প্রচ্ছদ রচনা-লিবিয়া যুদ্ধের দশটি মিথ্যা

শেষ পর্যন্ত গাদ্দাফিকে 'ক্রসফায়ারে' হত্যার মধ্য দিয়ে পশ্চিমা আগ্রাসী শক্তির মরিয়া নোংরামি আরেকবার প্রমাণিত হলো। কিন্তু গাদ্দাফিকে হত্যার পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। পশ্চিমা আশীর্বাদপুষ্ট মিডিয়া প্রতিদিন একটু একটু করে এই কাজটি করেছে সুকৌশলে। আরব বিশ্বে তেললোভী পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্রের শিকার আর কে হবে, তা বোঝার আগে মিডিয়ার এই ষড়যন্ত্র বোঝা জরুরি।


বিদেশি গবেষকদের তথ্য নিয়ে তেমনই ১০টি 'তৈরি করা সংবাদ' জানাচ্ছেন তানজীর মেহেদী মার্কিন বিরোধিতার পরিণতি যা হওয়ার, তা-ই হলো লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির বেলায়ও। দিনটি ছিল ২০ অক্টোবর, ২০১১। পশ্চিমা আশীর্বাদপুষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ (এনটিসি) আর ন্যাটোর বিমান হামলায় ক্রমেই পিছু হটতে হটতে উপায়ান্তর না দেখে পালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন গাদ্দাফি। পালানোর সময় একসঙ্গে হামলা চালায় ব্রিটিশ, আমেরিকান ও ফরাসি যুদ্ধবিমান। নিরুপায় হয়ে রাস্তার পাশেই নেমে একটি পাইপের ভেতরে আশ্রয় নেন এককালের প্রতাপশালী শাসক মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি। আন্তর্জাতিক আদালত তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও দেখামাত্রই গুলির নির্দেশ কিন্তু দেয়নি। তবুও 'গুলি করো না' বলেও অনুকম্পা পাননি। পাইপ থেকে টেনে-হিঁচড়ে তাঁকে বের করে আনে এনটিসি সেনারা। এর আগেই আহত হয়েছিলেন। এরপর যা ঘটল, তার সচিত্র প্রতিবেদন দেখেছে গোটা বিশ্ব। শত অন্যায়ও যেন ওই বর্বরতার সাফাই গাইতে পারে না। আহত গাদ্দাফিকে মারধর, এমনকি জুতোপেটাও করেছে এনটিসি সেনারা। কেউ কেউ ময়লাও ছুড়ে মারে। এরপর গাদ্দাফির মৃতদেহ নিয়ে উল্লাসে মাতে এনটিসির সেনারা। আর ব্ল্যাকবেরি ফোনে এসব ভিডিও ফুটেজ দেখে উচ্ছ্বসিত হিলারি ক্লিনটন বলেন, 'ওয়াও!', ফেলেছেন স্বস্তির নিঃশ্বাস। উল্লাস প্রকাশ করেছেন ওবামা, সারকোজি ও ক্যামেরনরা। কিন্তু এনটিসি সেনাদের ওই 'কাণ্ড' মেনে নেয়নি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর। গাদ্দাফি হত্যাকাণ্ডের চুলচেরা তদন্ত দাবি করেছে সংস্থাগুলো। কারণ জীবিতই আটক করা হয়েছিল গাদ্দাফিকে। চাইলে বিচারের মুখোমুখি করা যেত তাঁকে। এদিকে মৃত্যুর আগেই অবসান ঘটে গাদ্দাফির ৪২ বছরের শাসনের। মার্কিন আশীর্বাদপুষ্ট এনটিসিই গ্রহণ করেছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির দায়িত্ব। আট মাসের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণাও দিয়েছেন এনটিসিপ্রধান মাহমুদ জিবরিল। কিন্তু ঝামেলা আছে খোদ এনটিসির মধ্যেই। তবুও পশ্চিমা শক্তিদের দ্বিধাহীন সমর্থন আপাতত তাদের দিকেই। ইতিমধ্যে ওবামা প্রশাসন লিবিয়ার জব্দ করা সব অর্থ ফেরত দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে। তবুও সংশয় কাটছে না দেশটির পুনর্গঠন ও ভবিষ্যৎ নিয়ে। আর যুদ্ধকালীন লিবিয়া পরিস্থিতি নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও বাড়াবাড়ি জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের। তাদের ছুড়ে দেওয়া কিছু অভিযোগ তো এরই মধ্যে অসত্য মিথ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন কানাডার মন্ট্রিলের কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান ও নৃতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ম্যাঙ্িিমলিয়ান ফোর্ট। মিথগুলোর মধ্যে আছে লিবিয়া যুদ্ধ, গাদ্দাফি ও তাঁর শাসনামল নিয়ে বারবার ঘুরে-ফিরে আসা অভিযোগ। অভিযোগগুলো উত্থাপন করেছে ন্যাটো, ইউরোপীয় নেতারা, ওবামা প্রশাসন, মূলধারার গণমাধ্যম, তথাকথিত 'আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত' ও বিদ্রোহীরা। আসলেই কি অভিযোগগুলোর মধ্যে সত্যতা ছিল? আসুন খতিয়ে দেখি।

গণহত্যা!
ফেব্রুয়ারি, ২০১১। লিবিয়ার রাজপথে কেবল দানা বাঁধতে শুরু করেছে বিক্ষোভ। তার দিনকয়েক না ঘুরতেই ২১ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘে লিবিয়ার উপস্থায়ী প্রতিনিধি ইব্রাহিম দাব্বাশি নিজ দেশের শাসকের বিরুদ্ধাচরণ করে মন্তব্য করে বসলেন। তিনি বললেন, 'আমরা ত্রিপোলিতে প্রকৃতার্থেই একটি ভয়াবহ গণহত্যার আভাস পাচ্ছি। বিমানগুলো এখন ভাড়াটে সেনাদের বিমানবন্দরে নিয়ে আসছে।' দাব্বাশির এই অতিকথন জন্ম দিল আরো কিছু অতিকথনের। একটি বক্তব্যের ভেতর দিয়ে দাব্বাশি আসলে তিনটি বিষয়ের ইঙ্গিত করেছেন। প্রথমত, বিমানবন্দরের প্রসঙ্গ টেনে তিনি আসলে সেনা হস্তক্ষেপের বিষয়টিকে উস্কে দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, ভাড়াটে সেনা দিয়ে বুঝিয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষগুলোকে, যা বর্ণবাদকেও নির্দেশ করে। আর তৃতীয়ত, 'গণহত্যার হুমকি' কথাটি বলে জাতিসংঘকে তাত্তি্বকভাবে দায় গ্রহণের বিষয়টি নিয়ে একটু নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ঠিক দুই দিন পরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জানালেন, 'আমি আমার প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছি, তারা যেন গাদ্দাফির বিরুদ্ধে সবভাবে প্রস্তুত থাকে।'
কিন্তু গণহত্যা নিয়ে তো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইনি সংজ্ঞা রয়েছে। গণহত্যার মতো অপরাধ রোধ ও দণ্ড নির্ধারণে ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। সেখানে বলা হয়_'একটি জাতিগত, নৃতাত্তি্বক, সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় গ্রুপকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হত্যা করা হলে সেটাই হবে গণহত্যা।' কিন্তু সব সহিংসতামূলক ঘটনা গণহত্যা নয়। গৃহবিবাদ, আন্তকলহ কোনোভাবেই গণহত্যার শামিল নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও পশ্চিমা ন্যাটো বাহিনী যখন লিবিয়ায় বিমান হামলা চালাল, ওই হামলায়ও প্রাণ হারিয়েছে অসংখ্য মানুষ। তখন কি সেটা গণহত্যা নয়?

নিজের লোকের ওপর বোমা ছুড়েছে গাদ্দাফি!
একটু ভাবুন তো, কোনো বিচার-বিবেচনা না করেই প্রাথমিকভাবে লিবিয়াকে 'নো ফ্লাই জোন'-এর আওতায় আনা হয়েছিল কেন? কারণটা আর কিছুই নয়, গাদ্দাফি যেন বিমানযোগে তাঁর লোকদের ওপর বোমা হামলা চালাতে না পারেন, সে ব্যবস্থাটাই করা হয়। আসলেও কি তাই? এমন অশুভ চাল অবশ্য সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধেও দেওয়া হয়েছিল। 'সতর্ককারী' যখন 'গণহত্যা' প্রসঙ্গে সতর্কবার্তা ছুড়ল, সঙ্গে সঙ্গে লিবিয়াবিরোধীরাও সেই সুরে কথা বলা শুরু করল। আল-জাজিরা ও বিবিসি উভয় গণমাধ্যই দাবি করল, গাদ্দাফি তাঁর বিমানবাহিনীকে বিক্ষোভ দমনে ব্যবহার করছেন। চ্যানেলগুলো প্রচার করল, প্রতক্ষ্যদর্শীরা শহরে বিমান হামলা হতে দেখেছে। মার্চের প্রথম দিনে পেন্টাগনে এক সংবাদ সম্মেলন করেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট গেটস। তাঁর কাছে গাদ্দাফির বিমান হামলার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, 'আমরা আসলে প্রতিবেদনে সেটা দেখেছি। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের কাছে এখনো কোনো প্রমাণ নেই।' তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাডমিরাল মুলেনও জানালেন, 'এটাই সত্য, আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই।' অথচ নিরস্ত্র বিক্ষোভাকারীদের ওপর গাদ্দাফি হেলিকপ্টার যোগেও হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ তোলা হয়। আসলে এর মধ্য দিয়ে একটু অন্য ভাবেই খেলেছেন খেলাটা। পশ্চিমা বিমানগুলো যেন সহজেই লিবিয়ার আকাশসীমায় প্রবেশ করতে পারে, সে পথটা সুগম করাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য।

বেনগাজি বাঁচাও!
একে একে সব শহরের দখল নিল এনটিসি। সর্বশেষ গাদ্দাফির জন্ম শহর সার্তে দখলের মধ্য দিয়ে এনটিসির কবজায় এল গোটা লিবিয়ার নিয়ন্ত্রণ। প্রায় ৯ মাসের যুদ্ধে প্রকম্পিত হয়েছে লিবিয়ার শহরগুলো। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কত শত স্থাপনা। তবে একটা বিষয় বেশ লক্ষণীয়, বেনগাজিটা কিভাবে যেন ধ্বংসস্তূপ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে গেল! আর, জানেন তো আন্তর্জাতিক বিচারে বেনগাজিকে 'পবিত্র শহর' হিসেবেই কিন্তু দেখা হচ্ছে। ত্রিপোলি, সার্তে, সাবাহ_এসব শহর চুলোয় যাকগে, কার কী? কিন্তু বেনগাজির জন্য রয়েছে ওবামার বিশেষ দৃষ্টি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভালোবাসা আর ন্যাটোর কড়া নজরদারি। 'আমরা যদি আরেকটি দিনও দেরি করি' উল্লেখ করে ২৮ মার্চ ওবামা তো বলেই ফেলেছেন, 'বেনগাজি নির্বিচারে নৃশংসতার শিকার হতে পারে। আর তাই যদি হয় তবে গোটা অঞ্চলে এই ক্ষত প্রতিধ্বনিত হবে এবং তা বিশ্ব চেতনাতেও আঘাত হানবে।' মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজির যৌথ স্বাক্ষরিত এক পত্রেও বলা হয়, 'খুব দ্রুততার সঙ্গেই আমাদের দেশের সেনারা এগিয়ে যাচ্ছে। ক্রমেই পিছু হটছে গাদ্দাফি বাহিনী। এই রক্তস্নান থেকে বেনগাজিকে রক্ষা করায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম আমরা, এতে সক্ষম হয়েছি। ১০ হাজারেরও বেশি লোকের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।' উল্লেখ্য, গোটা লিবিয়ার অর্থনীতির সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ হয় এই বন্দরনগরী থেকেই। এখানেই গড়ে ওঠেছে দেশটির বেশির ভাগ শিল্পপ্রতিষ্ঠান। তেলনির্ভর অর্থনীতির এই দেশটির প্রধান দুই প্রতিষ্ঠান আল-ব্রেগা ও অ্যারাবিয়ান গলফ অয়েল কম্পানি তাদের কর্ম পরিচালনা করে এ শহর থেকেই।

আফ্রিকার ভাড়াটে সেনা
ফেব্রুয়ারি থেকেই গাদ্দাফিবিরোধীরা (শুরু থেকেই যারা বিদেশি শক্তির সমর্থন পেয়ে আসছে) দাবি করার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা করারও চেষ্টা করেছে, চলমান যুদ্ধে দুটি পক্ষ রয়েছে। একদিকে আছে কেবল গাদ্দাফি ও তাঁর পরিবার, আর অন্যদিকে রয়েছে সব লিবীয় জনগণ। আর গাদ্দাফি বাহিনী নিয়ে তাদের ভাষ্য ছিল, তাদের সবাই ভাড়াটে, তাদের সবাই আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ, আর তাদের উদ্দেশ্য যুদ্ধের বিনিময়ে অর্থ প্রাপ্তি। 'আফ্রিকান মার্চেনারি' সম্পর্কিত পশ্চিমা মিথটির 'প্রায়োগিক ব্যবহার' নিয়ে সবচেয়ে ভালো সার-সংক্ষেপ টেনেছেন প্যাট্রিক ককবার্ন। তিনি উল্লেখ করেন, জেনেভা সম্মেলনের পরিপন্থী হলেও কৃষ্ণাঙ্গ কয়েদিদের মিডিয়ার মুখোমুখি করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রমাণ করেছে, মুক্তি পাওয়া কারাবন্দিদের কেউই আসলে যোদ্ধা ছিল না। তারা সবাই ছিল অবৈধ শ্রমিক। যাদের ঠিকানা মালি, শাদ ও পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো। এই মিথটি প্রতিষ্ঠার পেছনের যুক্তি হচ্ছে, তারা আন্তর্জাতিক বিশ্বকে দেখাতে চেয়েছে গাদ্দাফির প্রতি কোনো লিবীয় নাগরিকের সমর্থন নেই। মিথ্যাকে আশ্রয় করে এমন প্রকাণ্ড ও প্রকৃত (!) গল্প তৈরি করল মিডিয়া ও পশ্চিামারা, যা শুনলে 'খুব মজাদার' গল্প হিসেবে কেবল শিশুরাই বিশ্বাস করতে পারে! পশ্চিমা সমর্থিত 'নতুন লিবিয়া' ও প্যান-আফ্রিকানিজম লিবিয়ার মধ্যে পার্থক্য দেখাতেও এই মিথটি বেশ উপযুক্ত ছিল। প্রকৃতার্থে অনেক বিদ্রোহী আসলে এটাই চেয়েছিল। মিথটি প্রতিষ্ঠা করতে কিছু মিডিয়া উঠে-পড়ে লাগলেও, শেষ রক্ষাটা হয়নি।

ভায়াগ্রা সেবন ও গণধর্ষণ
গাদ্দাফির শাসনামলে এত বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো শুনে বিস্মিত হবেন যে কেউই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এর পরও কেন নতুন গল্প তৈরির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল? কেন প্রচার করা হলো, গাদ্দাফি সমর্থকরা ভায়াগ্রা সেবন করে গণধর্ষণ করছে লিবীয় নারীদের? এ ধরনের গল্প ফেরি করার সম্ভাব্য কারণ হলো, ভারাক্রান্ত সাধারণ জনতার দৃষ্টি আকর্ষণ করা। অনেকে না বুঝেই লিবিয়াতে ভায়াগ্রা বিক্রি বন্ধে নানা পদক্ষেপও নিতে শুরু করেছিল। অথচ লিবীয় নাগরিকরা একবারও ভেবে দেখেনি, অন্যের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে নিজেদের নামেই কুৎসা রটাচ্ছে তারা।
কাতারভিত্তিক টিভি চ্যানেল আল-জাজিরা তার অংশীদার 'বিদ্রোহী'দের নিয়েই সর্বপ্রথম ভায়াগ্রার গল্পটি ফাঁদে। পরে পশ্চিমা মিডিয়াগুলো এই সংবাদ পরিবেশনে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। এমনকি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান আইনবিদ লুইস মরেনো-ওক্যাম্পো বিশ্বগণমাধ্যমের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, 'আমাদের কাছে প্রমাণ আছে, ধর্ষণের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলতে গাদ্দাফি তাঁর অনুগত বাহিনীর কাছে ভায়াগ্রা বিতরণ করছেন।' সেনাদের শত শত নারীকে ধর্ষণের নির্দেশও দিয়েছেন গাদ্দাফি বলেও জানান ওক্যাম্পো। তিনি আরো বলেন, 'আমরা জানতে পেরেছি, গাদ্দাফি নিজেও ধর্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যারা গাদ্দাফির বিরোধিতা করবে তাদের সবাইকে ধর্ষণ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে গাদ্দাফি সমর্থকরা।' এমনকি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মার্কিন দূত সুসান রাইচও ভায়াগ্রা নিয়ে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে একই অভিযোগ উত্থাপন করেন। যদিও তথ্য-প্রমাণাদির প্রশ্নে বরাবরের মতো চুপ মেরে যান তিনিও। তবে মার্কিন সেনা ও গোয়েন্দা সূত্রগুলো এনবিসি নিউজের কাছে বলেছে, লিবীয় সেনা কর্তৃক ভায়াগ্রা সেবন করে কিংবা বলপ্রয়োগ করে ধর্ষণের বা ধর্ষণচেষ্টার কোনো তথ্য-প্রমাণ মেলেনি। বিদ্রোহী এলাকাগুলোতে কোনো ধর্ষণের ঘটনারও প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলেও জানায় তারা। মার্কিন সেনাদের এমন স্বীকারোক্তির পর একটু সুর পাল্টে কথা বলেন 'লেডি ক্লিনটন'। মার্কিন এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী গাদ্দাফির নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি দোষ চাপালেন তৃতীয় আরেকটি দলের ওপর। তারা আসলে কারা হিলারি নিজেও জানতেন না! তবে নিজেও একজন নারী বলেই হয়তো বিষয়টি নিয়ে বেশ 'উদ্বিগ্ন' দেখা গেছে হিলারি ক্লিনটনকে। কিন্তু জুনের ১০ তারিখে পাল্টে যায় সব হিসাব-নিকাশ। লিবিয়ায় ধর্ষণের অভিযোগটি খতিয়ে দেখার পর জাতিসংঘের মানবাধিকার কর্মকর্তা শেরিফ ব্যাসিওনি বলেন, ধর্ষণের অভিযোগটি 'বড় ধরনের স্নায়ুবৈকল্য' ছাড়া কিছুই নয়। তবুও থামানো যায়নি গণমাধ্যমগুলোকে। এক হাত দেখে নিতে চাইল বিবিসি। এই বার্তাসংস্থাটি জানাল, এমন বক্তব্য প্রদানের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও গণমাধ্যমকে হেয়প্রতিপন্ন করেছেন ব্যাসিওনি।

রক্ষার দায়!
ভুল হলেও আমরা জেনেছিলাম, গাদ্দাফি বাহিনীর নেতৃত্বেই লিবিয়াতে 'গণহত্যা' সংঘটিত হতে যাচ্ছে। আর এই প্রচারণাটা সুগম করে দিল পশ্চিমাদের অবৈধ হস্তক্ষেপের পথ। জাতিসংঘের ২০০৫ সালের 'রেসপনসিবিলিটি টু প্রোটেক্ট (আর টু পি)' নীতি কার্যকর করতে মরিয়া হয়ে উঠল পশ্চিমা জোট। এদিকে লিবিয়া পরিস্থিতিও মিসর, সিরিয়া ও ইয়েমেনের মতো রূপ নিতে শুরু করেছে। কিন্তু জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৯৭৩ সালের প্রস্তাবনা অনুসারে, একটা বিষয় তখনো পরিষ্কার হয়নি যে 'মানবতা রক্ষায় হস্তক্ষেপ' অজুহাত দিয়ে পশ্চিমা সেনাদের লিবিয়ায় প্রবেশ করার যৌক্তিকতা কতখানি। কিন্তু পশ্চিমারা সব জায়গায় যেতে না পারার অর্থ কিন্তু এই নয়, তারা লিবিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে পারবে না! কিন্তু পশ্চিমাদের কাছে লিবিয়া কেন লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলো, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারেনি তারা। আর এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জাতিসংঘের 'আর টু পি' নীতির বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা রয়েছে। এই নীতিকে আধিপত্য ও প্রভুত্ববাদী ভূ-রাজনীতির লজ্জাস্থান ঢাকার 'ডুমুর পাতা' হিসেবেই দেখছেন অনেকেই। কেননা গাজায় যখন সাধারণ ফিলিস্তিনিরা আক্রমণের শিকার হয়, তখন এ নীতি নিয়ে কেউই কোনো প্রশ্ন তোলে না। তাহলে কি নীতিটাই পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে? ফলে মানবতা রক্ষার অজুহাতে বিদেশি সেনারা প্রবেশ করল লিবিয়ায়। আর এই মিথকে কার্যকর করতে এড়িয়ে যেতে হলো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, আফ্রিকার প্রতি চীনের দৃষ্টিভঙ্গি। কেননা পশ্চিমাদের সঙ্গে স্নায়ু-লড়াই করে আফ্রিকার মাটিতে নিজেদের স্বার্থ ও প্রভাব তৈরি করতে বেশ প্রস্তুত চীনারাও।

গাদ্দাফি_দ্য ডেমন
নিজের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে বলুন তো, গাদ্দাফি কি নায়কোচিত বিপ্লবী, যিনি পরে পশ্চিমাদের কূটচালেই চরম আকার ধারণ করেছিলেন, না কি গাদ্দাফি আসলেই একজন বদ লোক? তবে এটাও সত্য যে উভয় ক্ষেত্রে গাদ্দাফির পাশবিক হয়ে ওঠা ছিল প্রয়োজনহীন ও অযৌক্তিক। আর গাদ্দাফির ক্ষমতা, শাসন ও ইতিহাসকে কলুষিত করতে পশ্চিমাদের কাছে এই মিথটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। 'গাদ্দাফি কিছু করে দেখাতে চাননি, তিনি আগাগোড়াই একজন শয়তান ছিলেন'_এমন মিথ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে পশ্চিমারা দেখাতে চেয়েছে, লিবিয়ায় গাদ্দাফির অনুগতরা তাদের সমর্থনের কথা স্বীকার করতে যেন লজ্জাবনত হয়ে পড়ে। আর প্রকাশ্যে যারা ন্যাটোর সঙ্গে রয়েছে, তারাই যেন বুক চিতিয়ে বলতে পারে 'আমরাই প্রকৃত লিবীয়'। যুদ্ধকালীন লিবিয়ায় একটু নজর দিলেই দেখা যাবে, সেখানে গাদ্দাফিবিরোধী এবং একই সঙ্গে বিদেশি হস্তক্ষেপ, তথা ন্যাটোর বিপক্ষে কথা বলছে_এমন কোনো দল বা ব্যক্তি নেই। এমনটা যেন না হয় সেই ব্যবস্থাটাও সেখানে বিরাজ করছিল। ফলে লিবীয়রা দুই ভাগেই বিভক্ত হয়ে পড়ে। ওই সময়টাতে ইতিহাস ঘেঁটে গাদ্দাফির মন্দ দিকগুলো বেশ গুরুত্বসহকারে উত্থাপন করা হয়েছিল। গ্লেন গ্রিনওয়ার্ল্ড নামের একজন তো বলেছেন, 'একজন মানুষ কোনোভাবেই গাদ্দাফির জন্য সহানুভূতি দেখাতে পারে না।' অথচ নিকারাগুয়া, ত্রিনিদাদ, ডমিনিকা, মন্ট্রিলের সাধারণ মানুষ গাদ্দাফির অন্ধভক্ত। কেবল বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে ছিলেন বলেই নয়, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধাচরণের কারণেও তিনি পেয়েছেন জনপ্রিয়তা। গাদ্দাফি প্রশাসনের বেশ কয়টি মুখ ছিল। যাদের কেউ তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করত, কেউ তাঁর মুখাপেক্ষী ছিল, আবার কেউ কেউ সারকোজি, কন্ডোলিৎসা রাইস, হিলারি ক্লিনটন ও বারাক ওবামার আশীর্বাদ পেয়ে মুচকি হাসত এবং এই মুখগুলোর সব কয়টি ছিল প্রকৃত সত্য।
এত কিছুর পরও মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট ও সংবাদমাধ্যম বিবিসি গাদ্দাফির কিছু সাফল্যকে স্বীকার করেছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য, আবাসন ও শিক্ষা খাত নিয়ে গাদ্দাফির প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছে ঘোর বিরোধীরাও। উল্লেখ্য, আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে লিবিয়ায় শিক্ষার হার সবচেয়ে বেশি।

মুক্তিযোদ্ধা_দ্য অ্যাঞ্জেল
গাদ্দাফির বিরুদ্ধে প্রচারণার মধ্য দিয়ে আসলে 'বিদ্রোহীদের' বন্দনাই গাওয়া হয়েছে। যেন দেশটির সাধারণ নাগরিকরা বিদ্রোহীদের পক্ষে যেতে বাধ্য হয়। অথচ দীর্ঘ একটা সময় গেছে, যখন সংবাদকর্মীরা বিদ্রোহীদের সংগঠন ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের (এনটিসি) সঙ্গে কোনো যোগাযোগই করতে পারেনি। তখন এনটিসির কার্যালয় ছিল বেনগাজি শহরে। এমনকি তারা জানায়নি কিভাবে, কারা গাদ্দাফিবিরোধী আন্দোলনের ছক-পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে বা হয়েছে। জানায়নি, এটা কি সম্পূর্ণ আলাদা একটি সংগঠন, নাকি বেশ কয়টি দল নিয়েই গঠিত হয়েছে। বলা হয়নি, এনটিসি গঠনের উদ্দেশ্য ও বিধেয়। তবুও বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম বলার চেষ্টা করেছে, গাদ্দাফিবিরোধী আন্দোলনটি লিবীয় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। হয়তো আংশিকভাবে এ কথাটা সত্য অথবা গোটা বিষয়টি অতিরিক্ত সহানুভূতির অংশ। কিন্তু ২০০৫ সাল থেকে লিবিয়ায় কর্মরত ইউএসএইড, ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ইনস্টিটিউট, ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট, ন্যাশনাল ইনডোমেন্ট ফর ডেমোক্রেসির মতো বহিরাগত প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সিআইএর আলোচনার খবরটি বেশ সাড়া ফেলে বিশ্লেষকদের মধ্যে। দানা বাঁধতে থাকে নানা সন্দেহ। যদিও অনেকেই 'ভালো ছেলেদের' তথা বিদ্রোহীদের প্রয়োজনেই এসব করা হয়েছে বলে মত দিয়েছেন। কিন্তু আমেরিকা তো এমন একটা বিশ্ব চায়, যেখানে সবাই দেখবে কেবল তারাই সব ভালো কাজ করে। তারা আরো দেখাতে চায়, পৃথিবীর জন্য তারা শুধু অপরিহার্যই নয়, নিষ্কলঙ্কও বটে! সত্য হলো, এটি এমন একটি বিশ্ব, যা আমেরিকার জন্য নিরাপদ। একই সঙ্গে এটি এমন একটি বিশ্ব, যা মন্দদের জন্য খুবই অনিরাপদ।

লিবীয় নাগরিকদের জয়
যুদ্ধ থেমে গেছে। জয়ও পেয়ে গেছে এনটিসি। গোটা লিবিয়ায় এখন অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। কিন্তু জয় অনেকাংশেই নিশ্চিত হওয়ার পরও কিংবা জয়লাভের পরও একটা চেষ্টা এখনো শেষ হয়নি। আর সেটা হলো, পশ্চিমাদের অনুপ্রেরণায় এনটিসি এখন দেখাতে চায়, দেশটির সাধারণ নাগরিকরা নিজেদের প্রয়োজনে এই বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। এনটিসি চাচ্ছে, লিবিয়ার জনগণের পাশাপাশি গোটা বিশ্ব জানুক, নিজেদের ভাগ্য নিজেরা গড়তেই ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে প্রতাপশালী গাদ্দাফিকে। তারা পুরোপুরি অস্বীকার করতে চায় কিংবা করাতে চায় এ যুদ্ধে গাদ্দাফিরও জনসমর্থন থাকার বিষয়টি। শুরুর দিকে অর্থাৎ ২৫ ফেব্রুয়ারি রাস্তায় বিক্ষোভকারীদের নামতে দেখেই সারকোজি মন্তব্য করেছিলেন, গাদ্দাফিকে এবার 'অবশ্যই ক্ষমতা ছাড়তে' হবে। এর ঠিক তিন দিন পরই কোনো কূটনৈতিক আলাপ কিংবা কোনো ধরনের শান্তি আলোচনার প্রস্তাব ব্যতিরেকেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন 'নো-ফ্লাই জোন' প্রস্তাবনা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন। ৩০ মার্চ প্রকাশিত দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়েক সপ্তাহ ধরেই সিআইএর একটি দল লিবিয়ার অভ্যন্তরে রয়েছে। এর মানেই হলো, আন্দোলন শুরু হওয়া মাত্রই সেখানে পেঁৗছে গেছে সিআইএ। একই সময়ে লিবিয়ায় অবস্থান নেন ডজনখানেক ব্রিটিশ স্পেশাল ফোর্স ও এমআই-সিঙ্রে কর্মকর্তা। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ওবামা একটি গোপন চিঠিতে স্বাক্ষর করে লিবিয়ার বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও সব ধরনের সাহায্য প্রদানের নির্দেশ দেন সিআইএকে। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমা জোট সেনাদের পাশাপাশি বিদ্রোহীদের জয় নিশ্চিত করতে আরো এসেছে জর্দান আর কাতারের সেনারাও। হাস্যকর বিষয় হলো, এত কিছুর পরও বলা হচ্ছে, লিবিয়ার জনগণই এ যুদ্ধে জয়লাভ করেছে।

'দ্য লেফট'-এর জন্য পরাজয়
২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো 'দ্য লেফট'-এর ধারণাটা আমরা পেয়েছিলাম। সেই বছর ইরানের নির্বাচনে যারা বিরোধিতা করেছিল, তাদেরই 'লেফট' বলা হয়েছিল। কিন্তু লিবিয়ায় 'লেফট' আসলে কারা? সমজাতিক মনোভাবাপন্ন কোনো দল? নাকি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মার্কসপন্থী 'লেফট' বলতে যা বোঝানো হয়, তাই? কিন্তু তেমন কোনো কিছু লিবিয়ায় এখন পর্যন্ত নেই। তবে হ্যাঁ, একটা বিষয় নিয়ে আসলেই ভাবার সুযোগ আছে। আর সেটা হচ্ছে, বিদেশি হস্তক্ষেপ নিয়ে কি কারো প্রশ্ন তোলার আশঙ্কা রয়েই যাচ্ছে? নতুন লিবিয়ার পররাষ্ট্রনীতি নিয়েও হয়তো আসতে পারে কিছু প্রতিবন্ধকতা। এমন বিষয়গুলো প্রকৃতার্থেই পশ্চিমা বিশ্বের জন্য চিন্তার কারণ। আর তেমন কিছু ঘটলে বলে ফেলা যায়, 'লেফট' আসলেই সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে নতুন লিবিয়ায়।
প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সময় নিয়ে শেষ হলো লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ। বিজয় নিশ্চিত হয়ে গেলেও কাটছে না সংশয়। ২০০১ সালে কাবুলে কিংবা ২০০৩ সালে বাগদাদে যখন এ রকম পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীনদের হটানো হয়েছিল, তখনো নেমে আসে নানা সংকট। যদিও সমর্থকরা 'অনতিক্রম্য' শাসকের বিরুদ্ধে বিজয় পেয়ে মেতেছিল উল্লাসে। লিবিয়াজুড়েও এখন চলছে সেই রকম বিজয় উৎসব। কর্নেল গাদ্দাফির ক্ষমতাচ্যুতির পাশাপাশি মৃত্যুটাও নিশ্চিত হয়ে গেছে। কিন্তু গাদ্দাফির পরাজয়ে কাঙ্ক্ষিত 'ক্ষমতা' কারা অর্জন করল, নিশ্চিত হয়নি সেই উত্তরটি। এখন যারা বিজয় উল্লাস করছে, পরবর্তী ভাবনা নিয়ে কি আদৌ তারা ভেবেছে? পশ্চিমা আশীর্বাদপুষ্ট এনটিসি ও তাদের কর্তৃপক্ষকে ঘিরেও আছে সংশয়।

লিবিয়ার ভবিষ্যত কী
লিবিয়ার এ যুদ্ধটি শেষ হয়ে জন্ম দিয়েছে আরেকটি সমস্যার। যুদ্ধে অংশ নেওয়া দল দুটির (গাদ্দাফি বাহিনী ও বিদ্রোহী) মধ্যে কারা শক্তিশালী, তার কোনো উত্তর মেলেনি। কেননা বিদ্রোহীদের জয়ে বিশাল ভূমিকা রেখেছে ন্যাটোর বিমান হামলা। গাদ্দাফিকে দমন করতে বিদ্রোহীদের সমর্থনে হাজার দশেক বিমান হামলা চালিয়েছে ন্যাটো বাহিনী। তাই প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক, পশ্চিমা সাহায্য নিয়ে লিবিয়ার বিদ্রোহীদের এই জয় দেশটিতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে কতটা সফল হবে?
ইরাক আক্রমণে সাদ্দামকে পরাজিত করার পর বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল মার্কিন বাহিনী। ওই সময় ইরাকি সামরিক বাহিনীকে অচল করে দেওয়ার পাশাপাশি বাথ পার্টির সব সদস্যকে ক্ষমতা ও চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল তারা। ফলে সংঘাতে জড়িত হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না তাদের। যদিও সাদ্দামের পতনে বেশির ভাগ ইরাকি সেদিন খুশি হয়েছিল। কিন্তু সাদ্দামের স্থলে দেশের শাসনকর্তা কে হবেন, সেটা ঠিক করতেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে ঠেকেছে দেশটি।
লিবিয়ায়ও কি তাই ঘটতে যাচ্ছে? তেলনির্ভর দেশটিতে পুরনো শাসকের আমলের অনেকেই চাকরি পেয়েছেন, যাঁদের সবাই দেশের স্বার্থেই কাজ করছেন। কিন্তু ইরাকের পুনরাবৃত্তি যদি এখানেও ঘটে, তাঁদের কী হবে? টিএনসি তাদের যোদ্ধাদের প্রতিশোধপরায়ণতা থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিলেও পরিস্থিতি কতক্ষণ অনুকূলে থাকে, সেটাও দেখার বিষয়। এখনো বেঁচে আছে গাদ্দাফিপুত্র সাইফ আল ইসলাম ও তাঁর নিরাপত্তাপ্রধান আবদুল্লাহ সানুচি। ফলে সমর্থকদের নিয়ে তাঁরাই এনটিসির কাল হয়ে দাঁড়ান কি না, ঘুরে-ফিরে আসছে সে প্রশ্নটিও। বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এনটিসিকে ছেড়ে কথা বলবেন না গাদ্দাফি সমর্থকরা। লিবিয়া দীর্ঘ একটি যুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে, এটা চিন্তা করাও কিন্তু অমূলক নয়। লিবিয়া-বিশেষজ্ঞ জন হ্যামিলটন বলেন, 'এনটিসি লিবিয়ার জনগণের জন্য সহজে ভালো কিছু করতে পারবে, এটা ভাবা ঠিক হবে না।' তিনি আরো বলেন, 'বর্তমান যুগে গণতন্ত্র এখনো অধরা। যদিও গণতন্ত্রের জন্যই লড়েছে তারা। এনটিসি কি পারবে লিবীয়দের কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের স্বাদ এনে দিতে? মনে হয়, এত সহজে তাদের জন্য গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে পারবে না এনটিসি। লিবিয়ায় স্থিতিশীলতা আনতে আরো দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হবে এনটিসির।'
দেশটিতে বাস করছে একাধিক উপজাতি গোষ্ঠী। যাদের অধিকাংশ গাদ্দাফি অনুগত। তারাও গাদ্দাফি সমর্থকদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে লড়েছে এনটিসির বিরুদ্ধে। গাদ্দাফি নেই তাতে কী_এনটিসিকে নতুন চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে এসব উপজাতীয়রাও। লিবিয়া-বিশেষজ্ঞ অ্যালেঙ্ ওয়ারেন বলেন, দেশটিতে গাদ্দাফি অনুগত বাহিনী এখনো এনটিসির কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। ফলে এখনই বলা যাবে না, গৃহযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে।
এত কিছুর পরও আফগানিস্তান কিংবা ইরাকের চেয়ে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে লিবিয়া। কেননা দেশটিতে জনসংখ্যার চাপ কম। তা ছাড়া খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানহীনতায় ভুগছে এমন নাগরিকের সংখ্যাও সীমিত। ফলে এখন দরকার দক্ষ চালিকাশক্তি।
আফগানিস্তান ও ইরাকে বহিঃশক্তিগুলো সব কিছুতেই নিজেদের প্রভাব খাটিয়েছে। শত্রুদের প্রতি তারা ছিল ক্ষমাহীন। বিদেশি শক্তিগুলো দেশ দুটির জনগণকে বোঝাতে চেয়েছে, তাদের বর্তমান শাসক আগের চেয়ে নির্ভরযোগ্য ও বন্ধুত্বপূর্ণ। আর এটাই হলো বিজয়ের হঠকারী মুহূর্ত। কারণ এগুলোই ভবিষ্যতের বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। তাই বিদেশি শক্তির প্রতি অনুগত না হয়ে লিবিয়ার উচিত নিজেদের শাসক নিজেরাই নির্বাচিত করা।
লিবিয়ার অন্তর্বর্তী পরিষদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশটির ৬০ লাখ মানুষের স্বপ্ন পূরণ। গাদ্দাফির স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যারা অস্ত্র হাতে নেমেছে, তাদের জন্য কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এনটিসি, সেটাই এখন দেখার বিষয়। জনগণের প্রত্যাশা, লিবিয়ার তেলকে দেশ গড়ার কাজে লাগাবে বর্তমান সরকার। গাদ্দাফি সাম্রাজ্যের পতন ঘটলেও এখনো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাঁর অনুসারীরা।
মার্কিন সিনেটর জন ম্যাকেইন সম্প্রতি লিবিয়া সফরে এসে বলেন, সেখানে কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এখনো গড়ে ওঠেনি। এনটিসি কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নয়। আবার এনটিসি প্রধান মোস্তাফা আবদুল জলিলের ওপর সবার সমান আস্থা নেই বলেও জানিয়েছিলেন ম্যাকেইন। তাই ওয়ারেন মনে করেন, লিবিয়ায় সহসা রাজনৈতিক সমাধান দুরাশা মাত্র। ফলে চলমান গৃহযুদ্ধ আরো দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা উঁকি দিচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.