একজন মোজাম্মেল হক by শওকত মাহমুদ

ত্যের সৌজন্যে আমাদের কবুল করতেই হবে, জাতীয় প্রেসক্লাবের প্রয়াত সভাপতি মোজাম্মেল হক যে সে ব্যক্তি নন। আমাদের এই বাংলাদেশের এই সময়ের সাইলেন্ট মেজরিটির অনুচ্চারিত কণ্ঠের একজন সাহসী ভাষ্যকার ছিলেন। তার কৌতুকী বাদ-বিসম্বাদের মধ্যে কখনও খুঁজে পেতে কষ্ট হয়নি যে, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে সক্ষম করার বিষয়টি সর্বাগ্র মনোযোগে সর্বদা গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
আঞ্চলিক উপনিবেশবাদ-আগ্রাসনে সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির বদলের দ্বন্দ্বে আমাদের জীবনব্যবস্থার স্বাতন্ত্র্যবোধ, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের বজ্র-বেড়িতে নতুন বদলের আস্থাবান কর্মী তৈরি করা এবং সাংবাদিকতাকে সে অভিমুখে পরিচালিত করা—এটাই ছিল মোজাম্মেল হকের পরিচয়। তার ইতিহাস-সচেতনতা ছিল প্রখর। দিল্লির লালকেল্লায় একবার গিয়েছিলেন আমার সঙ্গে। কী বেদনার্ত হয়ে গিয়েছিলেন, যেন মোগলদের এক উত্তরসুরি, খিলান-গম্বুজে খুঁজেছেন পূর্বপুরুষের প্রচ্ছায়া। জাতীয় প্রেসক্লাবের বহুধা বিকাশে তার স্বপ্নের সংক্রমণ থেকে আশি ও নব্বই দশকে আমরা কেউই দূরে থাকতে পারিনি। কেননা সেটাই ছিল সময়ের দাবি এবং স্বপ্নপূরণের লগ্ন। সমাজের ভেতরের অসুখগুলো ধরতে তার সন্ধানী দৃষ্টি ছিল প্রখর। ‘দৈনিক বাংলা’র একজন পুরোধা প্রতিবেদক হিসেবে ‘চোখের আড়ালে’ নামক সিরিজ প্রতিবেদনের জন্য প্রথম ফিলিপস পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৮৬ সালে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, বিএফইউজে’র সভাপতি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রেস সেক্রেটারি প্রমুখ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন সাফল্যের সঙ্গে। প্রতি পর্যায়ে তার দুয়ার সর্বমতের মানুষের জন্য উন্মুক্ত ছিল। লক্ষ্য করেছি, ওইসব পদের ভারে নম্র, বিনয়ী, সুদর্শন মোজাম্মেল হক হারিয়ে যান : তার ব্যক্তিত্বের বিলয় ঘটেনি নতুন দায়িত্বের উদয়ে। ঘুরেফিরে আসা চাই প্রেসক্লাবের আড্ডায়, সেটাই শুরু এবং শেষ। জাতীয় প্রেসক্লাবের এমন কোনো সদস্য নেই, যার কাছে মোজাম্মেল হকের উষ্ণ স্মৃতির সঞ্চয় নেই। ওখানেই তার সার্থকতা। তার উক্তিগুলো স্মরণীয় হয়ে প্রেসক্লাব লাউঞ্জে সজীব থাকবে বহু, বহু কাল। দ্যোতক শব্দায়নে মেতে ওঠা ছিল তার প্রিয় ক্রীড়া। তুরপুন দিয়ে ভাষার উপরিতল ভেদ করে ফুটো-ফোকর বানিয়ে চুইয়ে পড়া কিছু বা না কিছু পেয়ে যাওয়া। এছাড়া একজন সাংবাদিক-লেখকের আর কী ভূমিকাই বা থাকতে পারে? এ প্রশ্ন তিনি করতেন বার বার।
আনুষ্ঠানিক মৃত্যুর আগেই মরে গিয়েছিলেন মোজাম্মেল হক, শরীর পরাস্ত হয়েছিল আগেই, কিন্তু অমন সজীব হৃদয় তো হুট করে স্তব্ধ হতে পারে না। দীর্ঘদিন অচেতন থেকে আমাদের জানিয়ে গেছেন, ‘মানুষ জন্মায়, বাঁচেও, চুপ করে থাকতে পারে না আর এটা নিশ্চিত যে তাকে মরে যেতেই হবে।’ যাবার আগে যেন তিনি বলে গেলেন, যেন থাকে না কোনো সূর্য কোনো উন্মোচন/আর কোনো গৃহকর্তা/শুধু আমি আর তারপর শবাস্তরণ আর স্তূপাকার মৃত্যু\
বাংলাদেশ ও প্রেসক্লাবের জন্য মোজাম্মেল হকের মানবিক ইশতেহার চিরদিশারী হোক।
লেখক : সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.