দূর ঘটনা (দুর্ঘটনা) এখন কাছেই! by মোঃ রায়হান কবির

হাসান সাহেবরা একটি কোয়ার্টারে বাস করেন। তারা দোতলায় থাকেন। তাদের প্রতিবেশী কামাল সাহেবরা নিচতলায় থাকেন। কামাল সাহেবের আঙিনায় প্রচুর ফলদ গাছ আছে। কিন্তু সেখানে উৎপাদিত ফল কামাল সাহেবরা কোনো প্রতিবেশীকে দেন না। কেননা, ফল যে তার আঙিনায় হয়! এ নিয়ে প্রতিবেশীদের মনে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করত। কিন্তু কেউ কিছু বলত না। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্র ক্ষণ। কামাল সাহেব ট্রান্সফার হয়ে গেলেন অন্যত্র।


তার যাওয়ার সময় এলে সব প্রতিবেশী খুব খুশি মনে তাদের যাওয়ার প্রতীক্ষা করছেন, কারণ তিনি গেলেই হয়তো তার বাগানের ফলফলাদি সবার মধ্যে বিতরণ সম্ভব। কিন্তু যেদিন তার যাওয়ার সময় এলো সেদিন সকালে সব প্রতিবেশী অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলেন, বাগানের সব গাছ কেটে সাফ করা হয়েছে! বিস্মিত প্রতিবেশীর উদ্দেশে কামাল সাহেব স্মিত হেসে বললেন, 'ভাবলাম আমি না থাকলে এগুলোর যত্ন কে নেবে? তাই পরিষ্কার করে গেলাম!' আসলে তিনি চাচ্ছিলেন না তার অবর্তমানে কেউ এই বাগানের ফল ভোগ করুক। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাবও অনেকটা এমন। হয়তো সরকারি দলও কামাল সাহেবের মানসিকতার। কারণ, বর্তমান সরকার যখন বিরোধী দলে ছিল, তখন রাজপথ তাদের দখলে ছিল। যখন ক্ষমতায় এলো, রাজপথ স্বাভাবিকভাবেই বিরোধী দলের দখলে যাবে। কারণ সরকারি দলের তো আর আন্দোলনের প্রয়োজন হয় না। সেই বিচারেই কি-না কে জানে, বর্তমান সরকার কিন্তু পথঘাটের প্রতি ভীষণ উদাসীন। তাদের ভাবনাটা হয়তো এমন, পথঘাট ভালো থাকলে তো বিরোধী দলের লাভ। কারণ তারা নির্বিঘ্নে 'রোডমার্চ' করতে পারবে! তাতে জনগণের কী ক্ষতি হলো সেটা ভাবার সময় কোথায়?
শেষের পথ...
হাসান সাহেব অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছেন। হাসান সাহেবের স্ত্রী তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ব্যাপারটা খেয়াল করে হাসান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, 'কী ব্যাপার, হঠাৎ এমন করে তাকিয়ে আছ কেন?' তার স্ত্রী বললেন, 'না, এমনি!' স্ত্রী 'এমনি' বললেও হাসান সাহেব জানেন তার স্ত্রী কেন অমন শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। জীবিকার তাগিদে তাকে অনেকটা পথ ভ্রমণ করে অফিস করতে হয়। স্বল্প বেতন হওয়ায় অফিসের আশপাশে বাসা নেওয়ার সামর্থ্য নেই। ইদানীং টিভি-পত্রিকায় রোড অ্যাক্সিডেন্টের খবর এতই বেড়েছে যে, কেউ একবার পথে বের হলে আদৌ ফিরবে কি-না তা নিয়ে সংশয়ে থাকতে হয়। অথচ কিছু করারও নেই। জীবনের তাগিদেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অফিসে যেতে হয়। তার ওপর আছে অফিসে সময়মতো পেঁৗছানোর নির্মম প্রতিযোগিতা, যাতে প্রায়ই জ্যামের জয় হয়! হাসান সাহেব ভাবলেন, একসময় গান ছিল_ এই পথ যদি না শেষ হয়...। আর এখন পথ-ঘাটের যা অবস্থা, তাতে পথ শেষ হওয়ার আগে মানুষই শেষ হয়ে যায়! পথ শেষ হওয়ার গ্যারান্টি না থাকলেও পরিবহন দুর্ঘটনার যা অবস্থা, তাতে মানুষ শেষ হওয়ার গ্যারান্টি আছে (!)।
পথের বিনোদন
আজ হাসান সাহেব ছুটি নিয়েছেন। তার ছেলেমেয়েরা এই দিনটির প্রতীক্ষায় ছিল দীর্ঘদিন। কারণ আজ তারা পার্কে ঘুরতে যাবে। মজার মজার রাইডে চড়বে। তাই তারা রেডি হয়ে সকাল সকাল বের হয়েছেন, যাতে জ্যামে পড়তে না হয়। কিন্তু তার পরও দুপুর পর্যন্ত পথেই বসে থাকতে হলো। সামনে অ্যাক্সিডেন্টের কারণে রাস্তা অবরোধ করেছে পথচারীরা। অথচ দুর্ভোগ সাধারণ মানুষের। তারা কি জানে, এই অবরোধ কতটা নিষ্ফল? কেননা এই অবরোধ যাদের জন্য করা তারা অনেক আগেই 'বোধ'শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন! একসময় বিরক্ত হয়ে হাসান সাহেবের ছোট ছেলে বলল, 'বাবা, বাড়ি চলো।' হাসান সাহেব বললেন, 'কেন বাবা, পার্কে যাবে না? তোমার কতদিনের শখ ম্যাজিক কার্পেটে চড়বে। চড়বে না?' ছেলে বলল, 'না বাবা। রাস্তায় যে ঝাঁকুনি খেয়েছি তাতে আমি ম্যাজিক কার্পেটের মজা পেয়ে গেছি। অহেতুক এত জ্যাম ঠেলে, এত এত টাকা নষ্ট করে ম্যাজিক কার্পেটে চড়ার দরকার কী? তার চেয়ে বাবা এই রাস্তা যারা বানিয়েছে, টিকিটের টাকাটা তুমি তাদের দিয়ে দাও!'
দূর ঘটনা এখন কাছেই
ছেলের কথায় হাসান সাহেব বাড়ি ফিরে এলেন। টিভিতে খবরে দেখলেন, যে সড়কটায় তারা জ্যামে আটকে ছিলেন, সেই সড়কে বাসচাপায় সাংবাদিক দীনেশ দাশ মারা গেছেন। মাত্র দু'দিন আগে বাসচাপাতেই আরেক সাংবাদিক তার পা হারিয়েছেন। আমাদের শ্রদ্ধেয় নৌ-মন্ত্রীর ড্রাইভাররা 'গরু-ছাগল' চিনলেও মানুষ বোধহয় চেনে না। নইলে ঢাকার রাস্তায় দিনদুপুরে এমন দুর্ঘটনা! হাসান সাহেবকে খবরটা বড় নাড়া দিল। এমন সময় হাসান সাহেবের স্ত্রী টিভি রুমে এসে বললেন, 'এই শুনেছ, ওই দুর্ঘটনায় একজন নাকি মারা গেছে?' হাসান সাহেব কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বললেন, 'দুর্ঘটনা বলছ কেন?' হাসান সাহেবের স্ত্রী বললেন, 'বা রে, দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলব না তো কী বলব?' হাসান সাহেব বললেন, 'তাহলে রোজ যে সূর্য ওঠে, ওটাও কি দুর্ঘটনা?' তার স্ত্রী বললেন, 'না! ওটা তো রোজই ওঠে, ওটা দুর্ঘটনা হবে কেন?' হাসান সাহেব বললেন, 'তাহলে তোমার টিভির স্ক্রলে যে দুর্ঘটনার খবর রোজই ওঠে, সেটা দুর্ঘটনা হবে কেন?'

No comments

Powered by Blogger.