শুদ্ধ শিল্পের সাধনা-সংস্কৃতি by আমিরুল আলম খান

কল্পনীয় লাভ এই মরণখেলা রিয়েলিটি শোতে। কী করে রক্ষা করা যাবে এই পুঁজি? সোজা বুদ্ধি বেরিয়ে এলো মিডিয়া সম্রাটদের উর্বর মগজ থেকে। অনুন্নত, গরিব দেশগুলোতে চালান করে দাও স্টার বানানোর এই মরণখেলা, রিয়েলিটি শো, ঢালো অঢেল অর্থ। কিন্তু ততদিনে দক্ষিণ আমেরিকায় নতুন জাগরণ ঘটছে। সুতরাং সেখানে খুব সফল হলো না তারা। দৃষ্টি পড়ল এশিয়ায়।


প্রথমেই শতকোটি মানুষের দেশ ভারতবর্ষ মঞ্চে ঠিকরে পড়ছে হাজার পাওয়ারের উজ্জ্বল রঙিন আলো। উচ্চগ্রামে বাজছে যন্ত্র। তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান কিংবা নাচ। যারা গাইছে কিংবা নাচছে, বয়স তাদের কতই-বা? স্কুলের নিচের ক্লাসের পাঠই শেষ হয়নি অনেকের। মঞ্চে 'পারফরম্যান্স' দেখতে হাজির বাবা-মা। সঙ্গে হয়তো আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হয়েছে কিছু বন্ধু-বান্ধবকেও। এ হলো বাংলাদেশে সংস্কৃতির সর্বশেষ সংস্করণ।
এরই অন্যতর সংস্করণ হলো টেলিভিশনে নানা কিসিমের 'প্রতিভা সন্ধানের' অমানবিক প্রতিযোগিতা। চটকদার নাম রিয়েলিটি শো। চ্যানেল খুললেই হরেক নামের আড়ালে হাজির তারা। না শিখতেই পারফরম্যান্সের এ আয়োজন হয়তো এক দশক আগেও অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু শিকড়চ্যুত সংস্কৃতির এই হাল হয়েছে মারডকীয় বিলিয়ন ডলারের পুঁজির দাপটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রিয়েলিটি শোর এই অপসংস্কৃতির জন্ম আরও দশকতিনেক আগে। মার্কিন সমাজ ব্যবস্থায় হাজার হাজার বেকার, হতাশাগ্রস্ত যুবক-যুবতীকে নাচ-গানের মাধ্যমে স্টার বানানোর মাদকে বুঁদ করে রাখার সেই প্রয়াসের বলি হলো সে দেশের লাখ লাখ শিশু-কিশোর।
লাখ লাখ টাকার পুরস্কারের (!) হাতছানি। সবাইকে তারকা (স্টার) হতে হবে। একবার তারকা হলে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। টাকা ঘুরবে 'তারকার' পেছনে পেছনে। টাকার জন্য উন্মাদ সারাদেশ। শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকলের চাই শুধু টাকা আর টাকা। সেই সঙ্গে নাম, যশ। একবার টেলিভিশনে মুখ দেখাতে পারলেই জীবন সার্থক। তার জন্য সব ত্যাগ করতে রাজি; শুধু গররাজি 'রেওয়াজ' বা চর্চায়। অত সময় নেই, ধৈর্য নেই। একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ চলে যন্ত্রের সঙ্গে পালা দিয়ে, উল্কাগতিতে সব পেতে হবে তাকে, সব। অর্থ, যশ, প্রতিপত্তি ... সব। এই করপোরেট যুগে কে কত দ্রুত কত বেশি টাকা কামাই করতে পারে তার অমানবিক রেস সর্বত্র। এভাবে মার্কিন সমাজে আবির্ভূত হলো একটি শিকড়হীন প্রজন্ম। তারা সমাজ মানে না, মা-বাবাকে চেনে না, পরিচয় দেয় না। শিকড়হীন শ্যাওলার মতো ভেসে চলে, কোথা থেকে কোথায় কেউ জানে না। নিজেও জানে না। পৃথিবীর কোনো কিছুই তাকে আকর্ষণ করে না। হতাশার অতল গহ্বরে তলিয়ে যায়। তলিয়ে যাওয়ার আগে এই পৃথিবীকে বসবাস অযোগ্য করে রেখে যায়। সে ক্রমেই হন্তারক হয়ে ওঠে, সমকামী হয়। পৃথিবীর সব সৌন্দর্যে তার ঘোর আপত্তি; নিয়মে আপত্তি। ঐতিহ্য তার কাছে অর্থহীন; সভ্যতা বলতে কিছু নেই, যেন ছিল না কোনোকালে। সংস্কৃতি বলতে সে চেনে উন্মাতাল জীবনযাপন। শিল্প অর্থহীন নোংরামি! সে সুর চেনে না, শুধুই চেঁচানিতে তার সুখ। আত্মিক সুখ বলে কিছু প্রতিভাত হয় না তার, জৈবিক সুখই একমাত্র সাধনা তার।
মারডকীয় এই উন্মাদনার মোড়কে মোড়া বিশ্ব শুধু দুয়েকজন স্টারকে মনে রাখে, তাও হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো। প্রতিভার সঙ্গে চর্চার সাযুজ্য না হওয়ায় অচিরেই তারা হারিয়ে যায় স্মৃতির অতলে। শুধু হারিয়ে যাওয়া নয়, তারা হতাশার অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হয়ে এক অমানবিক জীবন বেছে নেয়। মাদক সেবনেই জীবনের সব সুখে খোঁজে। অতঃপর অনিবার্য অকালমৃত্যু।
এই ধরনের গণবিকারে যখন দেশ একেবারে রসাতলে, তখন প্রতিবাদে সোচ্চার হলো মার্কিন মুলুকের সচেতন মহল। সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, বিবেকবাদীরা উচ্চস্বরে প্রতিবাদ জানালেন শিশুদের নিয়ে এ ধরনের মরণখেলার বিরুদ্ধে। আদালতে উঠল মামলা। অবশেষে মার্কিন টেলিভিশন থেকে নির্বাসিত হলো মারডকীয় স্টার বানানোর এই মরণখেলা রিয়েলিটি শো। কিন্তু ততদিনে এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পুঁজি।
অকল্পনীয় লাভ এই মরণখেলা রিয়েলিটি শোতে। কী করে রক্ষা করা যাবে এই পুঁজি? সোজা বুদ্ধি বেরিয়ে এলো মিডিয়া সম্রাটদের উর্বর মগজ থেকে। অনুন্নত, গরিব দেশগুলোতে চালান করে দাও স্টার বানানোর এই মরণখেলা, রিয়েলিটি শো, ঢালো অঢেল অর্থ। কিন্তু ততদিনে দক্ষিণ আমেরিকায় নতুন জাগরণ ঘটছে। সুতরাং সেখানে খুব সফল হলো না তারা। দৃষ্টি পড়ল এশিয়ায়। প্রথমেই শতকোটি মানুষের দেশ ভারতবর্ষ। স্টার টিভির রমরমা ব্যবসা শুরু হলো ভারতে। মার্কিন মুলুক থেকে বিতাড়িত সব রিয়েলিটি শোর চালান এসে ভারতে পেঁৗছল। 'কৌন বনেগা ক্রোড়পতি'র পর্দায় হাজির স্বয়ং অমিতাভ বচ্চন, ভারতীয় যৌবনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী আইডল। মার্কিন মুলুকের সাফল্য ছাপিয়ে ভারত হয়ে গেল এই রিয়েলিটি শোর শ্রেষ্ঠ সংস্করণ। আর রোখে কে? হিন্দি ছাপিয়ে সারা ভারতে আঞ্চলিক ভাষায় চালু হয়ে গেল হাজার রঙের হাজার রিয়েলিটি শো। আর আজ যা ভারত করবে, কাল ঢাকাকে তা নকল করতেই হবে! সুতরাং নকলে ওস্তাদ ঢাকার টিভি চ্যানেলগুলোয় শুরু হয়ে গেল মার্কিন মুলুক থেকে বিতাড়িত রিয়েলিটি শোর নকলের এক হাস্যকর নকল। তারপর ফিল্ট্রেশন থিওরির অমোঘ নিয়মে তা প্রতিদিন অধিকার করে নিচ্ছে বাংলাদেশের তাবৎ সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে; হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির বিদায় ঘণ্টা বাজিয়ে।
কিন্তু তাতে কী? সে শোতে পাগল সারাদেশ। হারমোনিয়ামের রিডে আঙুল না পড়ূক, একটা শো অন্তত করতেই হবে। 'সোলো', 'ডুয়েল' যদি নাও হয়, অন্তত 'কোরাসে' গলা মিলাতে হবে। হোক না বৃন্দগান বা বৃন্দনাচ। তবু একবার মঞ্চে ওঠুক সোনার টুকরো ছেলেমেয়ে। একালের বাবা-মার একটাই স্বপ্ন, যেন একবার মঞ্চে নাচুক মেয়ে। না, কোনো চর্চা নয়, কোনো অপেক্ষা নয়। তার চাই হাতে হাতে ফল। শিল্প নামের নাচ-গান এভাবে মারডকীয় পুঁজির বন্যায় এ দেশীয় মুৎসুদ্দিদের হাতে বলি হচ্ছে প্রতিদিন। বলি হচ্ছে সোনার টুকরো শিশুরা। এই ইঁদুর দৌড়ে প্রতিভার যে অবচয় হয় তা পুনরুদ্ধারের কোনো বৈজ্ঞানিক উপায় মানুষ এখনও আবিষ্কার করেনি।
মার্কিন মুলুকের সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ সকলে তাদের শিশুদের রক্ষায় এগিয়ে এসেছিলেন। আমাদের দেশে সে দায়িত্ব কে পালন করবে? কে রক্ষা করবে আমাদের প্রতিশ্রুতিশীল শিশুদের মনোবৈকল্যের মতো সর্বনাশ থেকে? এখনও প্রতিবাদের আওয়াজ নেই কোথাও। অথচ কাউকে না কাউকে এই অমানবিক শিশু পীড়ন বন্ধে এগিয়ে আসতেই হবে। অন্যথায় আমরা এক মনোবিকারগ্রস্ত প্রজন্ম রেখে যাব।
শুদ্ধ শিল্পের সাধনাই হলো এই সর্বনাশ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়।

আমিরুল আলম খান : শিক্ষাবিদ ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.