স্লিপগল্প-ভুরুঙ্গামারীর আন্দোলনে একজন সফেদ দেবদূত! by আরিফ জেবতিক

শুক্রবারের সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ঢাকা শহরটাকে দেখতে বেশ লাগে আবদুল মোকাদ্দেস সাহেবের। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা। ড্রাইভার আসেন না এদিন, তাঁর সাপ্তাহিক ছুটি। তা ছাড়া এদিন মোকাদ্দেসের গাড়ি চড়াও মানা, এখানে-ওখানে প্রোগ্রাম থাকে, সেই প্রোগ্রামে গিয়ে গাড়িতে নামলে ভালো দেখায় না। যাঁরা এসব কর্মসূচিটুচি করেন, তাঁদের বেশির ভাগই ফকির টাইপের, অন্যকে গাড়িতে চড়তে দেখলে চোখ টাটায়।


মোকাদ্দেস তাই এদিন রিকশায় ঘোরাঘুরি করেন, ফাঁকা দিনে সেটা বড় সমস্যা হয় না। আজকে রিকশা নেওয়া গেল না। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে। অনুষ্ঠান শুরু হবে সকাল ১০টায়। মাত্র এক ঘণ্টা বাকি। এখন রিকশা নিলে পেঁৗছাতে দেরি হয়ে যাবে। আগে এসব অনুষ্ঠানে একটু দেরি করে যাওয়াই রীতি ছিল। যে নিজেকে যত গুরুত্বপূর্ণ ভাবে, সে তত দেরিতে আসবে_এমনটাই ছিল নিয়ম। এখন দিনকাল পাল্টেছে, আগে আগে গিয়ে প্রথম সারিতে চেয়ার দখল করতে হয়। টেলিভিশনের ফিচকে রিপোর্টারা প্রথম সারির চেয়ারগুলোতে কারা বসে আছেন শুধু সেটুকুই দেখান।
মোকাদ্দেস দ্রুত কাপড় পরে নেন। কাপড়চোপড় পরতে তাঁর বেশি দেরি হয় না। অনেক দিন ধরেই তিনি একটি নতুন বেশ নিয়েছেন। সাদা দুটি কাপড়কে পেঁচিয়ে একটা লুঙ্গির মতো করে পরেন, আরেকটা ওপরে পরে নেন। এই ফ্যাশনটা তিনি চালু করতে চাইছিলেন; কিন্তু তেমন চালু হচ্ছে না। পাবলিক এখন অনেক চালাক। তারা চট করে আজগুবি ফ্যাশন নেয় না, দূর থেকে আড়ে আড়ে দেখে। তাঁর আরেক বন্ধু লুঙ্গি বিপ্লব করতে গিয়ে নিজে লুঙ্গি পরেন, কিন্তু তাঁর মুরিদরা আজ পর্যন্ত লুঙ্গি পরা শুরু করেনি। সে তুলনায় তো এই দুহাতি ধুতি পরা আরো বেশি হাঙ্গামার।
ভাগ্য ভালো, সিএনজি-অটোরিকশা চট করেই পাওয়া গেল। বুড়ো মতো ড্রাইভার, কোনো কথা না বলেই মিটার চালু করে দিলেন। মোকাদ্দেস মনে মনে খানিকটা চমকালেন। অবশ্য শুক্রবারে এসব অটোরিকশাওয়ালাদের চাহিদা কম থাকে।
অটোরিকশা চলা শুরু করতেই চালক পেছন ফিরে মোকাদ্দেসকে একবার দেখে নিলেন।
নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন, 'আপনার বাপ মারা গেছেন, না মা?'
মোকাদ্দেস এমন প্রশ্নের কোনো আগামাথা বুঝলেন না। এমনিতে এসব গল্প জুড়ে দেওয়া রিকশাওয়ালা-অটোরিকশাওয়ালা তাঁর খুবই অপছন্দ। তবে মা-বাবা দুজনের কথায় মনটা তাঁর একটু নরম হলো। তিনি বললেন, 'দুজনই।'
বুড়ো চালকটা হাহাকার করে উঠলেন, 'আহা রে। তা শ্রাদ্ধ কবে?'
এবার মোকাদ্দেস বিরক্তি চেপে রাখতে পারলেন না। বিরক্তি গলায় ঢেলেই পাল্টা জিজ্ঞেস করলেন, 'কিসের শ্রাদ্ধ?'
'আপনার মা-বাবার।' সিএনজিওয়ালা জবাব দেন।
মোকাদ্দেস এবার রেগে ওঠেন, 'কী বলেন মিয়া এসব আবোল-তাবোল। আমি তো মুসলমান।'
ট্রাফিক লাইটে অটোরিকশাটি থেমে যায়। ড্রাইভার আবার পেছন ফিরে মোকাদ্দেসকে দেখেন।
'তাইলে আপনে এই শ্রাদ্ধের কাপড় পরছুইন যে?' তাঁর কণ্ঠে বিস্ময়।
মোকাদ্দেস এই মূর্খ চালকের অজ্ঞানতায় মজা পান। তিনি হেসে বলেন, 'ওহ, এই বিষয়। এটা তো আমার রাজনৈতিক পোশাক। আমি সব সময় পরি। আমি আসলে ভুরুঙ্গামারীর জনগণের কথা বলি এই রাজধানীতে। ভুরুঙ্গামারীর জনগণের দারিদ্র্য নিয়ে কথা বলি। তাই এই পোশাকটি আমাকে পরতে হয়।'
চালক আরো বেশি বিস্মিত হন। 'ভুরুঙ্গামারীর কী কথা ঢাকা শহরে?'
মোকাদ্দেস বলেন, 'সে তো অনেক কথা। তুমি সব বুঝতে পারবে না। যেমন ধরো এই যে ঢাকা শহরে যদি রাস্তাঘাট হয়, মেট্রোরেল হয়, তাতে করে ভুরুঙ্গামারীর জনগণের কী উপকার হবে? আমি এসব নিয়ে কথা বলি।'
সিএনজি-অটোরিকশাওয়ালা কী বোঝে, কে জানে। তিনি আর কোনো কথা না বলে একমনে চালাতে থাকেন। এতে লাভই হয় মোকাদ্দেসের। তিনি সময়মতো অনুষ্ঠানে এসে পেঁৗছাতে পারেন।
এবার মোকাদ্দেস মিটার দেখে গুনে গুনে ভাড়া মেটান। টাকা গুনে নেওয়ার ব্যাপারে চালকের কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। তিনি আমতা আমতা করতে থাকেন।
মোকাদ্দেস প্রসন্ন গলায় জানতে চান, 'তুমি কি কিছু বলতে চাও?'
অটোরিকশার বুড়ো ড্রাইভার মিনমিন করে বলেন, 'সবই তো বুজলাম। তয় একটা কথার উত্তর আমারে একটু দেন। এই যে আপনার সাদা দুইটা তেনা পরে আপনি আছেন, এই তেনা পরাটা ভুরুঙ্গামারীর মাইনষের কুন উপকারে লাগতেছে?'

No comments

Powered by Blogger.