আন্তর্জাতিক : ফিলিস্তিন-ইসরায়েল-শালিতের মুক্তির পথ ধরেই শান্তি! by শ্রাবণ সরকার

বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম অমীমাংসিত এক অধ্যায়ের নাম ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যু। বলা বাহুল্য, উভয় পক্ষের মধ্যে নিরন্তর এ বৈরিতার উদ্ভব ইসরায়েলের জন্মের মধ্য দিয়ে। তাই ইসরায়েলের জন্মের সহোদর 'অশান্তি'ও। কোন পরিস্থিতিতে, কিভাবে, কাদের সমর্থন-সহযোগিতায় ইসরায়েলের আত্মপ্রকাশ, তা অজানা নেই কারো।
ইসরায়েলের জম্মের সঙ্গে সঙ্গে যে অশান্তিরও বীজ রোপিত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের জমিনে, এ কথা আজ চোখে ঢুলি আঁটা, কানে মাফলার জড়ানো মানুষটিও অস্বীকার করবেন না। অশান্তির সেই বিষবৃক্ষের ক্রমবিস্তৃত ছায়া ক্রমে ঢেকে দিয়েছে ফিলিস্তিনের আকাশ, যে আকাশে আজ সূর্যের দেখা নেই, রাতের চাঁদ-তারাও অনুপস্থিত! তার 'বদ-আছর' মধ্যপ্রাচ্যের সীমানা ডিঙিয়ে পুরো বিশ্বেই কমবেশি আছড়ে পড়েছে আজ! এই কালো ছায়া ফুঁড়ে এক ঝলক আলোর দেখা মিলল যেন হামাস-ইসরায়েল বন্দি বিমিময় চুক্তির বাস্তবায়নের পথে!

সার্জেন্ট গিলাত শালিতকে মুক্তি!
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণকারী দল হামাসের হাতে আটক ইসরায়েলি সেনা সার্জেন্ট গিলাত শালিতকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। বিপরীতে নিজেদের হাতে আটক কয়েক হাজার ফিলিস্তিনির মধ্যে এক হাজার ২৭ জনকে ছেড়ে দেওয়ায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইসরায়েল। এর মধ্যে ২৭ জন নারী বন্দি। চুক্তি অনুযায়ী গিলাতের মুক্তির দিনই গত ১৮ অক্টোবর প্রথম দফায় ৪৭৭ ফিলিস্তিনি মুক্তি পেয়েছে। মিসরের মধ্যস্থতায় সই হওয়া এ বন্দি বিনিময় চুক্তির ফলে গত ২৬ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো নিজেদের জিম্মায় থাকা কোনো ইসরায়েলি সেনাকে মুক্তি দিল হামাস।
মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনিদের অনেকেই বড় ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল। ইসরায়েলের ভূখণ্ডে বোমা হামলা এবং গুলি করে ইসরায়েলি নাগরিকদের হতাহত করার অভিযোগে আটক ও সাজাপ্রাপ্তরাও ছিল ছাড়া পাওয়ার দলে। এর মধ্যে ১৬ বার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা পাওয়া হামাস সদস্য আহলাম তামিমিও আছেন। তামিমি আগে টেলিভিশন সাংবাদিকতায় জড়িত ছিলেন। আছেন তিনবার যাবজ্জীবন ও পৃথকভাবে ৩০ বছরের কারাদণ্ড পাওয়া হামাসের বিশেষ একটি শাখার প্রধান মোহাম্মেদ আল শারাথা। এ ছাড়া একাধিক হামলায় অভিযুক্ত কয়েকজন বন্দিও রয়েছেন মুক্তি পাওয়ার তালিকায়। তবে হামাস তাদের শীর্ষ স্থানীয় যে ছয় নেতার মুক্তির দাবি জানিয়েছিল, তাদের মধ্যে কেবল একজনকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছে ইসরায়েল। শীর্ষ পর্যায়ের যে কজন মুক্তি পাবেন না তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ফাতাহ নেতা মারওয়ান রাগৌতি, পিএফএলপির নেতা আহমেদ সাদাত ও হামাস নেতা আবদুল্লাহ বারগৌতি। ২০০১ সালে ইসরায়েলি পর্যটনমন্ত্রীকে হত্যার নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে সাদাতের বিরুদ্ধে।
বন্দি বিনিময় চুক্তির বিষয়টি ঘিরে উভয় পক্ষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। একজন মাত্র ইসরায়েলি সেনার বিনিময়ে হাজারেরও ওপরে ফিলিস্তিনিকে মুক্তির ব্যাপারটি কতটা যৌক্তিক_সে প্রশ্ন যেমন তুলেছে ইসরায়েলিদের কেউ কেউ, তেমনি এ চুক্তির ফলে দেশের মাথা 'হেঁট' হয়েছে বলেও তাঁদের অনেকের মত। তাঁরা মনে করেন, ইসরায়েলকে দুর্বল প্রতিপন্ন করবে এ চুক্তি। পাশাপাশি জঙ্গি হামলা বাড়ার আশঙ্কাও করেছেন তাঁরা। চুক্তির মাধ্যমে 'সন্ত্রাসী' গোষ্ঠী হামাসের হাত শক্তিশালী করা হলো কি না_এ প্রশ্নও তুলেছে অনেক ইসরায়েলি। আর বিপরীতে ফিলিস্তিনি পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ বলছেন, গোটা গাজা উপত্যকাই তো একটা কারাগার। সেখানে এক হাজার ফিলিস্তিনির মুক্তিতে কিছুই যায় আসে না!

জাতীয় বীরের মর্যাদায় আসীন শালিত!
২০০৬ সালের ২৫ জুন ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের আন্তসীমান্ত সংঘর্ষের সময় শালিতকে নিজেদের কবজায় নেয় হামাস। এরপর একাধিকবার তাঁর মুক্তির ব্যাপারে ইসরায়েলের আলোচনার উদ্যোগ গোড়াতেই ভেস্তে যায়। হামাসের হাতে আটকের পর ইসরায়েলে রীতিমতো জাতীয় বীরের মর্যাদায় আসীন হন শালিত। তাঁর মুক্তির দাবিতে কমবেশি সোচ্চার ছিল গোটা দেশ। অন্যদিকে ইসরায়েলের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি স্বজনদের ফিরে পাওয়ার প্রবল আকুতি ছিল ফিলিস্তিনিদের।
ফলে দুই পক্ষের বন্দি বিনিময় চুক্তির ঘোষণায় গাজা ও ইসরায়েলের অনেক মানুষ আনন্দ উদ্যাপনে মেতে ওঠে। শালিতের মুক্তির দাবিতে তাঁর মা-বাবা নোয়াম শালিত ও আভিভা শালিত গত বছরের জুন থেকে তেলআবিবে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বাসভবনের বাইরে তাঁবু গেড়ে বসবাস করছিলেন। ছেলের মুক্তি না মেলা পর্যন্ত সেখান থেকে এক পাও নড়বেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তাঁরা।
ইসরায়েলি বেশির ভাগ নাগরিকের মতো মন্ত্রিপরিষদেরও বেশির ভাগ সদস্য এ চুক্তির পক্ষে মত দেন। ১১ অক্টোবর তিন ঘণ্টার উত্তপ্ত আলোচনা শেষে ২৬-৩ ভোটে চুক্তির পক্ষে রায় দেয় পরিষদ। বিপক্ষে অবস্থান নেন কট্টর জাতীয়তাবাদী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আভিগদর লিবারম্যানসহ অন্য দুই জাতীয়তাবাদী মন্ত্রী।
চুক্তিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসও। চুক্তির উদ্যোগকে স্বাগত জানান তিনি। চুক্তির বাস্তবায়নকে 'ফিলিস্তিনিদের জাতীয় অর্জন' হিসেবে অভিহিত করেন আব্বাস।
কিন্তু উভয় পক্ষের সন্তোষ-অসন্তোষের বিষয়টি ছাপিয়ে যে প্রশ্নটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে_ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার বিবাদের অনিঃশেষ প্রহরের মধ্যে ঠিক এ সময়ে কেন এবং কিভাবে এই বন্দি বিনিময় সমঝোতাটি হলো? যেখানে জাতিসংঘের গত অধিবেশনে (৬৬তম) ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের করা পূর্ণ সদস্যপদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উভয় পক্ষের মধ্যকার বৈরিতার সূচক তুঙ্গে! বিশ্লেষকরা বলছেন, চুক্তির পেছনে কাজ করেছে মাহমুদ আব্বাসের ভূমিকা। গত আগস্টে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আব্বাস ভাষণ দিয়ে মঞ্চ থেকে নামতে না নামতেই কার্যত আলোচনার টেবিলে ফিরে আসতে রাজি হয় হামাস। জাতিসংঘের দরবারে পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদের আবেদন তুলে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন মধ্যপন্থী আব্বাস ও তাঁর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। অথচ গাজার নিয়ন্ত্রক কট্টরপন্থী হামাসের জনপ্রিয়তা দিন দিন পড়তির দিকে। এ অবস্থায় নিজেদের জনপ্রিয়তার ধস ঠেকাতে ফিলিস্তিনিদের মন রক্ষার মতো কিছু সফলতা দেখাতে মরিয়া হয়ে ওঠে হামাস। এরই পরিণাম এ চুক্তি।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, চুক্তির বিষয়বস্তু থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে চুক্তিটির বাস্তবায়ন আগেই হতে পারত। চুক্তির বেশির ভাগ বিষয় নিয়ে কয়েক বছর ধরে দরকষাকষি চলছিল দুই পক্ষের মধ্যে। বরাবরই যে বিষয়টি নিয়ে অগ্রগতি আটকে ছিল, তা হচ্ছে ফাতাহ নেতা মারওয়ান রাগৌতি, পিএফএলপির নেতা আহমেদ সাদাতের মতো প্রভাবশালী ফিলিস্তিনি নেতাদের মুক্তির ব্যাপারে ইসরায়েলের অস্বীকৃতি। বর্তমান চুক্তির অধীনেও তাঁরা মুক্তি পাচ্ছেন না। তাহলে এটি তো আগেই হতে পারত।
তবে অন্য আরেকটি বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে। তা হলো, ইসরায়েল এই প্রথমবারের মতো আরব বংশোদ্ভূত ইসরায়েলি নাগরিকদের বিষয়ও আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, দুই ধাপে ফিলিস্তিনিরা মুক্তি পাবে। এর প্রথম ধাপে ৪৭৭ জন মুক্তি পেয়েছে। বাকিরা এক মাসের মধ্যেই ফিলিস্তিনের মাটিতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পাবে।

একমাত্র ট্রাম্পকার্ড!
২০০৬ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার পর থেকে হামাসের জনপ্রিয়তা দিন দিন কমছে বৈ বাড়ছে না। এর অন্যতম কারণ ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের নিয়মিত রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র বিনিময়। নিত্য এ সংঘাতময় পরিস্থিতি হামাসকে জনমত পক্ষে টানায় সহায়তা করেনি বিশেষ। উল্টো ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক অবরোধ গাজার অধিবাসীদের বেঁচে থাকা কার্যত দুর্বিষহ করে তুলেছে। গাজাবাসীর এই ঘেরাও জীবনযাপন যেন কারাগারে বসবাসেরই শামিল। তাই জনগণের জন্য একটা 'উপহার'-এর ব্যবস্থা করে নিজেদের অবস্থান জনপ্রিয়তার মজবুত ভিতে দাঁড় করাতে সচেষ্ট হয় হামাস। বলা বাহুল্য, এক ইসরায়েলি সেনার বিনিময়ে হাজার ফিলিস্তিনিকে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে ব্যাপকভাবেই প্রসংশিত হচ্ছে হামাস নেতৃত্ব। সে তুলনায় আবার যেন রাজনৈতিকভাবে কিছুটা ফিকে হয়ে গেলেন মাহমুদ আব্বাস!
কিন্তু ফিলিস্তিনিদের কাছে বীরের মর্যাদা পাওয়া নেতারা এ চুক্তির আওতার বাইরে থাকায় তাদের মুক্তির ব্যাপারটি অনিশ্চিত রয়েই গেল। যে অনিশ্চয়তার পথ পরিহারের কথা ভেবে এর আগে এ ধরনের চুক্তি সম্পন্নে রাজি হয়নি হামাস। পর্যবেক্ষকদের অনেকে তাই মনে করছেন, হাতের একমাত্র ট্রাম্পকার্ডটি ব্যবহার করে খেলার প্রথম ধাপে হামাস বিজয় পেয়েছে মাত্র। পুরো খেলায় তারা জিতবে কি না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মতৈক্যই পারে শান্তির দ্বার খুলতে!
তবে এ চুক্তির ফলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির পালে হাওয়া লাগতে পারে বলে অনেকে আশা করছে। অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের এ সমঝোতা চুক্তি আগামী দিনে উভয় পক্ষকে বৃহত্তর সমঝোতার পথে নিয়ে যেতে পারে। এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, গত শতকের মাঝামাঝি থেকে আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার প্রশ্নে পশ্চিমারা বরাবরই 'একচোখা' আচরণ করেছে। তারাই এ অশান্তি জিইয়ে রেখেছে বললে ভুল বলা হয় না। কোনো কোনো কট্টর সমালোচক আরো এক ধাপ এগিয়ে, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল বৈরিতার দীর্ঘ প্রহরের জন্য এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে কাঠগড়ায় তোলেন। তাঁদের দাবি, ফিলিস্তিনিদের আত্মিক, ন্যায্য ও আইনসংগত স্বাধীনতার দাবি, তাদের একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের দাবির ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরাই বিমাতাসুলভ আচরণ করে আসছে। ফিলিস্তিন প্রশ্নে তাদের একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি ও পদক্ষেপ বারবার ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষকে হতাশ করেছে, দুঃখিত করেছে। পাশাপাশি সংক্ষুব্ধও করেছে বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী লাখো-কোটি মানুষকে।
তবু ফিলিস্তিনের কঠোর বিরোধী অবস্থান ও ইসরায়েলের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনের ব্যাপারে মার্কিন চিরায়ত নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। দশকের পর দশক কেটে গেছে, বিংশ শতক পেরিয়ে বিশ্ব পড়েছে একুশ শতকে, শুরু হয়েছে নতুন সহস্রাব্দও; তবু ইসরায়েলের পরম মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনের বিরোধিতার প্রশ্নে নিজেদের একটুও বদলায়নি!
তাই পশ্চিমা বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যস্থতায় বা মুরবি্বয়ানায় যে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আসবে না, তা অনেকটাই প্রমাণিত আজ। তাই বিকল্প পন্থার কথা বলছেন অনেকেই। এভাবেও ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয় পক্ষের মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমঝোতা ও মতৈক্যের সম্মিলন শান্তি প্রতিষ্ঠায় মজবুত ভিত গড়ে দিতে পারে বলে তাঁদের আশাবাদ।

No comments

Powered by Blogger.