নিত্যজাতম্-বৃহন্নলার সুখের খোঁজে by মহসীন হাবিব

হিজড়া নয়, বরং মহাভারতের শব্দ বৃহন্নলা ভালো। দীর্ঘদিনের অবহেলা, অবজ্ঞা, অপমান এবং হতদরিদ্র পরিবেশের সঙ্গে হিজড়া শব্দটির একটি ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। ইংরেজি শব্দ ঝযব-সধষবং যেমন অবমাননাকর, বৃহন্নলা মোটেও তা নয়।
বাংলাদেশে আমরা হিজড়া বলতে একটি সম্প্রদায়কে জানি। হঠাৎ করে দেখা যায়, রাস্তা ধরে অত্যন্ত উদ্ধত ভঙ্গিতে অত্যন্ত সুস্বাস্থ্যবান তিন-চার মানবসন্তান দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে।


পুরুষের মতো স্বাস্থ্য কিন্তু মেয়েলি পোশাক, হাঁটাচলায় মেয়েলি ঢং ও সাজসজ্জা। কোথাও দাঁড়িয়ে কারো কাছে পয়সা দাবি করছে। কেউ ঝামেলা এড়িয়ে যেতে, কেউ দয়া করে দু-চার টাকা হাতে দিচ্ছে। ওরাও খুশি হয়ে একটি বিশেষ ভঙ্গিতে হাতে তালি দিয়ে আবার সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটু গভীরভাবে লক্ষ করলেই দেখা যাবে, এক নিদারুণ যন্ত্রণার জীবন বেছে নিতে হয়েছে এই মানবসন্তানদের। একটি মানুষ মায়ের গর্ভ থেকে যেকোনো একটি অঙ্গ অসম্পূর্ণ অবস্থায় জন্ম নিতে পারে_এটি খুবই স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। সমাজের এসব মানুষকে অত্যন্ত স্নেহ-আদরে প্রতিপালন করার কথা। ঠিক তেমনি শরীরে শুধু টেস্টাইন ডেভেলপ না করা অবস্থায় যখন একটি মানুষ জন্মগ্রহণ করছে, তখন সমাজ কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে এসব মানবসন্তানকে হিজড়া নাম দিয়ে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ে পরিণত করছে।
বাংলাদেশে কমবেশি প্রায় ৩৫ হাজার মানুষের শারীরিক এই ত্রুটি রয়েছে। এদের কোনো জাত নেই, ধর্ম নেই। পারিবারিক জীবন থেকেও এরা বিচ্ছিন্ন। পাচ্ছে না নিকটজনের ভালোবাসা-স্নেহ-আদর। বাধ্য হয়ে পরিণত হচ্ছে একটি গোষ্ঠীতে, যার নাম দিয়েছি আমরা হিজড়া সম্প্রদায়! কেউ তাদের সঙ্গে মেশে না, বন্ধুত্বও তৈরি করে না। সমাজ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ধর্ম_সব কিছু থেকে তাদের দূরে সরিয়ে আমরা এমন এক অবস্থানে প্রেরণ করে আসছি, যেখান থেকে তারা নিজেদের একটি বৈরী মনোভাবাপন্ন গোষ্ঠী বলে বিবেচনা করতে বাধ্য হচ্ছে। এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার।
এই পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে ২১ অক্টোবর শুক্রবার স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের অধীনে এই তথাকথিত জোর করে পৃথক একটি সম্প্রদায় বানিয়ে দেওয়া জনগোষ্ঠীকে মূলস্রোতে নিয়ে আসতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ঢাকায়। বর্ণাঢ্য সমাবেশ-মিছিলের আয়োজন করা হয়। মন্ত্রণালয়ের এ আয়োজনে যোগ দেয় বেশ কয়েকটি সংগঠন এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। উদ্যোক্তা এবং অংশগ্রহণকারী সবাইকে ধন্যবাদ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শুধু আয়োজন করে, আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে কি অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো যাবে? মনে হয় না। এর জন্য আরো কিছু বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
ধরুন, বিজ্ঞানে পরিষ্কার ব্যাখ্যা আছে এমন কোনো কারণে একটি সন্তান অন্ধ হয়ে জন্মগ্রহণ করল, অথবা এক হাতের পাঁচটি আঙুল ছাড়াই জন্মগ্রহণ করল; সে জন্য কি ওই শিশুসন্তান তার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে বা হওয়া উচিত? বাংলাদেশে কিন্তু তা-ই হচ্ছে। প্রকারান্তরে পরিবার থেকে বিতাড়িত এই অসহায় 'হিজড়া' মানুষটি মা-বাবার সব উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে ওই 'সম্প্রদায়ের' মধ্যে।
সম্প্রতি পাকিস্তানের মতো রক্ষণশীল দেশের সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট নির্দেশ প্রদান করেছেন। ইসলামী আইনবিদ এবং অনির্ধারিত লিঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের নিয়ে গবেষণাকারী ড. মোহাম্মদ আসলাম খাকির একটি পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী, বিচারপতি খিলজি আরিফ হুসেইন ও বিচারপতি তারিখ পারভেজের সমন্বয়ে গঠিত একটি বেঞ্চ দেশটির সব জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন বৃহন্নলাদের সম্পদের উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে। শুধু তা-ই নয়, আদালত পাকিস্তানের চার প্রদেশের মুখ্যসচিব এবং ইসলামাবাদের কমিশনারকে নির্দেশ দিয়েছেন, এ সম্প্রদায়ের কল্যাণে কী করা হয়েছে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে। পাকিস্তানের ন্যাশনাল ডেটাবেইস অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অথরিটি আদালতকে তথ্য দিয়ে জানিয়েছে, কর্তৃপক্ষ হিজড়াদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান করেছে পুরুষ বিভাগের সদস্য হিসেবে। এমন সিদ্ধান্তের জন্য পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টকে শ্রদ্ধা না জানালে অন্যায় হবে।
ভারতে রয়েছে বিশালসংখ্যক বৃহন্নলা। সম্ভবত এখন পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃহন্নলার সংখ্যা ভারতেই। মানবাধিকার সংগঠন এবং বৃহন্নলাদের প্রচেষ্টায় ভারতে তাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু এখনো সামাজিক কারণে তাদের ভিক্ষা করে, বিয়েবাড়িতে গান গেয়ে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে নবজাতকের আগমনে নেচে-গেয়ে অথবা পতিতালয়ে খরিদ্দারদের বিকৃত যৌনক্ষুধা মিটিয়ে পেট চালাতে হয়। ৯৫ শতাংশ বৃহন্নলা ভারতে চরম দরিদ্র জীবন যাপন করে। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্যও জেগে উঠছে আধুনিক ভারত। দাবি উঠেছে সরকারি চাকরির সুযোগ ও সাংবিধানিকভাবে চাকরির কোটা ইত্যাদি সৃষ্টির।
বাংলাদেশেও বৃহন্নলাদের জন্য কিছু জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এই মানুষগুলোকে মূলস্রোতে প্রবাহিত করতে যে বাধাটি সবচেয়ে কঠিন, তা হলো কুসংস্কার ও সমাজে বিদ্যমান অবৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণা। সমাজ হিজড়াদের সঙ্গে কখনোই স্বাভাবিক আচরণ করে না। সে কারণে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে একটি ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা চালানো। শিল্প, সংস্কৃতি ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে এদের শরিক করার উদ্যোগ নেওয়া। অবশ্য দেশের সমাজপতি এবং বিত্তবান শ্রেণীরও বড় ভূমিকা রয়েছে। তারা যদি বাড়িতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এদের অতিথি করে, তাহলে সেটা সাধারণ মানুষের জন্য উদাহরণ হয়ে উঠবে। বর্তমান মা-বাবারা যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যান, তখন নিজেরা খামাখাই অবাক হয়ে (বাংলাদেশে মানুষের খুব সাধারণ বিষয়ে অবাক হওয়ার প্রবণতা আছে) ওদের দিকে তাকিয়ে না থেকে বাচ্চাদের বুঝিয়ে দিতে হবে, ওরা অস্বাভাবিক কোনো বস্তু নয়, ওরাও সবার মতো মানুষ। সভ্য দেশগুলো থেকে আমদানি হয়ে বাংলাদেশে প্রযুক্তি আসছে, নতুন নতুন ফ্যাশন আসছে, স্টাইল আসছে। আসছে ভদ্রলোকি রীতিনীতি। আসছে পশ্চিমের কূটকৌশল। শুধু আমদানি হচ্ছে না মানবিক গুণাবলির পশ্চিমা চর্চা। বৃহন্নলাদের প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যে অযথাই দাস হতে হতো শুধু শারীরিক এই ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করার জন্য। তুরস্ক এবং তুর্কি সংস্কৃতির প্রভাবে ভারতবর্ষসহ বিভিন্ন রাজতান্ত্রিক দেশের শাসকদের হারেমের প্রহরীর কাজ করতে হতো হিজড়া অথবা খোজা করে দেওয়া লোকজনকে। যদিও খোজা করার রেওয়াজ তখন ছিল। আমরা এখন প্রাচীন বা মধ্যযুগে নেই। প্রাচীন বা মধ্যযুগে যা ছিল রেওয়াজ, এখন আমাদের কাছে তা নিষ্ঠুরতা। সেসব যুগে মানুষের যেসব চর্চা ছিল, তা এখন সচেতন সমাজের কাছে হাস্যকর। সুতরাং এই মানুষদের সমাজে অন্য সবার মতো ঠাঁই করে না দেওয়াও সেই প্রাচীন ধারণার সঙ্গে লেগে থাকা মাত্র। কার্যত তা আধুনিক, সভ্য ও উন্নত সমাজের পরিপন্থী।

লেখক?: সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.