অভ্রভেদী আমার দেশ by আতাউর রহমান

ডিসেম্বর মাসে আমার মনটা একদিকে যেমন খুশিতে ভরে ওঠে, তেমনি হৃদয়টা কেবলই কাঁদে। এই পরস্পরবিরোধী দুই অনুভব আমার নিজেকেই বিস্মিত করে। কী আর করা যাবে, স্ববিরোধিতা আমাদের জীবনেরই অংশ। হেমন্ত কাল প্রায় শেষ, শীত শুরু হবে, যদিও আমাদের দেশের শীতকাল অসহনীয় নয়।
ক’দিন পরই বছর শেষ হয়ে যাবে, নতুন বছর শুরু হবে আমাদের মনে সুন্দরের-কল্যাণের আশার অঙ্কুর নিয়ে। এই সময়টা ঘুরে বেড়ানোর সময়, পিঠা খাওয়ার সময়, ক’দিন পর নবান্ন উত্সবের পদধ্বনি শোনা যাবে। আমার বাল্য-কৈশোরের স্মৃতি এই সময়টাকে ভালো লাগার সময় করে তোলে। মন যেন আপন মনে গেয়ে ওঠে—‘হেমন্তে কোন্ বসন্তেরই বাণী পূর্ণশশী ওই যে দিল আনি\ ... ডাকছে থাকি থাকি ঘুমহারা কোন্ নাম-না জানা পাখি। কার মধুর স্মরণখানি পূর্ণশশী ওই যে দিল আনি।’ ক’দিন পর বড়দিনের উত্সব শুরু হবে। খ্রিস্টীয় সম্প্রদায়ের উত্সব হলেও এই উত্সব আমার ভেতরে একটা বোধের জন্ম দেয়, যা যুগপত্ আনন্দের ও বেদনার। মহান যিশুখ্রিস্ট জন্মগ্রহণ করেছিলেন ২৫ ডিসেম্বরে, তাই এই দিন আনন্দ-উত্সবের; কিন্তু পাশাপাশি যুবক যিশুর স্খলিত-মস্তক ক্রুশবিদ্ধ দেহখানির ছবি মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। তাকে জীবনের প্রান্তসীমায় পৌঁছানোর আগেই ক্রুশবিদ্ধ করে মেরে ফেলা হয়েছিল। তার অকাল মৃত্যুদণ্ডের জন্য কে বা কারা দায়ী, এ নিয়ে শতাব্দী ধরে নানা বিতর্ক চলে আসছে। বাইবেল বলে, ইহুদি নেতৃবৃন্দ তার মৃত্যুদণ্ড দাবি করেছিল এবং রোমানরা তাকে ক্রুশবিদ্ধ করেছিল। ২৫ ডিসেম্বর রাতে সব ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষ আনন্দ উত্সবে মেতে ওঠে। পুরনোকে ঘণ্টাধ্বনি বাজিয়ে যেমন বিদায় জানানো হয়, তেমনি নতুনকে অন্য এক ঘণ্টাধ্বনি বাজিয়ে স্বাগতম জানানো হয়। জীবনচক্রে এই দিনগুলো আমাদের জীবনে ঘুরেফিরে আসতে থাকে। আসলে গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা অর্থাত্ ইউরোপীয় পঞ্জিকা, যাকে আমরা ইংরেজি ক্যালেন্ডার হিসেবে গণ্য করি, সেই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মানুষের নিত্যকার জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয় যদিও অনেক জাতির নিজস্ব নববর্ষ আছে, যেমন আমাদের আছে বাংলা নববর্ষ। ডিসেম্বর আমাদের জন্য বিশেষ আনন্দের মাস, কারণ ১৯৭১ সালের ১৬ তারিখে আমরা পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক প্রভুদের সম্পূর্ণ পরাভূত করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঘোষিত স্বাধীনতাকে বাস্তবায়িত করি। ১৬ ডিসেম্বরে আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিকত্ব অর্জন করি। তার জন্য আমাদের বিরাট মূল্য দিতে হয়েছিল। বোধ হয় ইহুদিরাও তাদের আকাঙ্ক্ষিত দেশে (তথাকথিত ল্যান্ড অব প্রমিজ) ফিরে যাওয়ার সংগ্রামে এত বড় মূল্য দেয়নি। আমার চোখের সামনে একের পর এক ১৯৭১-এর দুঃখ-চিত্রগুলো সার বেঁধে চলতে শুরু করে এবং আমাকে ম্রিয়মাণ করে দেয়। আমার এই সময়ের সুখকে অনেকটা যেন কেড়ে নেয়। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে জীবন পণ করেছিল, দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিল, আমরা কীভাবে ৯ মাস জ্বলন্ত নরকে জীবন-যাপন করেছি—সে কথা আজকের প্রজন্মকে হাজারো বক্তৃতা দিয়ে বোঝাতে পারব না। আমাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ হতে চায় না। আজকে পেছনের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, ১৯৭১-এ স্বর্গীয় এক স্পর্শে আমরা জীবন পণ করে জেগে উঠেছিলাম; আমাদের নেতা ছিল, নেতৃবৃন্দ ছিল, আমাদের জনগণ সংঘবদ্ধ ছিল, এরপর ধীরে ধীরে আমরা সব হারাতে শুরু করলাম। স্বাধীনতা আমরা অর্জন করলাম ঠিকই, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ আমাদের মাঝে শীর্ণ থেকে শীর্ণতর হতে লাগল। আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে ঠকিয়েছি, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আমরা তাদের সামনে সত্যিকার অর্থে কোনো আদর্শের ঝাণ্ডা ওড়াতে পারিনি। আমরা প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে এই ৩৮ বছর সময়ের চক্রে নিজেদের যেমন ঠকিয়েছি, তেমনি অন্যকেও ঠকিয়েছি। আমরা প্রায় কেউই দেশের ও দশের কাছে শুদ্ধ ও সত্যনিষ্ঠ মানুষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমরা আজও করতে পারিনি। মনে হয় কোনো অদৃশ্য শক্তির মানা আছে। আমরা নিজেদেরও বিশ্বাস করতে ভুলে গেছি। মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ, মনে হয় আমরা সেই পাপে বিদ্ধ হয়ে আছি। এই মাস এলে মনে হয় আমি ৩০ লাখ মৃতের মিছিলে দাঁড়িয়ে আছি, লাঞ্ছিত-নিপীড়িত মা-বোনদের ধিক্কারে জর্জরিত হচ্ছি, আমি হৃদয়ের ভেতরে কেঁদে ওঠি কিন্তু কিছুই করতে পারি না। এত কিছুর পরও আমার এবং আমাদের সুখের অন্ত নেই, কারণ আমি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক, যে দেশ একান্তভাবে আমার দেশ, যে দেশকে নিয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি স্বপ্ন দেখব। হয়তো এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে দেখব বাংলাদেশের মাথা অভ্রভেদী হয়ে সদম্ভে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা সবাই তখন বলতে পারব—দেখ, দেখ, আমাদের দেশকে দেখ!
এই যে নিজের দেশে নিজের মতো করে বেঁচেবর্তে আছি, সেটাই মনের দীনতা অনেকখানি কাটিয়ে দেয়। আমাদের মেধা আছে, কায়িক শ্রম দেয়ার মতো শক্তি আছে, আমাদের দেশে প্রজ্ঞাবান ও সত্যনিষ্ঠ মানুষও বিরল নয়। তাই মনে হয় ফিনিক্স পাখির মতো আমরাও একদিন ছাই-ভস্মের ভেতর থেকে নীল আকাশে উড্ডীন হব। পৃথিবীর পরিবর্তনশীল পরিবেশ সারা বিশ্ববাসীকে অস্তিত্বের সঙ্কটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে, আমরা এই সঙ্কটে পতিত হওয়ার অগ্রভাগে আছি। হয়তো কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকার জনগণ জীবন সঙ্কটের মধ্যে পড়বে। এ নিয়ে দেশের সরকার চিন্তিত, তেমনি জনগণ ভাবনায় ভারাক্রান্ত। তবুও কবি রবার্ট ফ্রস্টের কাব্যাংশ পড়ে জীবনকে উদ্যাপিত করতে ইচ্ছে করে—
“The woods are lovely, dark and deep But I have promises to keep and miles to go before I sleep ...”
লেখক : অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক

No comments

Powered by Blogger.