গণতন্ত্রবিরোধী এখতিয়ার অর্জনের চেষ্টা ইনডেমনিটি by মোহাম্মদ মতিন উদ্দিন

ম্প্রতি ‘ইনডেমনিটি চায় নির্বাচন কমিশন’ এই শিরোনামে একটি সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ২ ডিসেম্বর, ২০০৯-এ। সাংবাদিক এম আবদুল্লাহ এ সংবাদ পরিবেশন করেছেন। এই সংবাদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের কোনো সিদ্ধান্ত আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না, এমন আইন করার প্রস্তাব দিয়েছে ইসি।
এই ইনডেমনিটি প্রস্তাব সাধারণ আইনে নয়, সংবিধান সংশোধন করে করতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভালো-মন্দ যে সিদ্ধান্তই কমিশন নিক না কেন এটা বাংলাদেশের কোনো আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে না পারা ইনডেমনিটির পর্যায়েই পড়ে। নির্বাচন কমিশন মনে করছে, এই বিধান করা হলেই কমিশন শক্তিশালী হবে; নিশ্চিত হবে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এছাড়া নির্বাচন সংক্রান্ত মামলা ৬ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির বাধ্যবাধকতা আরোপেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। ইসি সচিবালয় সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।’
সূত্র জানায়, ‘নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে মনে করছে ইসি। বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যে ইসি সংশ্লিষ্ট সাংবিধানিক বিধান এবং অন্যান্য আইনে সংস্কারের কিছু প্রস্তাব তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কমিশনের ওপর নির্ভর করা যাবে বলেও মনে করছে বর্তমান ইসি। ইসি প্রণীত প্রস্তাবের অন্যতম হচ্ছে—অন্তত নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত কমিশনের কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেউ মামলা রুজু করতে পারবে না, এমন বিধান সংবিধানে সংযোজন।’
নির্বাচন কমিশনের এ প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় ৪ ডিসেম্বর, ২০০৯ আমার দেশ পত্রিকায় সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ইসি যে মূল প্রস্তাবটি করেছে সেটা নিয়ে বিতর্ক উঠতে বাধ্য। ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরুর সময় থেকে অন্তত এ প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত ইসির কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেউ আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবে না। সংবিধান সংশোধন করে এ বিধান প্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর অর্থ হলো—ইসি যদি কোনো ভুল সিদ্ধান্তও নেয়, তবে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আদালতে তা চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। এক কথায় ওই সময়ের জন্য ইসি থাকবে আইনের ঊর্ধ্বে। এটা একটা ভয়ঙ্কর আবদার। দেশে আইনের শাসন বলবত থাকা অবস্থায় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না। এমনকি কিছু সময়ের জন্যও নয়।’ নির্বাচন হচ্ছে একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করা—এটাই সাধারণ অর্থে বোঝানো হয়। এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নিশ্চিত করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা অভিজ্ঞতার আলোকে এর ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করার জন্য নীতি-নির্ধারণী কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে বিবেচনা করে প্রস্তাবগুলোকে নির্বাচনী আইনে পরিণত করার জন্য। এটা অন্যায় কিছু নয়, কিন্তু যখন শুনি নির্বাচন কমিশন কিছু সময়ের জন্য আইনের ঊর্ধ্বে উঠতে চায় তখন এ প্রস্তাবকারী নির্বাচন কমিশনের গণতান্ত্রিক চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠাটাই স্বাভাবিক। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অতীত কিছু কার্যকলাপ যাদের মনে আছে তারা এটা অবশ্যই জানেন যে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র গণতান্ত্রিক করে তোলার জন্য বর্তমান ইসি নানা ধরনের সবক দিয়েছেন, সেই ইসি যখন সংবিধান সংশোধন করে কিছু সময়ের জন্য আইনের ঊর্ধ্বে উঠতে চায় তখন প্রশ্ন জাগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রকে গণতান্ত্রিক করার জন্য ইসির প্রচেষ্টার মধ্যে আদৌ কোনো গণতান্ত্রিক মন-মানসিকতা ছিল কিনা! মনের ভেতরে আইনের ঊর্ধ্বে ওঠার মানসিকতা প্রমাণ করে এ মানসিকতা গণতান্ত্রিক নয়; বরং অন্য কিছু। এই অন্য কিছুটা যে কী সেটা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল কিছুটা হলেও তুলে ধরেছেন কিছুদিন আগে, এটা নিশ্চয় অনেকের স্মরণে আছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহণের জন্য বিভিন্ন ধরনের সমঝোতার বিষয়টি আবদুল জলিল ফাঁস করে দেয়ায় তাকে নিগৃহীত হতে হয়েছে—এটাও আমরা জানি। যে ধরনের সমঝোতাকে কেন্দ্র করে বর্তমান রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে হয়তোবা তারাই ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন প্রশ্নে কিছু সময়ের জন্য আইনের ঊর্ধ্বে থাকা ইসির প্রয়োজন বিধায় তাদের এই নতুন প্রস্তাবনা। আগামী দিনগুলোতে সেটা পরিষ্কার হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশের সংবিধান মতে, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব সম্পর্কে সংবিধানের ১১৯নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ১. রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকিবে এবং নির্বাচন কমিশন এই সংবিধান ও আইনানুযায়ী
(ক) রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন;
(খ) সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন;
(গ) সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করিবেন;
এবং (ঘ) রাষ্ট্রপতির পদের এবং সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুত করিবেন।
২. উপরিউক্ত দফাসমূহের নির্ধারিত দায়িত্বসমূহের অতিরিক্ত যেরূপ দায়িত্ব এই সংবিধান বা অন্য কোন আইনের দ্বারা নির্ধারিত হইবে, নির্বাচন কমিশন সেই রূপ দায়িত্ব পালন করিবেন।
নির্বাচন সম্পর্কে সংসদের বিধান প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সংবিধানে। এ বিষয়ে সংবিধানের ১২৪নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এই সংবিধানের বিধানাবলীসাপেক্ষে সংসদ আইনের দ্বারা নির্বাচনী এলাকার সীমা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ, নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং সংসদের যথাযথ গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য বিষয়সহ সংসদের নির্বাচন সংক্রান্ত বা নির্বাচনের সহিত সম্পর্কিত সকল বিষয়ে বিধান প্রণয়ন করিতে পারিবেন।
বাংলাদেশের সংবিধানে নির্বাচন কমিশনের কার্যকলাপ কী হবে তা নির্ধারণ করার এখতিয়ার দেয়া হয়েছে জাতীয় সংসদকে। জাতীয় সংসদ প্রণীত বিধান মান্য করে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয় বা আইনের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গঠিত নির্বাচন কমিশন তার এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রের গণতন্ত্রায়নের প্রশ্নে হাত দিয়েছেন। অর্থাত্ নির্বাচন কমিশনের মধ্যে সাংবিধানিক নীতি-কাঠামোর বাইরে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রবণতা লক্ষণীয়। গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে এরকমটি না হওয়ারই কথা। এই যখন অবস্থা তখন কিছু সময়ের জন্য নির্বাচন কমিশনকে ইনডেমনিটি দিলে তার পরিণাম যে ভালো হবে না এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। অর্থাত্ ইনডেমনিটি দিলে বিষয়টি দাঁড়াবে এরকম যে, নির্বাচন কমিশনের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপকে বৈধতাদান করা হবে মুখ্য প্রবণতা। গণতন্ত্রের নামে বা নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার দোহাই দিয়ে কিছু সময়ের জন্য দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপকেই উত্সাহিত করবে, যা আমাদের কারোরই কাম্য নয়। সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় সম্পর্কে সংবিধানের ১২৩নং অনুচ্ছেদের ৩নং দফায় বলা আছে, মেয়াদ অবসানের কারণে অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই সাংবিধানিক বিধি মেনে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ছিল কিন্তু সেটা হয়নি। যখন তা হলো না তখন বিদ্যমান নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল পদত্যাগ করা। কিন্তু সেটাও তারা করেননি। এটা গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানসিকতার পরিচয় নয়। এই মানসিকতাপুষ্ট নির্বাচন কমিশন যখন কিছু সময়ের জন্য ইনডেমনিটি চায় তখন বুঝতে হবে এর মধ্যে নতুন কোনো পরিকল্পনা লুকিয়ে আছে, যে পরিকল্পনা জাতির ভাগ্যকে আরও কণ্টকিত করবে।
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত যে ইতিহাস আমরা দেখেছি সেখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের গণবিরোধী কার্যকলাপকে জবাবদিহিতার দায় থেকে মুক্তি দেয়ার লক্ষ্যেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয়ে জড়িত কার্যক্রমকে দায়মুক্তি দিয়েছে। এর প্রথম শুরুটা হয়েছে ১৯৭৪ সালে। সে সময় গঠিত রক্ষীবাহিনীর কার্যকলাপকে বৈধতাদানের জন্য দায়মুক্তি দেয়া হয়। অথচ এই রক্ষীবাহিনী এদেশে বহু রাজনৈতিক কর্মীকে বিনা বিচারে হত্যা করেছে। এসব হত্যাকাণ্ডকে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে রাখার জন্য দায়মুক্তি দেয়া হয়। এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ও অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডকে দায়মুক্তি দেয়া হয়। এখন চলছে র্যাব-পুলিশ কর্তৃক বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। আগামীতে হয়তো দেখা যাবে এসব হত্যাকাণ্ডকেও দায়মুক্তি দেয়া হবে। এদেশে আইনের শাসন দ্বিখণ্ডিত। হত্যাকাণ্ড সেটা যেভাবেই সংঘটিত হয়ে থাক না কেন তাকে বিচারের আওতায় আনা দরকার। কোনো হত্যাকাণ্ডের বিচার করা, আবার কোনো হত্যাকাণ্ডকে দায়মুক্তি দেয়া গণতন্ত্র নয় বা আইনের শাসন নয়। বলা হয় আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। যদি তাই হয় তবে সব হত্যাকাণ্ডের বিচার করাটাই হচ্ছে যথাযথ। কোনো ক্ষেত্রে বিচার, কোনো ক্ষেত্রে দায়মুক্তি প্রমাণ করে আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ক্ষমতা গণতান্ত্রিক নয়, এরা শুধু নিজেরটা বোঝে, অন্যেরটা বোঝে না। রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের এই চেহারা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক নয়। এসব দেখে নির্বাচন কমিশনও হয়তোবা ভাবছে তাদের মনের লুকানো খায়েস মেটানোর জন্য দায়মুক্তি নেয়াটা প্রয়োজন। তাদের মনের লুকানো খায়েস হয়তোবা হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার জন্য নয়, তবে তা যে জনস্বার্থের পরিপন্থী হবে এ বিষয়টা অনুমান করা মনে হয় অযাচিত হবে না।
বিদেশী পরাশক্তিগুলোর স্বার্থের প্রশ্নে এদেশের রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অনুগত করার অভিপ্রায় থেকেই ১/১১-এর জন্ম। এ বিষয়ে আগে হয়তোবা কারও দ্বিমত ছিল কিন্তু এখন বিষয়টা অনেকটাই পরিষ্কার। এই ১/১১-এর ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখার প্রয়োজনে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সমঝোতা, তারপর ক্ষমতার পটপরিবর্তন, সাংবিধানিক ধারা লঙ্ঘন করে নেয়া নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্তগুলার অধিকাংশকে বৈধতাদান, নির্বাচনী ইশতেহার ভঙ্গ করে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করার নানামুখী প্রচেষ্টা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার প্রশ্নে পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে সমঝোতামাফিক কার্যকলাপ চালানো থেকে প্রমাণ হয়, এখনও আমরা ১/১১-এর ধারাবাহিকতা থেকে মুক্ত নই। ভবিষ্যতে এই ধারাবাহিকতা যাতে করে অক্ষুণ্ন থাকে সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে এখন চলছে নানামুখী কার্যকলাপ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পরাশক্তিগুলোর স্বার্থের প্রশ্নে অনুগত থাকতে অঙ্গীকারবদ্ধ রাজনৈতিক নেতৃত্বের চলার পথকে মসৃণ করার জন্য এই কার্যকলাপ। অনেকে বলে থাকেন, এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে তছনছ করে ফেলার জন্য বিডিআর সদর দফতরে গত ফেব্রুয়ারি মাসে সংঘটিত ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এরপরও যদি পরাশক্তিগুলোর অনুগত হওয়ার প্রশ্নে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে তবে বিডিআর সদর দফতরে সংঘটিত ঘটনার অনুরূপ ঘটনা ঘটানোর প্রচেষ্টা এ দেশে চলবে আগামীতেও। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিষয়টিকে দুর্বল করে, রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে বিভেদের বীজ ছড়িয়ে দিয়ে গোটা জাতিকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে, প্রয়োজনে সশস্ত্র সংঘাত উস্কে দেয়ার মাধ্যমে জাতি-রাষ্ট্রকে নেতৃত্বহীন করার একটা পরিকল্পনা পরাশক্তিগুলোর মধ্যে থাকার সম্ভাবনাই বেশি। ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন জঙ্গি জঙ্গি বলে চিত্কার করে, সন্ত্রাসীদের তত্পরতা বেড়েই চলেছে বলে প্রচার করতে থাকে, তখন মনে সন্দেহ জাগে হয়তোবা সামনে আরও একটা অঘটন ঘটার সম্ভাবনা নিকটস্থ হচ্ছে, যার দায়ভার চাপানো হবে তাদের ওপর যাদের বিষয়ে তারা চিত্কার করছে।
এ ধরনের এক অবস্থার মাঝে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত ইনডেমনিটি মনের সন্দেহকে আরও প্রকট করে তুলছে। হয়তোবা নতুন করে কোনো নির্বাচনের মাধ্যমে ১/১১-এর ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম রাজনৈতিক নেতৃত্বকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসানোর লক্ষ্যেই এই প্রস্তাবনা। এই ক্ষেত্রে ইনডেমনিটি কার্যকর হলে পরাশক্তিগুলোর স্বার্থে নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ক্ষমতায় বসিয়ে, জনমনে সঞ্চারিত প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে অর্থাত্ নির্বাচন কমিশনের অগণতান্ত্রিক কাজকে বৈধতা দেয়ার প্রশ্নে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। এ কারণেই বলছি, ইনডেমনিটি হচ্ছে অগণতান্ত্রিক কাজকে বৈধতাদানের একটি মোক্ষম হাতিয়ার। গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তার কার্যকলাপের প্রশ্নে ইনডেমনিটি চাওয়াটা মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়। কেননা, গণতন্ত্রের প্রশ্নটি জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয়।

No comments

Powered by Blogger.