হে প্রণম্য অগ্নিদেব by মুহম্মদ নূরুল হুদা

গে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম এবারের কোরবানির ঈদে আমি সপরিবারে বাড়ি যাব। মূল কারণটা আমার শতবর্ষী পিতা, যিনি বাড়িতে প্রায় নিঃসঙ্গ দিন যাপন করছেন। এ বয়সে বার্ধক্যজনিত নানা ব্যাধির সঙ্গে ঘর করেও তিনি মোটামুটি হাঁটাচলা করছেন। একটু অসুবিধে বোধ করলেই ডাক পড়ে আমার।
আমিও কোনোদিকে না তাকিয়ে তড়িঘড়ি ছুটে যাই। আগামী ঈদে আমাদের সবার সঙ্গে তার আর ঈদ করা হবে কিনা এ নিয়ে তিনি সন্দেহ পোষণ করেছেন। বিষয়টা আমি গিন্নির সঙ্গে আলাপ করতেই তার ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেল। কিন্তু গোল বাধল টিকিট পাওয়া নিয়ে। ঢাকা-কক্সবাজার রুটে বাসের কমতি নেই; তবে ঈদের সময়টা অন্যরকম। উপরন্তু, গিন্নির দরকার চালকের ঠিক পেছনের সিট দুটো। দীর্ঘ পথযাত্রায় পা সময়মতো ভাঁজ ও টান করতে না পারলে তার পক্ষে জার্নি করাটা প্রায় অসম্ভব। আবার কারে বা মাইক্রোবাসেও দীর্ঘ যাত্রা করতে নারাজ। অনেক ঘোরাঘুরির পর ও-রকম দুটো সিট পাওয়া গেল, তবে ঈদের একদিন পর। ঠিক হলো আমি ঈদের দুদিন আগে যাব, আর গিন্নি ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসবেন পরে। আব্বাও রাজি হলেন। আমি সম্ভাব্য যানজট এড়ানোর জন্য দু’দিন আগেই মাইক্রোবাসে কক্সবাজার যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার সহযাত্রী শূন্য দশকের কবি মনির ইউসুফ, নির্ঝর আর গাড়িচালক সিরাজ। মনিরের বাড়ি বৃহত্তর ঈদগাঁও এলাকায় আর নির্ঝরের বাড়ি চিরিঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের পাশে। আমরা বেলা ১১টার দিকে বেরিয়ে গাড়ির চেকআপ সেরে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সায়েদাবাদ পার হয়ে প্রায় মহাসড়কে এসে পড়লাম। না, কোথাও যানজট নেই। মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। কিন্তু কাঁচপুর ব্রিজের মাইলখানেক দূরে এসে থেমে গেল গাড়ি। সামনে গাড়ির পর গাড়ি। শুরু হলো ধৈর্যের পরীক্ষা। ঘণ্টাচারেক পর ব্রিজ পার হয়ে কিছুক্ষণের জন্য ফাঁকা পথ। তারপর আবার সেই যানজট। সড়ক পুলিশ জানালেন, এই জট কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত বিস্তৃত। জটের ঠিক মাঝখানে ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে আসা বিপরীতমুখী যানগুলো সম্মুখসমরের ভঙ্গিতে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। বিষয়টার তথ্য মূল্য আছে বৈকি। তাই টেলিফোনে আমি কয়েকজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও সাংবাদিক বন্ধুকে এ সম্পর্কে জানালাম। তবে ফল যা হওয়ার তাই হলো। ১০ ঘণ্টার জার্নি প্রায় ছাব্বিশ ঘণ্টায় গিয়ে ঠেকলো। সকালে সূর্য ওঠার আগে আমাদের গাড়ি যখন সীতাকুণ্ড পার হচ্ছে, তখনই দেখলাম দৃশ্যটা। মহাসড়কের পাশের একটি বাড়ির উঠোনে আগুন জ্বালিয়ে জড়ো হয়েছে বাড়ির ছেলেবুড়ো। শীতের আগে নেমে আসছে হেমন্ত। মানুষ শীত থেকে বাঁচার জন্য আগুনকে নিয়ে উল্লাসে মেতেছে। বাড়িতে পৌঁছলাম বিকেলবেলা। রাত নামতেই নেমে এলো হিম। উঠোনে স্তূপ হয়ে আছে সোনালি ধান। আর যারা ধান কেটেছে সেই শ্রমিকরা একপাশে নাড়ার আগুনে তাতিয়ে নিচ্ছে নিজেদের শরীর-মন। আমার বৃদ্ধ পিতাও কিছুক্ষণ তাদের সঙ্গী হলেন। আমিও ঘুরে আসলাম বেশ কয়েকবার। মনের ভেতর ধূমায়িত হলো শৈশবস্মৃতি। আগুনের চারপাশে জটলা, হল্লা। আসলে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি শীত-হেমন্তের ‘অইন পোয়ানি’ বা আগুন পোহানো। বাংলাদেশের নানা অঞ্চলের লোকবাঙালি এটিকে উপভোগ করে নানা আঙ্গিকে। যতটা আনন্দের কারণে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজনের তাগিদে। এর উপকরণ কোথাও খড়কুটো, কোথাও তুস, কোথাও নাড়া, কোথাও শুকনো পাতা বা ডালপালা।
ঈদ উত্সব শেষে ঢাকা ফেরার পালা। তার আগে আমরা দরিয়ানগর পর্যটন কেন্দ্রের অন্যতম পরিচালক গিয়াস ও নাট্যজন কামরুল হাসানের আমন্ত্রণে কক্সবাজার গেলাম। জানা গেল, ১ ডিসেম্বর মঙ্গলবার রাতে কক্সবাজারের বৃহত্তম পর্যটন স্পট দরিয়ানগর পর্যটন কেন্দ্রে এই উত্সবটি নবায়ন ও উদযাপন করার পরিকল্পনা নিয়েছেন তারা। উদ্বোধন করতে হবে আমাকে। কেমন যেন কাকতালীয় যোগাযোগ। আমি সানন্দে রাজি হলাম। নির্দিষ্ট তারিখে রাত ৯টার দিকে এ উত্সবের উদ্বোধন হলো। পরিবেশিত হলো কক্সবাজারের ঐতিহ্যবাহী ‘ধুঁই পিড়া’। আমার ছোট মেয়ে দিশা গেয়ে উঠল ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’। তার সঙ্গে কণ্ঠ মেলালাম আমরা সবাই : আমার সহধর্মিণী সাঈদা হুদা, নাট্যজন কামরুল হাসান, কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আজিম কনক, পরিচালক আহমদ গিয়াস, রাজনীতিবিদ মীর কাশেম, ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সেলিম, শিল্পী আদিবা নূর মুমু, আমার ছোট ছেলে স্বরূপ, কামরুল-তনয় আলদীন ও আগ্রহী জনতা। গিয়াস জানালেন, প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় এ উত্সব নিয়মিত চলবে। লোকঐতিহ্যের বিস্মৃতপ্রায় এ অভিব্যক্তিকে পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে কক্সবাজার তথা দরিয়ানগরেই সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে নবায়িত ও উদযাপিত হলো এ উত্সব। বাংলাদেশের মৃত্তিকালগ্ন আচার অনুষ্ঠানকে দেশে-বিদেশে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে এটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে। জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের উত্স সন্ধানে যে কোনো লোকাচারের নবায়নের মুহূর্তটিও সবিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ। আমাদের প্রিয়তম দরিয়ানগরে আন্তর্জাতিক মানবগোষ্ঠী ও বৈশ্বিক সংস্কৃতির যে বহুমোহনা, তাকে চিরভাস্বর রাখতে হলে ‘অইন পোয়ানি’র মতো আচার-অনুষ্ঠান সংস্কৃতির শেকড়ে অনির্বাণ শিখারূপে প্রজ্বলিত রাখার কোনো বিকল্প নেই। পশ্চিমা বিশ্বে এই আগুন পোহানোকে ‘ক্যাম্প ফায়ার’ বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে মানব অভিব্যক্তির নানা বৈচিত্র্যের মধ্যেও যে ঐক্যসূত্র বিদ্যমান তা ‘অইন পোয়ানি’ ও ‘ক্যাম্প ফায়ার’-এর মধ্যে আবিষ্কারযোগ্য। এই ‘অইন পোয়ানি’ শীত-হেমন্তে দরিয়ানগরে আগত দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে। উদ্বোধনের মুহূর্তে আমার মনে বারবার ধূমায়িত হচ্ছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শব্দশিখা, ‘হে প্রণম্য অগ্নিদেব... ’
লেখক : কবি, প্রফেসর, কলামিস্ট; সভাপতি, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব।

No comments

Powered by Blogger.