আখেরি মোনাজাতে বিশ্বশান্তি কামনা by আশীষ-উর-রহমান

য়া আল্লাহ, হামারা দুয়া কবুল ফরমা দে, দিল মে হেদায়েত ফরমা দে। পারওয়ারদিগার হামারা ইমান কো হেফাজত ফরমা দে, দিলকা সারে নেক মকসুদ কবুল ফরমা দে। ইয়া রহমানের রহিম, সারে মুসিবত আসান ফরমা দে, সারে জাহানপার তেরে রহমত ফরমা দে...’ বিনম্র কাতর স্বরে দোজাহানের মালিক মহান আল্লাহ পাকের কাছে প্রার্থনা করছিলেন মাওলানা জোবায়েরুল হাসান।


মাইকে ও সেলফোনে চালু করা এফএম রেডিওতে সেই মিনতি ছড়িয়ে পড়েছিল তুরাগের চারপাশের এলাকায়। মৌমাছির মৃদু গুঞ্জনের মতো সেই সুরময় আর্তি অনুরণিত হচ্ছিল শীতের কুয়াশা ভেদ করে আসা রৌদ্রকরোজ্জ্বল মধ্যাহ্নে।
আশপাশে যত দূর চোখ যায়, মাঠ, রাজপথ, ঘরবাড়ির ছাদ, দূষণে দূষণে কালো-কুৎসিত হয়ে ওঠা পানির মর-মর তুরাগের দুই তীরে, কিনারে ভিড়ে থাকা নৌকায়, পথে থমকে দাঁড়িয়ে থাকা বাসে, ট্রাকে, কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে মৌন হয়ে আছেন অগণিত মানুষ। কান পেতে আছেন দূরাগত মোনাজাতের শব্দে। কারও চক্ষু মুদিত, কারও দৃষ্টি সুদূরে প্রসারিত। শুধু দুই ঠোঁট থরথর কম্পমান, অতি মৃদু ‘আমিন আমিন’ ধ্বনিতে।
জীবনের সব পাপ-তাপ থেকে মুক্তির জন্য, পরম দয়াময় আল্লাহর দরবারে অনুনয়-বিনয় করে পানাহ ভিক্ষা করছিলেন তাঁরা। ক্ষমা লাভের আশায় লাখো মানুষের সঙ্গে একত্রে হাত তুলতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে এসেছিলেন তাঁরা ভোর থেকেই। বহু মানুষের অংশগ্রহণে ইহলোকের মঙ্গল, পরলোকের ক্ষমা, দেশের কল্যাণ, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও বিশ্বশান্তি কামনার মধ্য দিয়ে তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে গতকাল রোববার।
গত শুক্রবার ১৩ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছিল বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা হবে ২০ থেকে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত। তাবলিগ জামাতের দীনের দাওয়াতের কর্মধারায় বিশ্ব ইজতেমা শুরু হয়েছিল ১৯৪৬ সালে। ঢাকার রমনা উদ্যানসংলগ্ন কাকরাইল মসজিদে প্রথম ইজতেমার আয়োজন করা হয়েছিল। মুসল্লির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৪৮ সালে ইজতেমা হয় বর্তমানে যেখানে হাজিক্যাম্প, সেই ময়দানে। ১৯৫৮ সালে ইজতেমা হয় সিদ্ধিরগঞ্জে। ক্রমবর্ধমান মুসল্লির সংখ্যায় স্থানসংকুলানের জন্য ১৯৬৬ সাল থেকে টঙ্গীর তুরাগ নদের পারের মাঠে ইজতেমা শুরু হয়। সারা বিশ্ব থেকে ইজতেমায় মুসল্লিদের আগমন ঘটতে থাকে। দেশের সব অঞ্চল থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষ আল্লাহর রহমত লাভে ধন্য হওয়ার আশায় ছুটে আসেন ইজতেমায়। টঙ্গীর বিশাল ময়দানও নেহাত ছোট হয়ে পড়ে এই বিপুলসংখ্যক মানুষের স্থানসংকুলানের জন্য। এ পরিস্থিতিতে গত বছর ২০১১ সাল থেকে দুই পর্বে ইজতেমার আয়োজন করেন তাবলিগের নেতারা।
ইজতেমার তিন দিনের বয়ান শ্রবণের জন্য মুসল্লিদের একটি বড় অংশ প্রথম দিনেই তুরাগতীরে সমবেত হয়েছিল। যাঁরা নিয়মিত বয়ান শ্রবণ করতে পারেননি, তাঁদের মধ্যে অনেকেই নিয়ত করেছিলেন আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে। বরাবরই তাই হয়। বিশেষত, যাঁরা রাজধানী ঢাকা বা আশপাশের এলাকায় থাকেন, তাঁরা ভোর থেকেই টঙ্গী অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
যাপিত জীবনের নানা অন্যায়, অপকর্ম, গ্লানি, পাপ থেকে পরম দয়াময়, করুণার আধার আল্লাহর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করার এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি ধর্মভীরু সাধারণ লোক। অগণিত জনের সঙ্গে এক আত্মা এক প্রাণ হয়ে করজোড়ে সকাতর প্রার্থনায় অংশ নিলে আল্লাহ মেহেরবানের ক্ষমা লাভ হতে পারে—এই আশায় বুক বেঁধে ছুটছিলেন তাঁরা। নিকুঞ্জর ১ নম্বর গেট থেকে পথে অবরোধ দিয়ে যানবাহনের প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছিলেন নিরাপত্তারক্ষীরা। সেখান থেকেই পায়ে হাঁটা। মিছিল নয়, কিন্তু তারও অধিক। রাজপথের উভয় পাশ প্রায় গায়ে গা লাগানো ভিড়। ধর্মীয় জজবায় প্রাণিত মানুষ ধেয়ে চলছিলেন তুরাগের দিকে।
বিমানবন্দর থেকেই ফুটপাত এবং পথের মাঝের বিভক্তির ওপর সারি দিয়ে বসে গিয়েছিলেন হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত অনেকে। রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্সের কাছ থেকেই পথের ওপর খবরের কাগজ বিছিয়ে সারি দিয়ে বসে পড়া। সামনে এগোনো বেশ কঠিন হয়ে উঠেছিল বেলা ১১টা থেকেই। মাঘের মিঠে রোদে পিঠ দিয়ে বসে তাঁরা প্রতীক্ষায় ছিলেন মোনাজাত শুরু হওয়ার।
বেলা ১২টা ৩৫ মিনিটে আখেরি মোনাজাত শুরু হয়। বিশ্ব তাবলিগ জামাতের মুরব্বি ভারতের মাওলানা জোবায়েরুল হাসান বিদেশি নিবাসের পূর্ব পাশের মঞ্চ থেকে মোনাজাত পরিচালনা করেন। প্রার্থনা শুরু হতেই এক অনির্বচনীয় পরিবেশে সৃষ্টি হয় ইজতেমার মাঠকে কেন্দ্র করে চারপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। যাঁরা পথ চলছিলেন তাঁরা দাঁড়িয়ে পড়েন। যে যেখানে ছিলেন, বসে বা দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে প্রার্থনায় শরিক হন। মধ্য দুপুরে কোলাহলময় ব্যস্ত নগরের এই বিশাল এলাকা প্রায় স্থির হয়ে পড়ে। নেমে আসে গাঢ় মৌনতা। সেই নিঃশব্দের ভেতর দিয়ে মৃদু শব্দে ভেসে যায় সকাতর প্রার্থনা, ‘ইয়া মাবুদ, তেরে হাবিব কো মুহাব্বতে হামারা ফরিয়াদ কবুল ফরমা দে...।’
লোকসমাগম এত বেড়েছিল যে অনেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত যেতেই পারেননি। অনেক দূরে যাঁরা ছিলেন, তাঁরও সামনের জনকে হাত তুলতে দেখে হাত তুলে মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন। সেলফোনে যাঁদের এফএম রেডিও সংযোগ ছিল, তাঁরা ‘লাউড স্পিকার মোড’ চালু করে বুকপকেটে ফোনটি রেখে মোনাজাত করেছেন। এ রকম ফোন যেখানে চালু ছিল সেখানে ছোট ছোট জটলা করে লোকে উৎকর্ণ হয়ে মোনাজাত শ্রবণ করেছেন এবং ‘আমিন আমিন’ বলে প্রার্থনা করেছেন সর্বান্তঃকরণে।
বেলা একটায় শেষ হয় মোনাজাত। তারপর যেন ঘুমন্ত অগ্নিগিরির জেগে ওঠা। আবার সেই চিরচেনা কোলাহল। নিমিষে স্থবির হয়ে থাকা জনসমারোহ কেঁপে ওঠে। শুরু হয় ধেয়ে চলা ফিরতি পথে। পাহাড়ি ঢলের মতো, বাঁধভাঙা স্রোতের মতো সেই জনপ্রবাহ। কারও পিঠে ব্যাগ, কারও মাথায় বোঁচকা, কেউ খালি হাত—হনহন করে ছুটছেন সবাই। কে কার আগে যাবেন, এমন এক অঘোষিত প্রতিযোগিতা যেন পেয়ে বসেছে। রিকশা, ভ্যান, সাইকেল, মোটরসাইকেল চলছে সেই জনস্রোত ভেদ করে। দু-একটি হিউম্যান হলার, সিএনজিচালিত স্কুটারও ঢুকে গেছে। নড়েচড়ে উঠেছে পথের পাশে থেমে থাকা নানা ধরনের মোটরগাড়ি। হর্নের আওয়াজে, লোকের চিৎকারে উচ্চকিত পরিবেশ।
আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন রাষ্ট্রপতি, বিরোধীদলীয় নেতা ও সাংসদেরা। দোয়া মঞ্চের পাশে ছিলেন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শাহজাহান মিয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন গণভবন থেকে। এটলাস (হোন্ডা) কারখানার ছাদে তৈরি মঞ্চে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া ও তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীরা আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন।
কালিয়াকৈর (গাজীপুর) প্রতিনিধি মাসুদ রানা জানান, গত শনিবার রাত থেকেই শুরু হয়েছিল মানুষের স্রোত। মধ্যরাত থেকেই বিশ্বরোড থেকে গাজীপুরের চন্দ্রা চৌরাস্তা পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। সকাল আটটার মধ্যে ইজতেমার মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়।
রোববার ফজরের নামাজের পর আখেরি মোনাজাতের আগে হেদায়েতি বয়ান করেন ভারতের মাওলানা সা’দ। বয়ানে তিনি বলেন, ‘পায়ে হেঁটে মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছে দিতে হবে। এতে বেশি মানুষকে দীনের দাওয়াত দেওয়া সম্ভব হবে।’
ইজতেমায় ১১ মুসল্লির মৃত্যু: বিশ্ব ইজতেমার মাসলাহাল জামাতের আমির মো. আদম আলী জানান, গত শনিবার রাতে ইজতেমা মাঠে হূদেরাগে আক্রান্ত হয়ে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার সদর এলাকার কেরামত আলী (৭৫) ও ঝালকাঠির আবদুল আজিজ (৭৩) মারা গেছেন। গত তিন দিনে ইজতেমায় আসা ১১ মুসল্লি মারা গেছেন।

No comments

Powered by Blogger.