কণ্ঠে মোদের কুণ্ঠাবিহীন নিত্যকালের ডাক by সুপা সাদিয়া

ণেশ দাশগুপ্ত। একজন মার্কসবাদী তাত্তি্বক। একজন আজীবন বিপ্লবী মানুষ। গতকাল ১৫ জানুয়ারি ছিল তার জন্মশতবার্ষিকী। তার বিচরণ ছিল সাহিত্য, সাংবাদিকতা আর রাজনীতিতে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে রণেশদা অপরিচিত বললে কম বলা হবে; তার নামটাই হয়তো অজানা। আর তাই তার এই জন্মশতবার্ষিকীতে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজন করেছে আবৃত্তি উৎসব। 'কণ্ঠে মোদের কুণ্ঠাবিহীন নিত্যকালের ডাক'_ এ স্লোগান সামনে রেখে চলছে এ উৎসব।
এই উৎসব বাংলাদেশের আবৃত্তি চর্চাকে আরও শাণিত করছে বলে সবার ধারণা। উদ্বোধনী দিনে একই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন এপার বাংলা-ওপার বাংলার আবৃত্তি শিল্পীরা। কবি নির্মলেন্দু গুণ, বাচিক শিল্পী আশরাফুল আলম, কাজী আরিফ, ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুষ্ঠানের উদ্বোধক হাসান ইমাম, অনুষ্ঠানের সমন্বয়কারী বদিউর রহমানের সঙ্গে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করলেন কলকাতার বাচিক শিল্পী পার্থ ঘোষ, গৌরী ঘোষ, জগন্নাথ বসু, ঊর্মিমালা বসু। তবে একই মঞ্চে দুই বাংলার এই মিলনমেলা যেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের ভাষায় :'দুইজনায় বাঙালি ছিলাম, দেখ দেখি কা খান/ তুমি এখন বাংলাদেশি, আমারে কও ইন্ডিয়ান।' সবাই যেন বাঙালি হয়ে উঠেছিলেন লাল-সবুজ উত্তরীয়তে। সবার কথার সুর_ রণেশদার নামটি বিলীন হয়ে যাচ্ছে অতল গহ্বরে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তাকে পরিচিত করতে হবে। তিনি ছিলেন জনমানুষের প্রতীক। তার কোনো সংসার ছিল না। তাই তার উত্তরসূরি, তার সন্তান হলাম আমরা। তাই রণেশদা আর তার কর্মকে ছড়িয়ে দিতে হবে আমাদের। এটা আমাদের একান্ত কর্তব্য। এই তিন দিনব্যাপী আয়োজনে দেশের সেরা আবৃত্তিকারগণ, বিভিন্ন সংগঠন আর কলকাতার অতিথিবৃন্দ আবৃত্তি ও শ্রুতি নাটক পরিবেশন করছেন। এ ছাড়া আছে রণেশদার বই এবং তার ওপর লেখা বইয়ের মোড়ক উন্মোচন।
রণেশদার জন্ম মুন্সীগঞ্জে, বেড়ে ওঠা বাবার চাকরির সুবাদে রাচীতে। বিহারের রাচী স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে বাঁকুড়ার কলেজে ভর্তি হন। রণেশদা জ্যাঠাদের সংস্পর্শে এসে ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তাই বাঁকুড়ার কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে কলকাতার সিটি কলেজ থেকে আইএ পাস করে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হন। কবি জীবনানন্দ দাশের বাবা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন রণেশ দাশের জ্যাঠামশাই। ওই বাড়িতেই শুরু হয় রণেশদার সংগ্রামী জীবন। লেখক ও সংগ্রামী তরুণ সোমেন চন্দ, কিরণ শঙ্কর সেনগুপ্ত, অচ্যুত গোস্বামী, মুনীর চৌধুরী, সানাউল হক, সরদার ফজলুল করিম, শহীদুল্লা কায়সার ও আরও অনেকের কাছেই রণেশদা ছিলেন কখনও তাদের শিক্ষক, কখনও বন্ধু, কখনও-বা সহকর্মী। '৪৮ থেকে '৬৯ পর্যন্ত চার দফায় ১২ বছর কারাভোগ করেন তিনি। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে তিনি রাজরোষের শিকার হয়ে জেলে। পঞ্চাশের মাঝামাঝি তিনি আত্মগোপন করেছিলেন। ১৯৫৫ সালে প্রথমে দৈনিক ইত্তেফাকের পরে সংবাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। গণসংযোগ ও জনপ্রিয়তার কারণে তিনি ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচিত হন। সারাজীবন তিনি লেখালেখি করেছেন। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১২। আরও অনেক প্রবন্ধ রয়েছে যা বই আকারে প্রকাশিত হতে পারে।
৬৩ বছর বয়সে ১৯৭৫ সালের অক্টোবরের শেষদিকে এক অভিমানে তিনি বহু বছর প্রিয় মাতৃভূমি থেকে ছিলেন বহু দূরে। বলেছিলেন ফিরবেন। ফিরেছেন, তবে প্রাণহীন রণেশদা। তবুও ১৯৯৭ সালে এই বাংলার বুকে তিনি ফিরেছিলেন, আর তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পেরেছিলেন বাঙালি।

সুপা সাদিয়া :সংস্কৃতিকর্মী
supasadia@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.