পুলিশ সংস্কার কর্মসূচি-নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় by নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা

আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, দুর্নীতি দমন, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা বিধান, তরুণ সমাজ এবং বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা জোরদার করতে পুলিশের দায়িত্ব অনেক। নাগরিকদের নিরাপত্তা, জাতীয় স্থিতিশীলতা, ধারাবাহিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য একটি জবাবদিহিমূলক, স্বচ্ছ, দক্ষ ও সেবাধর্মী পুলিশ সার্ভিস সময়ের দাবি।


মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার সমুন্নত থাকবে এমন নিরাপদ ও বাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে পুলিশকে জনগণের বন্ধু ও সেবক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ২০০৫ সালে পুলিশ সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়।
এ কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ পুলিশের সার্বিক দক্ষতা ও কর্মদক্ষতা আরও বৃদ্ধি করা; জনগণের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে অপরাধ দমনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ, সবার জন্য মানবাধিকার সুনিশ্চিত, আইনের শাসন বলবৎ এবং বর্তমান লোকবল ও সরঞ্জামাদির সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে পুলিশের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করছে এই সংস্কার কর্মসূচি। পুলিশ সদস্যদের আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, কর্মক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করাসহ পুলিশের জন্য উপযুক্ত কর্মকৌশল হাতে নেওয়াও এর অন্যতম লক্ষ্য।
পুলিশ সংস্কার কর্মসূচি প্রথম পর্যায়ে (২০০৫-০৯) বাংলাদেশ পুলিশকে ব্যাপক আইনি ও প্রশাসনিক সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিতে সহায়তা দিয়েছে; যেমন অপরাধ দমন, তদন্ত, পুলিশ কার্যক্রম ও মামলা পরিচালনা; মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষণ ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা এবং কৌশলগত সক্ষমতা ও সৃষ্টি। কারিগরি দক্ষতার পাশাপাশি পুলিশের নৈতিকতা, পেশাদারি এবং সংস্কৃতি বিনির্মাণের ওপরও দৃষ্টি দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ পুলিশ প্রথমবারের মতো পুলিশ সংস্কার কর্মসূচির (পিআরপি) সহযোগিতায় একটি কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে, যা এর ভবিষ্যৎ সেবার প্রাধিকারসহ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং মৌল চেতনাকে তুলে ধরেছে। এর লক্ষ্য এমন একটি পুলিশি ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা ভীতি প্রদর্শনের হাতিয়ার না হয়ে কমিউনিটির সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে সেবা প্রদান করবে। এতে বর্তমানে প্রচলিত ঔপনিবেশিক পুলিশি ব্যবস্থাকে সমসাময়িককালের উপযোগী সেবামূলক পুলিশি ব্যবস্থায় রূপান্তরের দিকনির্দেশনা রয়েছে, Reactive পুলিশি ব্যবস্থার পরিবর্তে Proactive পুলিশি ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এটি একটি বড় ধরনের সাংস্কৃতিক ও কৌশলগত পরিবর্তন আনবে: ‘বল প্রয়োগ’ থেকে ‘সেবা’।
পুলিশ সংস্কার কর্মসূচির প্রথম পর্যায় (২০০৫-০৯) ৩০ সেপ্টেম্বর ২০০৯ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রথম পর্বের চলমান কর্মসূচির সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশের কৌশলগত পরিকল্পনা ২০০৮-১০ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ছয়টি অপারেশনাল আউটকামের মাধ্যমে প্রকল্প কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। এগুলো হচ্ছে:
১. কৌশলগত পরিকল্পনা ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার; এর মাধ্যমে পুলিশের পরিকল্পনা ও বাজেট প্রণয়ন, আধুনিক আইনগত কাঠামো, জবাবদিহি ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনার বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।
২. মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষণ; পুলিশের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও কাঠামো শক্তিশালী হবে এবং অধিকতর যোগ্য ও পেশাদার পুলিশ তৈরিতে বাংলাদেশ পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
৩. তদন্ত অপারেশন ও মামলা পরিচালনা; পুলিশের নিরপেক্ষ তদন্ত ও সুষ্ঠু মামলা পরিচালনার মাধ্যমে সবার জন্য ন্যায়বিচারের পথ সুগম হবে।
৪. অপরাধ দমন ও কমিউনিটি পুলিশি; পুলিশ ও জনগণের মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া এবং আস্থা বৃদ্ধি পাবে, যা বিচার-প্রক্রিয়ায় জনগণের প্রবেশাধিকার সুগম করবে ও মানবাধিকার সংরক্ষিত হবে।
৫. জেন্ডার সংবেদনশীল পুলিশিং সহায়ক কার্যক্রম; নারীর অধিকতর অংশগ্রহণ সমাজের নারী ও শিশুদের সমতাভিত্তিক ও সংবেদনশীল সেবা প্রদানে সক্ষম হবে এবং তাদের অধিকার রক্ষায় সহায়তা করবে।
৬. তথ্য-যোগাযোগ প্রযুক্তি; ব্যয়-সাশ্রয়ী, ফলপ্রসূ ও স্থায়ী তথ্য যোগাযোগ এবং প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশ সমাজকে উন্নত সেবা দিতে সক্ষম হবে।
এ লক্ষ্যে ২০০৯-২০১৪ এই পাঁচ বছরে পুলিশ সংস্কার কর্মসূচির মোট ২১৩.৭০ কোটি টাকার প্রকল্প প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন লাভ করেছে। কর্মসূচি বাস্তবায়নে পিআরপি দ্বিতীয় পর্যায়ে এ বিষয়গুলোর ওপর প্রাধিকার দিয়েছে:
১. কমিউনিটি পুলিশিং দর্শনকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো এবং অপরাধ দমনে অধিকতর Proactive ভূমিকা পালনে পুলিশকে সহায়তা প্রদান। ২. পুলিশের অপারেশন, অপরাধ তদন্ত ও মামলা পরিচালনার উৎকর্ষ সাধন। ৩. দক্ষ বা ভালো গুণসম্পন্ন পুলিশ সদস্য তৈরিতে প্রশিক্ষণ সক্ষমতা বৃদ্ধি। ৪. উন্নত পরিকল্পনা, বাজেট, কর্মপদ্ধতি প্রণয়নে পুলিশের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির এবং প্রতিষ্ঠানের আইনি কাঠামোর আধুনিকায়নে সহায়তা। ৫. পুলিশকে অধিকতর জেন্ডার সংবেদনশীল করা। ৬. বাস্তবসম্মত ও সাশ্রয়ী তথ্য যোগাযোগ এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধ দমন ও অপরাধ দমনে দ্রুত সাড়া প্রদানের ব্যবস্থা উন্নতকরণ। ৭. ব্যবহারিক ও নীতিগত ক্ষেত্রে বিচার-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত অপর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগ সাধন।
দ্বিতীয় পর্যায়ে পিআরপি একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক পুলিশের উপযোগী মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষণকাঠামো গঠনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এ লক্ষ্যে নিয়োগ, পদোন্নতি, প্রশিক্ষণ এবং পুলিশ প্রশাসনের প্রতিটি পর্যায়ে প্রযুক্তিনির্ভর ইলেকট্রনিক তথ্য ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন করা হবে। পুলিশের অপারেশন, অপরাধ তদন্ত ও নির্মূলে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার উৎসাহিত করা হচ্ছে। অপরাধের তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও প্রদানের ক্ষেত্রে সক্ষমতা গড়ে তুলতে পিআরপি অপরাধ তথ্য বিভাগের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। প্রথাগত মৌখিক সাক্ষ্য ও স্বীকারোক্তির পরিবর্তে বস্তুগত সাক্ষ্য সংগ্রহের মাধ্যমে অপরাধী শনাক্তকরণের আধুনিক প্রযুক্তি অর্জনে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও যন্ত্রপাতি সংগ্রহের পাশাপাশি সাক্ষ্য আইনকে যুগোপযোগী করার উদ্যোগও নিয়েছে।
কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমের মাধ্যমে জনগণের সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের আধুনিক ধারণা বাংলাদেশ পুলিশের কার্যক্রমে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। থানায় সেবা প্রদানকেন্দ্র, উন্মুক্ত দিবস প্রভৃতি প্রবর্তনের মাধ্যমে পুলিশ ও জনগণ আগের তুলনায় অনেক কাছাকাছি আসার সুযোগ পেয়েছে। পিআরপি বাংলাদেশ পুলিশের জন্য অপরাধ দমন কৌশলপত্র ও কমিউনিটি পুলিশিং কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছে। এসব কৌশলপত্র অনুসরণে পুলিশ সদরদপ্তরে স্থাপিত অপরাধ দমন সেল সারা দেশের অপরাধ দমন ও কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম সমন্বয় করবে।
বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশের মোট সংখ্যার মাত্র ১.৩ শতাংশ নারী। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পুলিশ তিন হাজার নতুন নারী সদস্য নিয়োগের কার্যক্রম নিয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্ক (বিপিডব্লিউএন) গঠন করা হয়েছে। এই নেটওয়ার্কের দেড় শতাধিক মহিলা পুলিশ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশান অফ উইমেন পুলিশ (আইএডব্লিইপি)-এর সদস্যপদ লাভ করেছে। প্রথমবারের মতো প্রবর্তন করা হয়েছে জেন্ডার গাইডলাইন এবং ঢাকায় তেজগাঁও থানা কমপ্লেক্সে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের একমাত্র ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার। আগামী পাঁচ বছরে অবশিষ্ট বিভাগীয় শহরগুলোতে পাঁচটি নতুন ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার চালু করা হবে। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের মাধ্যমে প্রবর্তিত রেফারেল সার্ভিস পুলিশ এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সহযোগিতায় দরিদ্র ভুক্তভোগী মানুষের ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির পথ প্রশস্ত করবে।
পিআরপি প্রথম পর্যায়ে তথ্য ব্যবস্থাপনা কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে কৌশলপত্রের আলোকে তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি সংগ্রহ, স্থাপন ও প্রয়োগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক তথ্য ব্যবস্থাপনা ও ডেটাবেজ স্থাপনের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। অপরাধ ও সন্ত্রাস দমন এবং শনাক্তকরণে তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
পুলিশ সংস্কার বিষয়ে যেকোনো আলোচনায় কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের গণমুখী পরিবর্তনের বিষয়টি। পুলিশ আইন ১৮৬১ এ যুগের গণতান্ত্রিক সমাজে অচল। সংবিধানে মৌলিক অধিকার রক্ষার বিষয়ে যেভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, পুলিশ আইনে তার কোনো স্বীকৃতি দেখতে পাওয়া যায় না। গণতন্ত্রের মূল নীতিগুলো মেনে এবং মানবাধিকার ও মানবিক মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে আইন ও সংবিধানের প্রতি বিশ্বস্ততা, পুলিশের কাজের অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিধান রেখে প্রণয়ন করা হয়েছে ‘খসড়া পুলিশ অধ্যাদেশ’, যা সরকারের বিবেচনাধীন।
পিআরপি ও বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন কার্যক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ পুলিশ শত সীমাবদ্ধতারও মধ্যেও জনগণকে তার কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রদানে সক্ষম হবে। আগামী দিনে আধুনিক প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিজ্ঞানে দক্ষ, জনবান্ধব, বাহ্যিক প্রভাবমুক্ত, আইন-আদালত ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ একটি পেশাদার সংগঠন হিসেবে পুলিশ গণতান্ত্রিক সমাজের প্রত্যাশা পূরণ করে নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে পারবে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
সংস্কার-উদ্যোগ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অনুমোদিত হতে হবে। বাংলাদেশ পুলিশ জনগণের সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে কাজ করে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বদ্ধপরিকর। এ জন্য প্রয়োজন সবার সহযোগিতা।
নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা: অতিরিক্ত আইজিপি, বাংলাদেশ পুলিশ ও জাতীয় প্রকল্প পরিচালক, পুলিশ সংস্কার কর্মসূচি।
nbkt@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.