বিএনপির কাউন্সিল ও ভবিষ্যত্ রাজনীতি by ড. তারেক শামসুর রেহমান

বিএনপির কাউন্সিল শেষ হয়েছে গত ৮ ডিসেম্বর। দীর্ঘ ১৬ বছর পর এ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হলো। ‘এক-এগারো’র ঘটনা এবং গেল বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদের নির্বাচনে দলের পরাজয়ের পর দলের নেতা ও কর্মীদের মাঝে যে হতাশা নেমে এসেছিল, কাউন্সিলে জেলা পর্যায়ের নেতাদের উপস্থিতি ও প্রাণচাঞ্চল্য প্রমাণ করে সেই হতাশা থেকে বেড়িয়ে আসতে পেরেছে বিএনপি।
উপরন্তু কাউন্সিলে বেগম জিয়ার বক্তব্য ও সেই সঙ্গে বিএনপির ভবিষ্যত্ নেতা তারেক রহমানের আবেগময় বক্তব্য দলটির লাখ লাখ নেতা ও কর্মীদের উজ্জীবিত করেছে বলেই আমার ধারণা। তারেক রহমান দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। কাউন্সিলররা সর্বসম্মতিক্রমে তাকে নির্বাচিত করেছেন। এর মধ্য দিয়েই দল তার ভবিষ্যত্ নেতাকে নির্বাচিত করল। এ নিয়ে কারও কোনো দ্বিমত থাকার কথা নয়। কেননা গণতান্ত্রিকভাবেই তিনি নির্বাচিত এবং দলই তার নেতাকে বেছে নিয়েছে। ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়নি। কাউন্সিলরদের উদ্দেশে তারেক রহমান যে ভাষণ দিয়েছেন, তাও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, তিনি বিদেশে আত্মবিশ্লেষণ ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি অসুস্থ। পুরোপুরি সুস্থ, তা বলা যাবে না। তিনি জানিয়েছেন, সুস্থতার ওপর নির্ভর করছে তার দেশে ফেরা। তার এই বক্তব্যকে আমি স্বাগত জানাই। তিনি ইচ্ছে করলে এখনই দেশে ফিরে আসতে পারতেন। দলীয় কর্মীরা সম্ভবত সেটাই চাইছিলেন। কিন্তু আবেগ আর রাজনীতি এক কথা নয়। আবেগ দিয়ে রাজনীতি হয় না। তার ফিরে আসা কর্মীদের উদ্দীপ্ত করত সন্দেহ নেই। কিন্তু ‘রাজনৈতিক জটিলতা’ এতে করে আরও বাড়ত। মনে রাখতে হবে, তার বিরুদ্ধে এখনও ১৩টি মামলা রয়েছে। এ মামলার জালে পড়ে তিনি আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারেন। এর চেয়েও বড় কথা, বিএনপির মতো একটি বড় দলের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য যে সুস্থতা দরকার, তিনি ঠিক ততটুকু সুস্থ নন। আইন বিষয়ে পড়াশোনার আগ্রহ তিনি দেখিয়েছিলেন। এ কাজটি যদি তিনি করতে পারেন, তাহলে তিনি ভালো করবেন। তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠুন এবং দলকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য প্রস্তুত হন—এখানেই বোধকরি তার মঙ্গল নিহিত।
পারিবারিকভাবে তিনি রাজনীতিতে এসেছেন, এটা অস্বীকার করা যাবে না। যার বাবা এ দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন, যা মা তিন-তিনবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তিনি যে রাজনীতি করবেন—এটাই স্বাভাবিক। এর মাঝে কোনো ‘অন্যায়’ নেই। আমি এ উপমহাদেশ নয়, বরং ইউরোপের দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখাতে পারব, সেখানেও উত্তরাধিকারের রাজনীতি বহমান। গত ৬ অক্টোবর গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন জর্জ পাপান্ড্রু। বিদেশে পড়াশোনা ও বড় হয়ে ওঠা জর্জ পাপান্ড্রুর বাবা আন্দ্রেয়াস পাপান্ড্রু ও দাদা জর্জ পাপান্ড্রুও (সিনিয়র) গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। মজার ব্যাপার, নির্বাচনে তিনি যাকে পরাজিত করলেন (কসটাস শারমানলিস), তিনি নিজে ও তার বাবাও গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। মেসিডোনিয়ার নিকোলা গ্রুয়েভস্কি, কসোভোর হাসিম থাচি, হাঙ্গেরির গর্ডন বাজগাই, লিচেনস্টাইনের ক্লাউস সুষ্ঠার উত্তরাধিকারের রাজনীতির জ্বলন্ত প্রমাণ। আফ্রিকাতেও আছে—মাদাগাস্কারের আন্দ্রে রাজালিনা, গ্যাবগেরর আলী বঙ্গো কিংবা কঙ্গোতে যোসেফ কাবিলা। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কায়, ভারতে, পাকিস্তানে ও নেপালে এই উত্তরাধিকারের রাজনীতি নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন করে না। সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে এমনটি সাধারণত হয় না। কিন্তু উত্তর কোরিয়ায় কিম উল সুংয়ের ছেলে কিম জং ইল রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছিলেন। এখন কিম জং ইলের ছেলে কিম জং উনকে ‘ভবিষ্যত্ নেতা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও মাওবাদী নেতা প্রচন্ডের মেয়েও সেদেশের অন্তর্বর্তী পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সুতরাং আজ যখন তারেক রহমানকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়, আমি তাতে অবাক হই না। এটাই স্বাভাবিক। তিনি কতটুকু যোগ্য, সে প্রশ্ন ভিন্ন। বিরোধীরা সে প্রশ্ন তুলতেই পারে। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচন পরিচালনা করে তিনি প্রমাণ করেছিলেন, সংগঠন পরিচালনা করার যোগ্যতা তার রয়েছে। বাবার কিছু গুণ তিনি পেয়েছিলেন—এটা স্বীকার করতেই হবে। বাবার মতোই তিনি গ্রামে গ্রামে হাঁটতে শুরু করেছিলেন। জানতে চেষ্টা করেছিলেন গ্রামের মানুষের সমস্যা কোথায়। কী করে সেই সমস্যা থেকে মানুষদের বের করে আনা যায়—এটা তিনি বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন, যেমনটি করতেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তার ‘এপ্রোচ’ সঠিক ছিল। তবে তার সঙ্গে যারা ছিলেন তাদের কেউ কেউ বাড়াবাড়ি করে থাকতে পারে। সে কথা তিনি পরোক্ষভাবে স্বীকারও করেছেন (আমার দেশ, ৬ ডিসেম্বর)। এখন অতীত থেকে তিনি শিক্ষা নেবেন বলেই আমার বিশ্বাস। বিএনপির লাখ লাখ তরুণ তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের তিনি আশাহত করতে পারেন না। আত্মসমালোচনা ও আত্মবিশ্লেষণের কথা তিনি বলেছেন। ৫৫৪ দিনের কারাবাস আর অকথ্য নির্যাতন তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। এই আত্মবিশ্লেষণ আর শেখার মধ্য দিয়ে তিনি একজন সাচ্চা নেতায় পরিণত হবেন বলেই আমার ধারণা। এখন ইতিহাসই বিচার করবে এই প্রত্যাশা তিনি কতটুকু পূরণ করতে পারবেন।
বিএনপির পঞ্চম কাউন্সিলে দলের গঠনতন্ত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা আমার কাছে খুব অযৌক্তিক মনে হয়নি। একজন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টিসহ স্থায়ী কমিটির সদস্য সংখ্যা ১৫ থেকে বাড়িয়ে ১৯ করা হয়েছে। নির্বাহী কমিটিতে কর্মকর্তার সংখ্যা ১১৩-তে উন্নীত করা হয়েছে। বিভিন্ন স্তরের কমিটির কলেবর বাড়ানো হয়েছে। এক নেতা এক পদ করার সংশোধনীও পাস হয়েছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ যা, তা হচ্ছে কাউন্সিল সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এসব পদে কারা কারা থাকবেন, সে ব্যাপারে বেগম জিয়া এককভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন। এতে করে নিন্দুকরা নানা কথা বলতে পারে। কিন্তু এটা বুঝতে হবে, কাউন্সিলে ভোটাভুটিতে গিয়ে দলকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে না দিয়ে দলীয় চেয়ারপারসনের হাতে সিদ্ধান্তটি ছেড়ে দেয়াই মঙ্গল। তিনি নিশ্চয়ই দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে দলের মহাসচিব থেকে শুরু করে স্থায়ী কমিটিসহ বিভিন্ন কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা করবেন। এ ক্ষেত্রে দলের দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে নির্বাচিত তারেক রহমানের পরামর্শ নেয়াও প্রয়োজন। স্থায়ী কমিটি দলের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। অতীতে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে নানা কথা বাজারে চালু রয়েছে। নানা জটিলতায় স্থায়ী কমিটিতে যেসব পদ খালি ছিল, তা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। এটা বলতেই হবে, যারা দলের জন্য অবিরাম কাজ করে গেছেন, দলের সঙ্কটে রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এবং সাহসী, তারা স্থায়ী কমিটিতে ছিলেন না। আগামী দিনগুলোর কথা বিবেচনা করে যোগ্য, মেধাসম্পন্ন রাজনীতিকদের স্থায়ী কমিটির সদস্যপদ দেয়া উচিত। দলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে একটি উপদেষ্টা কমিটি, একটি অর্থনীতিবিষয়ক কমিটি ও একটি আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটি থাকা উচিত। আমি ইউরোপে দেখেছি, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের এ ধরনের বিশেষজ্ঞ কমিটি থাকে। সাধারণত কোনো রাজনীতিক এসব কমিটিতে থাকেন না। এখানে থাকেন শুধু বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা দেশের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নীতি প্রণয়ন করবেন; স্থায়ী কমিটিতে সেই নীতি আলোচিত হবে এবং স্থায়ী কমিটি সেই নীতি চূড়ান্ত করবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অর্থনীতিবিষয়ক কমিটি ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটিকে আমি গুরুত্ব দিতে চাই। অর্থনীতিবিষয়ক কমিটি অর্থনীতির গতিধারা নির্ণয় করবে, জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন করবে এবং কৃষির সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে দলীয় চেয়ারম্যান তথা স্থায়ী কমিটির কাছে সুপারিশ করবে। একই সঙ্গে পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটি কাজ করবে বৈদেশিক নীতি তথা নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে। প্রয়োজনে দলের চেয়ারম্যান স্থায়ী কমিটির দু’জন সদস্যকে এই দুটো কমিটির আহ্বায়ক করে দিতে পারেন, যাদের নেতৃত্বে কমিটি কাজ করবে। মনে রাখতে হবে, আগামী দিনের রাজনীতি হবে তথ্যনির্ভর। তথ্য ও উপাত্তসহ নীতি প্রণয়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে গবেষক ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হলে তথ্য ও উপাত্ত দিয়েই ঘায়েল করতে হবে।
বেগম জিয়া কাউন্সিলের আগেই দলীয় চেয়ারপারসন হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এটি ছিল স্বাভাবিক একটি ঘটনা। চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে—এটা কাম্য ছিল না। বেগম জিয়ার দায়িত্ব এখন অনেক বেশি। লাখ লাখ কর্মীর মনোবল চাঙ্গা করা, যারা নির্বাচনে বিএনপি হেরে যাওয়ার পর এখন কিছুটা হতাশ। এরকম হয়। এটা অমূলক নয়। ভারতে কংগ্রেস অবিসংবাদিত শক্তি। যে কংগ্রেস এক সময় ৩৬৪টি (মোট আসন ৫৪৫) আসন পেয়েছে (১৯৫২), সেই দলটির আসনসংখ্যাও ১১৯-এ নেমে এসেছিল (১৯৯১)। ১৯৭৭ সালে মাত্র ১৫৪টি আসন পেয়ে কংগ্রেস ক্ষমতা হারিয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধীর দৃঢ়চেতা মনোভাব ও সঠিক রাজনীতি কংগ্রেসকে ১৯৮০ সালে ক্ষমতায় (আসন ৩৫৩) ফিরিয়ে এনেছিল। আর রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস ৪১৫টি আসন পেয়েছিল ১৯৮৪ সালে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে এরকমটি হয়। পাকিস্তানে বারবার ক্ষমতা বদল হয়েছে দুটি দলের মাঝে, পিপলস পার্টি ও মুসলিম লীগ (নেওয়াজ) দু-দু’বার সরকার গঠন করেছিল (বেনজিরের নেতৃত্বে ১৯৮৮ ও ১৯৯৩, আর নেওয়াজ শরীফের নেতৃত্বে ১৯৯০ ও ১৯৯৭ সালে)। যদিও কোনো সরকারই স্থায়িত্ব পায়নি—সেটা ভিন্ন এক প্রসঙ্গ। বর্তমান প্রেক্ষাপটেও এই দল দুটো আবার মূল ধারায় ফিরে এসেছে। শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও রাজনীতি দুটি বড় দল শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি ও ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টিকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। বাংলাদেশের অবস্থায়ও অনেকটা তেমনি। বাংলাদেশেও একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠন করেছে। এই সরকার ক্ষমতায় থাকবে ২০১৪ সাল পর্যন্ত। সময়টা দীর্ঘ। এই দীর্ঘ সময়ে বিএনপি কীভাবে তার রাজনীতি পরিচালনা করে, কীভাবে এবং কোন রাজনীতি নিয়ে তার অবস্থান ধরে রাখে, সেটাই দেখার বিষয় অনেকের। গণতন্ত্রের স্বার্থেই শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা দরকার। সংসদে বিএনপির অবস্থান শক্তিশালী নয় বটে, কিন্তু সাধারণ মানুষের মাঝে তাদের সমর্থকদের সংখ্যা একেবারে কম নয়। তাদের আশ্বস্ত করা ও সঠিক পথে বিএনপিকে নেতৃত্ব দেয়ার দুরূহ কাজটি করতে হবে এখন বেগম জিয়াকে। একজন সাধারণ গৃহবধূ ছিলেন তিনি। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুই তাকে রাজনীতিতে টেনে নিয়ে আসে। ১৯৮৪ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই থেকে যাত্রা শুরু। গত ২৬ বছরে তাকে এক অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করেছে। বিগত সময়ে সরকার পরিচালনায় তিনি কোনো ভুল করেননি—এ কথা তিনি কখনও বলেননি। বরং ভুলের জন্য জাতির কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন। এটাই সঠিক রাজনীতি। তবে ১৯৮৪ আর ২০১০ এক নয়। বয়স বেড়েছে। ২০১৪ সালে তার বয়স গিয়ে দাঁড়াবে সত্তরে। এ বয়সে বাংলাদেশের মতো দেশে রাজনীতি করা খুব সহজ কাজ নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচন প্রমাণ করেছে, এ দেশের মানুষ পরিবারতন্ত্রেই বিশ্বাস করে ও তাদের ওপর আস্থা রাখে। ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলায় দুই নেত্রীকে বাদ দিয়ে একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির বলয় সৃষ্টি করার প্রয়াস নেয়া হয়েছিল। এটা মিথ্যা ও ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। মানুষ এখনও এই দুই নেত্রীর ওপর আস্থাশীল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এই দুই পরিবার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, এটা বাদ দেয়া যাবে না। বেগম জিয়াকে তাই ভাবতে হয়েছে আগামী নেতৃত্বের কথা। ঠিক সিদ্ধান্তই তিনি নিয়েছেন পঞ্চম কাউন্সিলে। জিয়া পরিবারের উত্তরসূরি হিসেবে তারেক রহমান এখন বিএনপির হাল ধরবেন। সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নিযুক্ত করার মধ্য দিয়ে তাকে দলের শীর্ষ নেতৃত্বে নিয়ে আসা হলো। ভারতে রাহুল গান্ধী এভাবেই তৈরি হচ্ছেন। কিন্তু সরকারি দলের সিনিয়র নেতারা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তা আমার কাছে শোভন মনে হয়নি। তারা আরও উদার হতে পারতেন। প্রতিহিংসার রাজনীতির বেড়াজাল থেকে আওয়ামী লীগের নেতারা বেরিয়ে আসতে পারলে এ দেশে যে সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম হতো, তা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকতে পারত। দুঃখ এটাই—এই সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারছি না। তারেক রহমান ৪৬ বছর বয়সে একটি কঠিন দায়িত্ব পেয়েছেন। নেতৃত্বের জন্য এ বয়সটিই সঠিক। ওবামা এ বয়সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। কেনেডি প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন আরও কম বয়সে। ৩৫ থেকে ৩৬ বছর বয়সে বেনজির ভুট্টো পাকিস্তানের মতো একটি রক্ষণশীল মুসলিম দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সুতরাং বয়স কোনো ফ্যাক্টর নয়। বিএনপির পঞ্চম কাউন্সিল বিএনপির ভবিষ্যত্ নেতা নির্ধারণ করেছে। লাখ লাখ মানুষ সেই মানুষটির দিকে যে তাকিয়ে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তাকে নিয়ে অনেক রটনা হয়েছে। মধ্য চল্লিশের এক ‘তরতাজা যুবক’ আজ চিকিত্সাধীন। এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু হয়েছে। সুতরাং একটি বড় দায়িত্ব মাথায় নিয়ে তাকে এখন চলতে হবে অত্যন্ত সতর্কভাবে। তিনি অতীত থেকে যদি শিক্ষা নেন, তাহলে লাখ লাখ কর্মীর যে প্রত্যাশা, সে প্রত্যাশা তিনি পূরণ করতে পারবেন বলেই আমার বিশ্বাস।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ই-মেইল : tsrahmanbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.