইনে একটা স্টোরির রসদ পাওয়া যাবে। লালোন্ডে গর্ডন যখন ত্রিনিদাদের, ব্রায়ান লারা তাঁর হিরো হওয়ারই কথা। কিন্তু লালোন্ডের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এমন ধাক্কা খেলাম যে বলার নয়। অ্যাথলেটই হতে চেয়েছিলেন, নাকি ক্রিকেটার—প্রশ্নটা শুনে এমন অবাক চোখে তাকালেন যে আমি আরও বেশি অবাক হলাম। এরপর যা বললেন, তাতে তো স্তম্ভিত! ক্রিকেট খেলাটাই নাকি তাঁর অপরিচিত! বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, ত্রিনিদাদের লালোন্ডে গর্ডন ব্রায়ান লারা নামের জনৈক ক্রিকেটারকেও চেনেন না!
কীভাবে সম্ভব? ত্রিনিদাদিয়ান কোনো তরুণের কাছে ক্রিকেট খেলাটা অপরিচিত হতে পারে! ব্রায়ান লারাও? ত্রিনিদাদে গিয়ে দেখেছি, ব্রায়ান লারা সেখানে কী। লালোন্ডে গর্ডনকে বললামও, এটা তো অবিশ্বাস্য লাগছে, ত্রিনিদাদের হয়েও ক্রিকেট নামে যে একটা খেলা আছে, তুমি তা-ই জানো না! নিউইয়র্কের কোথায় যেন বড় হয়েছেন, লালোন্ডের এই ব্যাখ্যাটাও ঠিক গ্রহণযোগ্য মনে হলো না।
সঙ্গী বাংলাদেশের দুই সাংবাদিককে বললাম, ভাগ্যিস্, আপনারা সাক্ষী আছেন। এটা লিখলে তো লোকে বিশ্বাস করবে না।

No comments

Powered by Blogger.