বাংলাদেশ-ভারত পানি চুক্তির ১৪ বছরঃ ১৩ বছরই ন্যায্য হিস্যা পাওয়া যায়নি

ক সময়ের প্রমত্তা পদ্মা এখন পরিণত হয়েছে হাঁটুজলে। নদীর মূল স্রোতধারা শুকিয়ে ও বহুবিভক্ত হয়ে কতকগুলো সরু খালে পরিণত হয়েছে। সেখানকার হাঁটুপানি ঘিরে এখন দিগন্তবিস্তৃত ধু ধু বালুচর। পাকশি হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচ দিয়ে চলছে ট্রাক।
পদ্মা ও তার শাখা নদীগুলোতে এখন নৌ-চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। শুকিয়ে যাওয়া নদীর বুকে চাষাবাদ শুরু হয়েছে। আর সেচ সঙ্কটে পড়েছে নদীতীরবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ক্ষেত-খামার। পদ্মার এমন দশা নিয়ে পাবনা প্রতিনিধির পাঠানো রিপোর্ট ছাপা হয়েছে গতকালের আমার দেশ-এ। দিনটি ছিল পানিচুক্তি স্বাক্ষরের ১৪ বছর পূর্তি দিবস।
১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল বাংলাদেশ ও ভারতের তত্কালীন দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে। বাংলাদেশের পক্ষে শেখ হাসিনা ও ভারতের পক্ষে চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন এইচডি দেবগৌড়া। ৩০ বছর মেয়াদি এ চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ বেশি পানি পেয়েছিল প্রথম বছর। এতে খুশি হওয়া বাংলাদেশ পক্ষের মুখের হাসি মিলিয়ে যায় পরের বছরই। পরবর্তী ১৩ বছরই পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে বাংলাদেশকে। স্বাক্ষরিত চুক্তিতে কোনো গ্যারান্টি ক্লজ না থাকায় তখন সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। বিরোধী দলগুলো প্রতিবাদে হরতালও পালন করেছে। কিন্তু সরকারের টনক নড়েনি।
চুক্তি অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে মে মাস শুষ্ক মৌসুম। এ সময়ই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে দু’দেশের বিশেষজ্ঞ কর্তৃক পানির গড় প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে উভয় দেশের হিস্যা নির্ধারিত হওয়ার কথা। ভারত সে হিস্যা কখনও পূরণ করেনি। গত শুষ্ক মৌসুমে প্রায় এক লাখ কিউসেক পানি কম পেয়েছে বাংলাদেশ। যৌথ নদী কমিশন সূত্রমতে, চলতি বছর শুষ্ক মৌসুমের ১৫ কিস্তির মধ্যে ছয় লাখ ২০ হাজার ১৫৭ কিউসেক পানি পাওয়ার দাবিদার হলেও বাংলাদেশ পেয়েছে পাঁচ লাখ ২৪ হাজার ৫৮ কিউসেক পানি। উজানে পানি প্রত্যাহারের ফলে পদ্মার পানিপ্রবাহ কমে গেছে। পানি চুক্তির পর আগের তুলনায় এ বছর পদ্মায় পানিপ্রবাহ দশমিক ৭২-৯০ মিটার কম ছিল।
দেশের বৃহত্তম গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প হুমকির মুখে পড়েছে। শাখা নদীগুলোও বছরের বেশিরভাগ সময় থাকে পানিশূন্য। নদীগর্ভ পরিণত হয়েছে ধানের ক্ষেতে। এর ফলে নদী তীরবর্তী বিশাল অঞ্চলজুড়ে পরিবেশগত ভারসাম্য, জীববৈচিত্র্য ও জনজীবনে দেখা দিয়েছে নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়া। নদীর দু’পাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে হাজার হাজার একর জমিতে সেচ ব্যাহত হয়ে কৃষি কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। হুমকি সৃষ্টি হয়েছে বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলে। আবার নদীগর্ভ ভরাট হওয়ায় বর্ষার শুরুতে নদীভাঙন তীব্র হয়ে ওঠে। বিপর্যস্ত হয় হাজার হাজার মানুষের জীবন। নদীপাড়ের ফসলি জমি ও ভিটেমাটি ভেঙে যায় স্রোতের তোড়ে। এসবই দেশের উত্তর-পশ্চিম-দক্ষিণ অঞ্চলজুড়ে সৃষ্টি করেছে বিপর্যয়।
যৌথ নদী কমিশনের সভায় বাংলাদেশ পক্ষ থেকে বারবার আপত্তি তোলা হলে ভারতীয় পক্ষ আশ্বাসের বাণী জানিয়েই বুঝ দেয়। অনেক সময় তারা বৈঠকেই আগ্রহ দেখায় না। গঙ্গায় ফারাক্কা পয়েন্টে বাঁধ নির্মাণ করেই তারা থেমে থাকেনি, অন্যান্য নদীতেও হাত দিয়েছে। অথচ যে কোনো আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে উজানের দেশকে অতি অবশ্যই ভাটির দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে সমঝোতার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হয়, এটাই আন্তর্জাতিক নিয়ম। কিন্তু ভারত সে সবের তোয়াক্কা করছে না। বাংলাদেশে প্রবেশ করা ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীর মধ্যে ৫৪টি নদীতে ভারত বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ফারাক্কার পর তিস্তা নদীর উজানে গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার চলছে। এখন বরাকের টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। এটা সফল হলে সুরমা-কুশিয়ারা তথা মেঘনায় পানিপ্রবাহ হ্রাস পাবে মারাত্মকভাবে। আর তাতে দেশের পূর্ব-দক্ষিণাঞ্চলে মহাবিপর্যয় সৃষ্টি হবে, এটা নিশ্চিত।
এ অবস্থায় বর্তমান সরকারের দায়িত্ব ভারতের সঙ্গে পানি সমস্যা নিয়ে আলোচনাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব দেয়া। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরের আলোচ্যসূচিতে বিষয়টি সামনের দিকে স্থান পাবে বলেই দেশবাসীর আশা।

No comments

Powered by Blogger.