রাজনৈতিক সংকট নিরসনেও উদ্যোগ নিন-রাষ্ট্রপতির সংলাপ by আবু সাঈদ খান

ত্ত্বাবধায়ক ইস্যুর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি তার সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন। কথাটি সত্য। তবে এর চেয়ে সত্য_ তিনি রাষ্ট্রের অভিভাবক। সেই অবস্থান থেকে চলমান ইস্যুটি সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণে কোনো বাধা নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দল মুখোমুখি, যা দেশকে অনিবার্য সংঘাতের মুখে ঠেলে দিতে পারে। বিএনপি বলে দিয়েছে, তারা কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না।


অপরদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের অধীনেই সাধারণ নির্বাচন করবে_ এমন মতে অটল রাষ্ট্রের সবার ঊধর্ে্ব রাষ্ট্রপতির স্থান। তিনি অভিভাবকের মর্যাদায় অভিষিক্ত। দলীয় পরিচয় থাকলেও রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি আর কোনো দলের থাকেন না। সংসদীয় রীতিতে তিনি দলনিরপেক্ষ এবং সবার আশ্রয়স্থল হিসেবেই স্বীকৃত হন। এটি অবশ্য কেতাবি কথা, আমাদের মতো দেশে রাষ্ট্রপতির নিরপেক্ষ ভূমিকার উদাহরণ কদাচিৎই মেলে।
আমরা সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছ থেকে প্রায়ই তার মর্মবেদনার কথা শুনেছি। তবে সে মর্মবেদনার মূল কারণ ছিল, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাহীনতা। তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ফিতা কাটা আর মিলাদ পড়া ছাড়া তার কোনো কাজ নেই। সরকারের অভ্যন্তরে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় রাষ্ট্রপতিকে আরও খানিকটা ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে, তবে এ কলামে সে আলোচনায় যাব না। তীব্র মনোকষ্ট নিয়েও বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতামত রেখেছেন। আরেক সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী নিরপেক্ষতা দেখাতে গিয়ে দলের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। অবশেষে তাকে মেয়াদ শেষ না করে বিদায় নিতে হয়েছিল। এমন দু'একটি উদাহরণ ছাড়া আমাদের রাষ্ট্রপতিদের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে ভাবতে দেখা যায়নি। তবে এবার ব্যতিক্রমী ভূমিকা নিলেন রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান। তিনি নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। সংবিধান অনুযায়ী, তিনি শুধু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শক্রমেই নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিতে পারতেন। তবে তা নতুন সংকটের জন্ম দিতে পারত। এ ক্ষেত্রে তিনি সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের মতামত গ্রহণ করেছেন। এ জন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। অভিনন্দন বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপি নেতৃবৃন্দকেও। তারা বর্জনের নীতি পরিহার করে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে যোগ দিয়েছেন। তবে নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধান পুনর্বহালের দাবি করেছেন।
দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সচল রাখতে দক্ষ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন অপরিহার্য। একই সঙ্গে নির্বাচন কোন ধরনের সরকারের অধীনে হবে, তা নিষ্পত্তি করাও জরুরি। আশা করতে চাই যে, নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে সংবিধান অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট আইন প্রণীত হবে। সংবিধানের ১১৮(১) 'আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে' নির্বাচন কমিশন গঠনের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু ৪০ বছরে আইনের বিধানাবলি প্রণীত হয়নি। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে প্রায় সব দলই আইনি বিধান প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। কয়েকটি দল অনুসন্ধান কমিটি গঠনের কথা বলেছে। এটি গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন কমিশন তো বটেই, সাংবিধানিক অন্যান্য পদের ক্ষেত্রেও অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে যোগ্য লোক চয়নের বিধান থাকা উচিত। রাষ্ট্রপতি বিষয়টি আমলে নিয়ে সরকারকে এখন পরামর্শ দিলে তা হবে গণতন্ত্রের পথে আরেক ধাপ অগ্রগতি। অবশ্য ক্ষমতাসীন দলের সদিচ্ছা এ ক্ষেত্রে বড় ফ্যাক্টর। তারা রাষ্ট্রপতির উদ্যোগকে সম্মান দেবে কি-না, সেটি দেখার বিষয়।
তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি তার সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন। কথাটি সত্য। তবে এর চেয়ে সত্য_ তিনি রাষ্ট্রের অভিভাবক। সেই অবস্থান থেকে চলমান ইস্যুটি সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণে কোনো বাধা নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দল মুখোমুখি, যা দেশকে অনিবার্য সংঘাতের মুখে ঠেলে দিতে পারে। বিএনপি বলে দিয়েছে, তারা কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। অপরদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের অধীনেই সাধারণ নির্বাচন করবে_ এমন মতে অটল। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিলুপ্ত করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পথ অবারিত করা হয়েছে। যুক্তির খাতিরে যদি ধরে নিই যে, বিএনপিকে বাদ দিয়ে যদি আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে সমর্থ হয়ও, তবে সেই নির্বাচন কি গ্রহণযোগ্য হবে? ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মতোই তা ভেস্তে যাবে না_ সেই গ্যারান্টি কোথায়?
সংসদে আসন সংখ্যা যাই হোক, দেশের বাস্তব অবস্থা হচ্ছে, ভোটের বিচারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কাছাকাছি পর্যায়ে রয়েছে। তাই সমান জনসমর্থনপুষ্ট একটি দলকে বাদ রেখে যদি নির্বাচন করার কথা ভাবা হয়, তা প্রজ্ঞার পরিচায়ক নয়। এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সৃষ্ট আন্দোলনের মুখে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধান পাস করতে বাধ্য হয়েছিল। বিভিন্ন সময় দলটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামী লীগের ব্রেইন চাইল্ড। অথচ ২০১১তে এসে তারা তাদের ব্রেইন চাইল্ডকে ত্যাজ্য করে দিল। দলের নির্বাচনী ইশতেহারে এ ব্যাপারে কোনো ঘোষণা ছিল না। আইনটি বাতিলের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে তাদের ইতিবাচক মনোভাব ছিল। হঠাৎ আদালতের দোহাই দিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিধানটি বাতিল করা হলো। কিন্তু আদালত যে কয়েক লাইনের রায় দিয়েছিলেন, সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ বললেও তা সরাসরি বাতিলের কথা বলা হয়নি। বরং বলা হয়েছে যে, পরবর্তী দুই মেয়াদে বিষয়টি কার্যকর থাকতে পারে।
এটি ঠিক যে, আইনটির কিছু ত্রুটি ধরা পড়েছিল। সাবেক প্রধান বিচারপতিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার বিধান থাকায় পছন্দমতো ব্যক্তিকে সে অবস্থানে রাখার জন্য চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি বা সুপারসিড করার প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। যার ফলে বিচার ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আদালতের পর্যবেক্ষণও অনুরূপ। তা ছাড়া ১/১১-এর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তার আয়ুষ্কাল বাড়িয়ে নিয়েছিল। এ প্রবণতা মোকাবেলায় এর মেয়াদকালের বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে বিভিন্ন মহলের প্রস্তাব ছিল। বিধানে ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার রুটিন ওয়ার্ক করবে। কিন্তু রুটিন ওয়ার্কের সংজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। তাই রুটিন ওয়ার্কের সংজ্ঞায়নের দাবিও উঠেছিল। সব বিষয় বিবেচনায় রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংস্কার অপরিহার্য হয়ে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু সেই কাঙ্ক্ষিত সংস্কার না করে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে নতুন এক সংকটের জন্ম দিয়েছে। যারা এ সংকটের জন্ম দিল, তাদেরই কাজ এ থেকে উত্তরণ ঘটানো। তত্ত্বাবধায়ক আইন পুনর্বহালে আওয়ামী লীগের নেতাদের বড় অংশের ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে। মহাজোটের শরিক জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি প্রকাশ্যেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বলছে। এ ব্যাপারে প্রবল জনমতও রয়েছে।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বড় বাধা_ এখানে বিরোধী দলের কথা শোনার রেওয়াজ নেই। বরং তা এড়িয়ে চলার প্রবণতাই প্রবল। এ থেকে মুক্ত হওয়া দরকার। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেবল বিএনপির দাবি নয়; সাধারণ মানুষও মনে করে, ব্যবস্থাটি যৌক্তিক। সে হিসেবেই বিষয়টি দেখতে হবে। কিন্তু দাবিটি তুলে ধরার ক্ষেত্রে বিএনপি ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। আইন প্রণয়নের স্থান সংসদ। অথচ বিএনপি অযৌক্তিকভাবে সংসদ বর্জন করে চলেছে। দলটিকে সংসদমুখী রাখার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকাও সন্তোষজনক নয়। বিভিন্ন সময় তাদের কথাবার্তায় মনে হয়েছে, বিএনপি সংসদের বাইরে থাকলেই ভালো। তাই বলে নির্বাচিত হয়ে বিএনপির সাংসদরা সংসদে যাবেন না, তা কি আদৌ সমর্থনযোগ্য? সংসদে কথা বলতে না পারলে ওয়াকআউট করার সুযোগ আছে, কিন্তু লাগাতার বর্জনের মানে নেই। আর বাস্তব সত্য হচ্ছে_ সংসদে কথা বলতে দেওয়া হয়। বিনা হস্তক্ষেপে খালেদা জিয়ার ২ ঘণ্টাব্যাপী বক্তৃতা আমরা শুনেছি। আর বিএনপির সংসদ সদস্য কম হলেও বেশ কয়েকজন জাঁদরেল সাংসদ রয়েছেন। তারা বাগ্যুদ্ধে বেশ দক্ষ। সে ক্ষেত্রে কিসের ভয়?
আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকার, না দলীয় সরকার_ এ বিতর্কে সরকার ও বিরোধী দল ব্যস্ত। এর ফলে উপেক্ষিত হচ্ছে জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো। দ্রব্যমূল্য, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সমস্যা, সুশাসন প্রভৃতি জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে না। অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রী-সাংসদ-আমলাদের জন্য এটি ভালো। কেননা, তারা জবাবদিহিতার বাইরেই থাকছেন। কিন্তু দেশের উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের জন্য এটি মোটেই সুখকর নয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, দীর্ঘ সেনা ও স্বৈরশাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যে বিধানটি প্রবর্তিত হয়েছিল, তা অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে নিমিষেই মুছে ফেলা কি যৌক্তিক, না ক্ষমতার অপব্যবহার? সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে যা ইচ্ছা তাই করা যায় না। এখানে জনগণের অভিপ্রায়কে মূল্য দিতে হয়। বিরোধী দলের যৌক্তিক প্রস্তাবও মেনে নিতে হয়। এখানেই গণতন্ত্রের মাহাত্ম্য ও সৌন্দর্য।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে রাজনীতি ক্রমেই সংকটাপন্ন হচ্ছে। এ মুহূর্তে বিএনপি জাতির অভিভাবকের কাছে গিয়ে তাদের অভিপ্রায়ের কথা বলেছে। রাষ্ট্রপতি আন্তরিকতার সঙ্গে তাদের কথা শুনেছেন। ঘটনাটি কি এখানেই শেষ, না তিনি উদ্যোগী ভূমিকা নেবেন?
সংবিধান অনুযায়ী তার ভূমিকা পালনের সুযোগ নেই। কিন্তু রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে তার দায় আছে। তিনি উদার ও নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়ে সংকটের গভীরে চোখ মেলবেন এবং বাস্তবসম্মত সমাধানের উপায় খুঁজবেন। মহাজোট সরকারকে সে পরামর্শ দেবেন_ জনগণ সেটিই প্রত্যাশা করে।

আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments

Powered by Blogger.