মাছ ধরতে নৌপথ বন্ধ! by উজ্জ্বল মেহেদী ও সালেহ আহমদ

সুরমা নদীর ভাটির অংশের একটি শাখানদীর মুখে মাছ ধরার জন্য ‘পাটিবান’ দেওয়ায় সুনামগঞ্জের ধরমপাশা ও নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার মধ্যে সরাসরি নৌ-চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের দলীয় সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেনসহ প্রভাবশালী জলমহাল ব্যবসায়ীরা বাঁধ দেওয়ার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে সাংসদ দাবি করেছেন, তিনি এর সঙ্গে যুক্ত নন।


সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল, নদীর এপার থেকে ওপার অবধি বাঁশের আড়। আড়ের ফাঁক বন্ধ রাখতে সঙ্গে জাল ও বেতের পাটি পাতা। নদীর তলদেশ থেকে পানির তিন-চার ফুট ওপরেও জাল টানা। শুকনা মৌসুমে চিতল মাছ ধরার এই কৌশল স্থানীয়ভাবে পাটিবান নামে পরিচিত। এই বাঁধের কারণে সুরমা নদীতে চলাচলকারী যাত্রীবাহী লঞ্চসহ ছোট-বড় নৌযানকে এক কিলোমিটারের মতো ঘুরে চলাচল করতে হচ্ছে।
লঞ্চ ও ইঞ্জিনচালিত নৌচালকেরা জানান, শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় এই পথে এখন দুটি লঞ্চ চলাচল করে। সকালের পালায় একটি আর রাতে একটি। এ ছাড়া ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও বিভিন্ন মালবাহী নৌকা চলাচল করে। দিনের বেলায় বাঁধের একাংশ হাতে চালানো নৌকা চলার জন্য খুলে দেওয়া হয়।
সুরমা নদীর ভাটির অংশে দুটি শাখার একটি গিয়ে মিশেছে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের কংস নদের সঙ্গে। অপরটি সুনামগঞ্জের ধরমপাশার সুখাইড়-রাজাপুরের কাউনাই নদ হয়ে কালোপানিতে (নদীর একটি অংশ) গিয়ে মিশেছে। ‘কাউনাই-কালোপানি’ একটি জলমহাল। আয়তন ১৮৮ একর। হাওরের চিতল মাছের জন্য বিখ্যাত। চিতল আটকাতে জলমহাল সীমানার প্রায় এক কিলোমিটার দূরে নদীমুখে গত ডিসেম্বরে দেওয়া হয়েছে এই বাঁধ। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এটি থাকবে।
এলাকাবাসী জানান, সুনামগঞ্জ-মোহনগঞ্জ নৌপথের লঞ্চ শুষ্ক মৌসুমে ধরমপাশার দৌলতপুর পর্যন্ত পৌঁছায়। সুনামগঞ্জ থেকে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে যেতে কাউনাই-কালোপানি জলমহাল ও কংস নদ ব্যবহার করতে হয়। নদীর মুখে বাঁধ দেওয়ায় মোহনগঞ্জগামী নৌযানগুলো বাঁ দিকের বাঁক মাড়িয়ে অতিরিক্ত পথ ঘুরে গন্তব্যে যায়। একটি লঞ্চের সারেং নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নদীমুখে বাঁধ এবারই প্রথম দেখা গেছে। সেখানে কিছু লোক দাঁড়িয়ে থেকে সুনামগঞ্জের সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেনের নির্দেশনার কথা জানিয়ে নৌযানগুলোকে নদীর বাঁ দিকের বাঁক ঘুরে চলাচলে বাধ্য করছে।
মোহনগঞ্জের কংস নদ দিয়ে রাজাপুরের খেয়াঘাট এলাকায় গেলে সেখানকার বাসিন্দারা জানান, শুরুর দিকে স্থানীয় মৎস্যজীবীরা ক্ষুব্ধ হলে পাটিবানের পাশেই অস্থায়ী একটি স্থাপনা ও সশস্ত্র প্রহরা বসানো হয়। প্রবীণ এক মৎস্যজীবী জানান, জলমহাল ইজারাদারদের বন্দুকধারী পাহারার কারণে সাধারণ মৎস্যজীবীরা আতঙ্কিত।
সায়রাত জলমহাল কমিটি সূত্রে জানা যায়, জলমহালটি এই মৌসুমে ইজারাবহির্ভূত অবস্থায় আছে। তাই খাস-কালেকশনের মাধ্যমে ইজারা আদায় করা হচ্ছে। খাস-কালেকশনে রয়েছেন সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ধরমপাশা যুবলীগের একাংশের নেতা শামীম আহমেদ ওরফে মুরাদ।
মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে শামীম জানান, তাঁরা সাংসদসহ উপজেলা প্রশাসনকে জানিয়ে জলমহালের দায়িত্ব নিয়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আগে বিএনপির নেতারা রাজস্ব্ব না দিয়েই লুটপাট করে খেয়েছে। আমরা সরকারকে রাজস্ব দিচ্ছি।’
ধরমপাশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতের নির্দেশ থাকায় বেশ কিছুদিন আগে একটি মৎস্যজীবী সমিতির নামে জলমহালটি খাস-কালেকশনে দেওয়া হয়েছে। এতে কোনো অনিয়ম হয়নি।’ নদীপথ বন্ধ করা প্রসঙ্গে ইউএনও জানান, ‘ঘটনাটি এই প্রথম জানলাম।’
বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে জলমহালটির ইজারাদার ছিলেন ধরমপাশার বাসিন্দা ও সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সহসভাপতি আবদুল মোতালেব খান। তিনি জানান, এবার বাঁধ দিয়ে জলমহাল সীমানার বাইরেও চিতল মাছ ধরা হচ্ছে। এতে সব মিলিয়ে দুই-আড়াই কোটি টাকার মৎস্য আহরিত হবে। মোতালেব খান অভিযোগ করেন, ‘আওয়ামী লীগের সাংসদ ডিও লেটার দিয়ে জলমহালটি খাস-কালেকশনের নামে নিজের করে নিয়েছেন।’
সুনামগঞ্জ-১ (তাহিরপুর-জামালগঞ্জ-ধরমপাশা) আসনের সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নদীতে পাটিবান বলুন আর বাঁধ বলুন—কেউ যদি এমন কিছু দিয়ে থাকে, তাহলে আমার নাম ভাঙিয়ে দুর্নাম ছড়াচ্ছে। উপজেলা প্রশাসনকে পরিষ্কার বলে রেখেছি, জলমহাল নিয়ে যাঁরা ঝামেলা করে, তাঁরা আমার দলের হলেও যেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

No comments

Powered by Blogger.